প্রথমেই বলে নেই আমাদের দেশে ‘নারীবাদ’ এবং ‘ব্লগার’ শব্দ দুটোকে মানুষ বরাবরই অপব্যাখ্যা করে, বাঁকা চোখে দেখে। বলা যায়, শব্দ দুটো কখনোকখনো ‘গালি’ অর্থে আবার কখনোকখনো প্রতিপক্ষকে টার্গেট করতেও ব্যবহৃত হয়। অথচ শিক্ষাদীক্ষায়, শৌর্যেবীর্যে উন্নত দেশগুলিতে তা আক্ষরিক অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
২০১৩ সালের পর ব্লগার বলতেই মানুষ বুঝতো নাস্তিক। হায়! হায়! শিক্ষিত সচেতন লোককেও দেখতাম ব্লগার শুনেই তাদের চাহনিতে পরিবর্তন এসে গেছে, সন্দেহ চেপে বসেছে, আবার সওয়াব কামাইয়ের মোক্ষম সুযোগ পেয়ে কিছু হেদায়তের বানিও ছুড়ে বসেছে। এসব কার্যকলাপ দেখলে মুখ টিপে হাসা ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। যাহোক, গত ছ’বছরে এই নেতিবাচক ভাবনাটিতে অনেকটাই ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
এবার আসি ‘নারীবাদ’ শব্দটি নিয়ে। আদপে এই শব্দটির অন্তর্নিহিত অর্থ আমিই-বা কতোটুকু বুঝি, তাও স্পষ্ট নয় আমার নিজের কাছেই। বস্তুতপক্ষে কিছুদিন আগে বৃটেনে বসবাসরত আমার এক কাজিনের সাথে বেশ ক’দিন আমার খুব গল্পগুজব হয় নারীর অধিকার, পরাধীনতা, জীবনযাত্রা, নারীকন্ঠ, নারীর মনোজগত, নির্ভরশীলতা, মেরুদণ্ডহীনতা, বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না বৈশিষ্ট্য, সেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। আমার দৃষ্টিতে এই যে ভাবনা, মূলত এটাই তো নারীবাদ হওয়ার কথা। আর এ ভাবনাগুলো নারীপুরুষ নির্বিশেষে যে কারো মননেই জাগতে পারে। যদি এ ভাবনাই ‘নারীবাদ’ শব্দের মূল হয়ে থাকে তবে কেনো এটাকে নারীর ভাবনা বলে গুলিয়ে ফেলা হয়? আমি কি বুঝাতে পারলাম? নাকি আমার উপলব্ধিটাই ভুল?
বস্তুতপক্ষে পৃথিবীজুড়েই নারী অবহেলিত। অধিকার, স্বাধীনতা, এই জায়গাগুলোতে সে নির্জীব। নির্জীব মানে এখানে তাকে যতোটুকু অধিকার দেয়া হয় ততোটুকুই সে ভোগ করে। আর যদি না দেয়া হয় তাহলে তার বলার কিছু থাকে না। কিন্তু কেনো? সে যদি একজন ইনডিভিউজুয়াল মানুষ হয়ে থাকে তবে তার এই অধিকারগুলোর নিয়ন্ত্রক অন্যমানুষ তথা পুরুষ বা পুরুষপক্ষীয় কেউ হবে কেনো? ইনডিভিউজুয়াল ব্যক্তির ইনডিভিউজুয়াল ভয়েস থাকবে না কেনো? ঠিক এখানে যখন আপনি আলোকপাত করবেন তখনই পুরুষতন্ত্র শব্দের সাথে পুরুষ শব্দটি যোগ হওয়ায় অনেকেই এটিকে সরাসরি পুরুষের বিরুদ্ধে অবস্থানকে নির্দেশ করেন বা বুঝেন! আর গোলযোগটা বাঁধে সেখানেই।
আমি চাকুরী করবো কি করবো না সেটা আমার ভাবনা।
আমি আমার বেতন আমার পছন্দমতোই খরচ করবো, সেটা আমার অধিকার।
আমি হিজাব করবো কি করবো না, সেটা একান্তই আমার সিদ্ধান্ত।
বাচ্চা কোন স্কুলে পড়বে সেখানে আমিও মত প্রকাশ করার অধিকার রাখি।
এরকম বহু ব্যাপার আছে যেখানে নারীর কোন ভয়েস থাকে না। জাস্ট পুতুলরুপে সে শুধু নির্দেশ পালন করেই যায়। যার নিয়ন্ত্রক থাকে পুরুষ বা পুরুষপক্ষ। অনেক সময় ব্যক্তি পুরুষ না চাইলেও পুরুষতন্ত্রের (সামাজিক বিধিব্যবস্থা, যা পুরুষের সুবিধার্থেই তৈরি) কারণেই সে চায়, অনেকক্ষেত্রে চাইতে বাধ্য থাকে।
