-ঐ নাবিলা, ওঠ্ না। আর কত দেরি করবি ?
ধুর, মেয়ে টা ঘুমোতেও দেবে না নাকি। এতো সুন্দর স্বপ্ন টা ভেঙ্গেই দিল। ঘোর লাগা একটা ভাব নিয়ে উঠে বসে ধীরে ধীরে চোখ মেলে মৃন্ময়ীর দিকে তাকাল নাবিলা। দেখেই বেশ অবাক হল। চোখ কচলে আরেকবার তাকাল। হুম, মেয়ে টা এতো সেজেছে কেন! আজকে কি কোন বিশেষ দিন নাকি!
-কিরে ? সেজেছিস কেন এতো ?
-আরেহ্। কাল রাতে ঘুমনোর আগে না বললাম তোকে ? সাব্বির আসছে আজকে ?
-ওহ্। মনে পড়েছে। হুম, বেচারা তোকে দেখেই মাথা ঘুরিয়ে পরে যাবে রে। এতো সেজেছিস কেন ? এমনিতেই তোকে দেখে হা করে তাকায় থাকতো। এতো সাজার কি দরকার ছিল ?
-ওমা। এতদিন পর আসছে, একটু সাজবো না ? আর তাছাড়া, ওর বাবা-মা ও যাবে ওকে রিসিভ করতে। তাইতো একটু সেজেছি।
-হুম, ভাল। হবু শ্বশুর শাশুড়ি ও দেখবে আজকে তোকে। বিয়ে তো ঠিক হয়েই আছে। আর কি ইমপ্রেস করবি তাদের ?
-হুর্। তুই বুঝবি না তো। উঠে ভার্সিটি যা তাড়াতাড়ি।
-হুম, বের হ তুই।
মৃন্ময়ী চলে গেলে আবারও শুয়ে পড়লো নাবিলা। চুপ চাপ শুয়ে থাকতে থাকতে এলোমেলো ভাবনায় হারিয়ে গেল সে। ভার্সিটি যাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেল।
এলোমেলো ভাবনার পথ ধরে এগোতে এগোতে মাথায় দু চার টা কবিতার চরণ চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি উঠে বসে পড়ার টেবিলের ড্রয়ার খুলে ডাইরি টা বের করে লিখতে বসে গেল নাবিলা, এখন যদি লিখে না রাখে পরে ভুলে যেতে পারে। কবিতারাও ওর সাথে মানিয়ে নিতে পারে না। এলোমেলো হয়ে ঘুরে বেরায় ওর মৌন-আকাশে। তাই সাথে সাথে তাদের ধরে খাঁচায় না পুরলে কোথায় উড়ে যাবে, আর খুঁজেই পাবেনা তাদের।
সময়ের ঘূর্ণিপাকে অদৃশ্য আবেগ নিয়ে,
চেনা জগত মাঝে এলোমেলো ভাবনা নিয়ে,
এগিয়ে চলেছি আমি ধীরে ধীরে,
এগিয়ে চলেছি আঁধারের জগতে।
আলোকিত জগত থেকে দূরে, বহু দূরে।
একমুঠো মৃত ইচ্ছেরা-
আজ আমায় বড্ড বেশি ভাবাচ্ছে,
তাই আজ পণ করেছি,
তাদের সমাধি গড়বো বলে।
আজ খুটে খাওয়া আতঙ্কের দল কাঁদবে।
আর্তনাদ করে কাঁদবে।
কারণ, আজ তাদের সমাধি রচিত হবে।
………
শেষ করলো না কবিতা টা নাবিলা। ওর মনের আকাশে কাল মেঘ জমেছে, বৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। রান্নাঘর থেকে ম্যাচ নিয়ে এলো সে, ওর মামি খেয়াল করেনি। নাবিলার বাবা-মা নেই, ছোটবেলা থেকেই মামা-মামির সাথে আছে। মামা-মামি দুজনেই ওকে অনেক আদর করে। বাবা-মার অভাব সেভাবে টের পায়নি কোনদিনই। ওর যখন দুবছর বয়স, তখন বাবা-মা দুজনই রোড এক্সিডেন্ট এ মারা যায়। ও ছিল তখন নানু বাসায়। তারপর থেকেই মামা-মামির সাথে আছে, মৃন্ময়ী ওর মামাতো বোন।
বারান্দায় গেল নাবিলা। ডাইরি তে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বারান্দার মেঝে তে ফেলে দিল, পুড়ছে, নাবিলা টলটলে চোখ নিয়ে দেখছে তার মনের কথা গুলো কিভাবে পুড়ে যাচ্ছে, দেখতে দেখতে ভাবনায় হারিয়ে গেল সে আবারও।
সাব্বির কে পছন্দ করতো নাবিলা। খুব বেশি ভালবাসত, মাঝে সাঝে কথাও হত খুব। সাব্বির ওর ভার্সিটির বন্ধু। দুবছর ছিল সাথে। ছেলে টা বেশ মিশুক ছিল, এবং খুব মজা করতে পারতো। নাবিলা প্রেমে পরে যায় সাব্বির এর। তাই খুব বেশি মিশত তার সাথে। দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন নাবিলার বার্থডে তে সাব্বির সহ ওর কয়েকজন বন্ধু এসেছিল বাসায়, তখনই সাব্বির মৃন্ময়ী কে দেখে। সে তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। পরদিন নাবিলার থেকে মৃন্ময়ীর নাম্বার নেয় সাব্বির। নাবিলা সরল মনে দিয়ে দেয়, যেহেতু সাব্বির ওর খুব ভাল বন্ধু। কিন্তু, ধীরে ধীরে নাবিলা দেখে যে সাব্বির আড্ডা তে কম সময় দেওয়া শুরু করে, এবং নাবিলা কেও আগের মত ফোন করে না, মাঝে সাঝে করলেও দু একটা কথা বলেই ঘুরে ফিরে প্রসঙ্গ চলে আসে মৃন্ময়ী। বুঝতে পারে নাবিলা যে, সাব্বির আর মৃন্ময়ী এর মাঝে কিছু একটা চলছে। তবুও চুপ থাকে নাবিলা। নিজের ভালবাসা নিজের মধ্যে পুষতে থাকে সে। তার একমাত্র কাছের বন্ধু ছিল তার ডাইরি। সেখানে সব লিখে রাখে সে। বেশ কিছু গল্প লিখেছে সে সাব্বির কে নিয়ে, সাব্বির কে ঘিরে অনুভূতিগুলো কে পুঁজি করে লিখেছে বেশ কিছু কবিতা।