কাজেই ‘নারীবাদ’ শব্দটিকে নারী এবং পুরুষের সাংঘর্ষিক কোন বিবাদ হিসাবে দেখার কিছু নেই। বরং বলা যায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর অধিকার খর্ব হওয়া থেকেই ‘নারীবাদ’এর জন্ম। অর্থাৎ ‘পুরুষতন্ত্র’ দ্বারা সামাজিক বিধিব্যবস্থার নামে চাপিয়ে দেয়া কিছু নিয়ম যা কখনো আইন, কখনো প্রথা, কখনো বাধ্যবাধকতার নামে নারীকে মেরুদণ্ডহীন নির্ভরশীল করে রাখার যে চক্রব্যূহ রচিত হয়ে কাল থেকে কালান্তরে নারীকে পিষে মারছে, সে চক্রব্যূহ ভাঙার জাগরণই ‘নারীবাদ’। সে নারীবাদে অধিকার সচেতন নারী পুরুষ উভয়েরই ভূমিকা থাকে, থাকবে। চিন্তাশীল, উদারচিত্তের মানুষ মাত্রই নারীবাদকে সমর্থন করে, করবে।
সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে ‘নারীবাদ’ শব্দটি না বুঝে যেমন এর অপব্যাখ্যা হয়, তেমনি না বুঝার কারণে এর অপব্যবহারও হয়। নারীদের একটা বড়অংশ স্বাধীনতার নামে সেচ্ছাচারিতাকে বুঝে থাকেন। অনেক নারী এ ভাবধারাকে আশ্রয় করে সেচ্ছাচার হয়েও উঠেন। সেচ্ছাচারিতা সময়ে সময়ে কিছুকিছু নারীকে আক্রমণাত্মক, হিংসাত্মকও করে তুলে। তারা স্বাধীনতা আর সেচ্ছাচারিতাকে গুলিয়ে ফেলেন। স্বাধীনতা যেমন সম্মানজনক, সেচ্ছাচারিতা তেমনি অপমানজনক। স্বাধীনতা নিজ স্বাধীনতাকে বুঝায়, আর সেচ্ছাচারিতা স্বাধীনতা ভোগের নামে অন্যের অধিকার খর্ব করাকে বুঝায়। যেমন: বাচ্চা দুজনের। যৌথ সিদ্ধান্তে বাচ্চাকে স্কুলে দেওয়া স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে একক সিদ্ধান্তই হচ্ছে সেচ্ছাচারিতা। এধরণের সেচ্ছাচারিতা পুরুষতন্ত্রে পুরুষের একাধিপত্য ছিলো, পুরুষতন্ত্রের শেকল ভেঙে অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে উলটো সেচ্ছাচারই হয়ে উঠলে তো সমানাধিকরণ ব্যাপারটাই থাকে না। ফলত ‘নারীবাদ’ নামীয় আন্দোলনটা কলঙ্কিত হয়ে যায়।
যাহোক, গত কিছুদিন আগে আমার সেই কাজিন, যে একজন কবি হিসাবে বৃটেনে বেশ পরিচিত। দু’একটা বইও বেরিয়েছে তার। সে ওখানাকার বাঙালী কমিউনিটি, যারা কি না আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগে তাদের মানসিক সাপোর্ট দেয়ার জন্যেই মূলত সে লেখালেখি করে। ঘরেবাইরে দুই ভিনদেশী আচারের কারণে বেশি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়া এই নারীগুলোর প্রবলেম আরো বেশি প্রকট হয়ে উঠে ভাষাগত কমিউনিকেশন গ্যাপের কারণে। সে তার লেখার মাধ্যমে এই সংযোগটাই ঘটাতে চায়। ইত্যাদি ইত্যাদি আলাপ হয়।
এবার আসার পর তার কৌতূহলে আমি আমার কিছু লেখা তাকে পড়ে শুনাই, যেহেতু বাংলা সে পড়তে পারে না। সেদিন দেখি সেই লেখাগুলোর একটিকে ( ভাবুন। স্বকীয়তা বজায় রেখে আমার আমিত্বকে আবিষ্কার করুন।) আশ্রয় করে সে ‘Sister-in-law’ (Bhabi) শিরোনামে একটি কবিতা রচনা করে ফেলেছে।
যাহোক, ব্যাপারটা নিয়ে একটু লিখলাম এজন্য, গত দু’দিনে দেখলাম এ ‘নারীবাদ’ ব্যাপারটা নিয়ে বেশ একটা হৈ-হুলুস্থল ব্যাপার। আর এজন্য আমি আমার ভাবনাটা অকপটে প্রকাশ করলাম।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা কিছু কুসংস্কার, কিছু অনায্য প্রথা, কিছু পক্ষপাতিত্বমূলক নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে ইনডিভিউজুয়াল বোধকে জাগ্রত করার আহবানকে আমি বরাবরই সমর্থন করি। প্রয়োজন হলে লড়াইও করি। আর এটিকেই যদি নারীবাদ বলে, আমি সে মতকে অবশ্যই সমর্থন করি।
ভাবুন। স্বকীয়তা বজায় রেখে নিজের ’আমিত্ব’কে আবিষ্কার করুন।
৮টি মন্তব্য
নীরা সাদীয়া
আপনি একদম আমার মনের কথা লিখেছেন। দুটোর সম্মুখীন আমি হয়েছি। ব্লগার শুনে বাঁকা চোখে তাকাতো আগে। আর নারীবাদ! এটা নিয়ে এখনো পুড়ছি।
একটা সাম্প্রতিক ঘটনা শেয়ার করি। আমি একটা সেবামূলক গ্রুপের সাথে যুক্ত হই। সেখানে যুক্ত হবার আগেই আমার পূর্ব পরিচিত একজন জানিয়ে দেয়, সাদীয়া কিন্তু নারীবাদি! আর রক্ষে কই? সেই গ্রুপের কেউ আমাকে মন থেকে গ্রহন করেনি, কথায় কথায় অপমান করত। অন্য কোন বিষয়ে কথা বলতে গেলেও ঐ নারীবাদের ঝাল মেটাতে বিরোধীতা করত, তেড়ে আসত। শুনিয়ে শুনিয়ে সারাক্ষণ নারী বিরোধী মন্তব্যও করত, তসলিমার এবং আমার ১৪ গোষ্ঠী উদ্ধার করত। এসব অপমান সইতে না পেরে চলে এসেছি ঐ গ্রুপ ছেড়ে! এবার বোঝেন অবস্থাটা!
আপনার লেখাটা শেয়ার করলাম ঐ মূর্খদের জন্য।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শুভকামনা রইলো। যা শুদ্ধ মনে করবেন তাই মননে ধারণ করেবেন, কে কি ভাবলো তাতে একদম কান দেবেন না। সমাজ একদিনে পরিবর্তন হয় না। কয়েক পুরুষের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে একটু আলো দেখা দেয়, তারপর একসময় তা প্রতিষ্ঠিত হয়।
পূর্বসূরিদের কণ্টকাকীর্ণ পথই আমাদের জন্য মসৃণতা এনে দিয়েছে, আমাদের সংগ্রামও আমাদের উত্তরসূরিদের পথকে আরেকটু মসৃণ করবে।
ভাল থাকুন।
মনির হোসেন মমি
আপু প্রোফাইল ছবিটা পরিবর্তন করে নিন।
মনির হোসেন মমি
নারীবাদ আর পুরুষবাদ বলে আমার কোন কিছু নেই।এ জগতে সকলেই সমান।সকল কল্যায়ণকর কর্মে কেউ কোন অংশে কম নয়।আসল কথা হল মানিয়ে চলা,মেনে চলা,মেধাবুদ্ধিযুক্তি খাটিয়ে এগিয়ে যাওয়াই হল সকল বাদের অবসান।চমৎকার লেখা।
তৌহিদ
আমার কাছে নারীবাদ আলাদা কোন শব্দ নয়। আমি শুধু বুঝি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা।
মনের কথা লিখেছেন। ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য।
মোঃ মজিবর রহমান
প্রিথিবিটা জন্মেই হইতো এভাবেই চলছে। কখন ভাল আবার কখন মন্দ মনে হই।
মানুস মাত্রই মানুস সমান অধিকার থাকা দরকার।
অপার্থিব
অল্প কথায় ভালই লিখেছেন। পৃথিবীর অন্য সব বিষয়ের মত নারীবাদও নানা মত ও ভাগে বিভক্ত, যেমনঃ সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ, উদার নৈতিক নারীবাদ, কট্টরপন্থী নারীবাদ(এরা পুরুষের উপর নারীর শ্রেষ্ঠত্ব চায়, যৌনতার প্রশ্নে মুলত সমকামী), কর্পোরেট নারীবাদ ইত্যাদী। নারীবাদের মুল দর্শনগুলো মানবতাবাদের বিপক্ষে নয়, এই সত্যটার উপলব্ধিই প্রধান জরুরী।
জিসান শা ইকরাম
আপনার লেখার সাথে একমত।
এই দেশে নারীবাদ এবং ব্লগার শব্দটিকে নেতিবাচক ভাবেই দেখা হয়।
এমন পোষ্ট এর প্রধান আকর্ষন হচ্ছে, মন্তব্য এবং পালটা মন্তব্যে আলোচনা।
পাঠক তাহলে মন্তব্য করে শান্তি পায়,
নতুবা এক পাক্ষিক আলোচনা জমে না।
শুভ কামনা।