সেদিনও নাবিলা সাব্বির কে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, ঘুম থেকে উঠেই লিখতে বসে যায়। ভার্সিটি অফ থাকায় বেশ সময় ও পায় সে।
“অতিমাত্রায় ঠাণ্ডা লাগার কারণে কাঁপুনি ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো নাবিলার। সে চোখ মেলছে না। শুনতে পাচ্ছে পাশ থেকে সাব্বির কথা বলছে। সম্ভবত কবিরের সাথে। ট্রেন এ আছে ওরা। স্বপ্নের কাঁপুনিটা আসলে ট্রেন এর ঝাঁকুনি ছিল। পুরো একটা কামরা নিয়েছে কবির। ওরা ঢাকা যাচ্ছে। সাব্বির ঢাকার ছেলে। ঢাকাতেই জন্ম, সেখানেই বড় হয়েছে। আচ্ছা, আজ যেন কত তারিখ ! …………”
এমন সময় নাবিলাকে পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে মৃন্ময়ী। নাবিলার লেখায় তখন বাঁধা পরে। মৃন্ময়ীর কণ্ঠে তখন অপ্রতুল আনন্দ। সে বলতে থাকে,
-নাবিলা… জানিস, সাব্বির আমাকে প্রপোজ করেছে। আমি হ্যাঁ বলেছি। বিশ্বাস কর্ নাবিলা, সাব্বির কে প্রথম যেদিন তোর জন্মদিন এর পার্টি তে দেখেছি, ওকে অনেক ভাল লেগেছিল। এরপর ও তোর থেকে নাম্বার নিয়ে আমাকে ফোন দিল… কতদিন কথা হল… আমি ভাবতেও পারিনি ও আমাকে ভালবাসে… কি যে ভাল লাগছে নাবিলা। বলে বোঝাতে পারবো না তোকে আমি।
এক-নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে থামে সে।
অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে মুখে হাসি ফুটিয়ে মৃন্ময়ীর আনন্দে আনন্দিত হওয়ার অভিনয় করেছিল নাবিলা। জানে না সে, কি করে পেরেছিল। ইচ্ছে করছিল মরে যেতে। পারেনি, গল্পটি তখনও শেষ হয়নি যে!
শেষ পর্যন্ত গল্পটি শেষ করতে পারেনি নাবিলা। “ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই ঘোর লাগা ভালবাসার অনুভূতি তে ডুবে গেল নাবিলা। ” কাল রাতে এ পর্যন্ত লিখেই শুয়ে পরেছিল।
আজ সাব্বির ফিরছে দেশে। স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল মৃন্ময়ী এর সাথে সম্পর্ক হওয়ার পরপরই। কদিন পর সাব্বির আর মৃন্ময়ী এর বিয়ে। মাঝে সাব্বির এর বাবা-মা এসে মৃন্ময়ী কে দেখে গিয়েছে, বিয়ে ও ঠিক হয়ে আছে ওদের।
কি দরকার আর সাব্বির এর স্মৃতি ধরে রেখে ? সাব্বির কে যে ও ভালবাসে তার একমাত্র সাক্ষী এই ডাইরি কে তাই আজ পুড়িয়ে ফেলছে সে। যদিও নিজেকে শেষ করে দেবার কথাও ভেবেছিল, কিন্তু পরে সেটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিল। কারও জন্য অন্তত নিজের জীবন টা শেষ করে দেওয়া বোকামি ছাড়া কিছুই নয়, এবং এমন বোকামি করতে সে রাজি না যার কারণে তার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। সময় এর সাথে সব ঠিক হয়ে যায়, এ ক্ষতটাও ঠিক হয়ে যাবে, যতই দাগ থাকুক অন্তত চলতে পারবে এটাকে এক পাশে রেখে, তার জন্য নিজেকে জীবনের অন্যান্য সুখ থেকে বঞ্চিত করার কোন মানে হয় না। এসব ভেবেই সেই চিন্তা টা বাদ দিয়েছিল নাবিলা।
ডাইরিটা পুড়ছে আর সে দেখছে, নাবিলার ঠোঁটের কোনে তখন বিজয়ের বিদ্রূপাত্মক হাসি। কেউ জানতে পারেনি, পারবেও না আর। নাবিলার ভালবাসার কথা।
৬টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
গল্প ও কবিতায় দু’পর্বে সুন্দর উপস্থাপন ।
তওসীফ সাদাত
ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
সব প্রেম প্রকাশিত হয়না
জীবন থেমে থাকেনা , বহমান জীবন ।
দুই পর্বে সমাপ্ত সুন্দর একটি গল্প ।
তওসীফ সাদাত
হুম, জীবন বহমান। ধন্যবাদ 🙂 ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
খসড়া
চমতকার, উপস্থাপন সাবলীল। 🙂
তওসীফ সাদাত
ধন্যবাদ 🙂