>>এই শুনো,কটা বাজে?
ছোট্ট একটা মেয়ে,বয়স বড়জোর সাত বছর হবে। বারান্দার গ্রিল ধরে আছে। অদ্ভুত ভাবে কিছুটা,গ্রিলের ফাঁকে পা ঢুকিয়ে,দুহাত দিয়ে গ্রিল ধরে গালটা গ্রিলে ঠেকিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।অদ্ভুত মায়াভরা চোখ।
>>এই বলোনা কটা বাজে।
>>সময় জেনে কি করবে?
>>আমার মামণি কখন আসবে হিসাব করবো। আমি ঘড়ি দেখতে পারি কিন্তু আমার ঘরে ঘড়ি নাই জানো।
আমি কোনোদিন এই পাড়ায় আসিনি। আজ এসেছি এক দরকারে। বান্ধবীর বাসায়। কাজ শেষ তাই এখন চলে যাচ্ছি। কিন্তু এই পিচ্চি মেয়ের ডাকে থামলাম। খুব ইচ্ছা করছে মেয়েটার সাথে পাশে বসে গল্প করতে।
>>তোমার মামণি কোথায়? বাইরে গেছে বুঝি?
>>আমার মামণি অফিসে গেছে। বাবা ও।
>>তুমি একা বাসায়?
>>হ্যাঁ আমি একা।
>>তুমি খেলতে গেলেই তো পারো তোমার বন্ধুদের সাথে।
>>আমাকে খেলতে যেতে দেয়না মামণি। ওরাও খেলতে নেইনা জানো। আমি এখানে এভাবে বসেবসে মানুষ দেখি আর ডেকে ডেকে কথা বলি।
খুব খারাপ লাগছিলো পিচ্চিটার জন্য। এইটুকু একটা বাচ্চা…..
আর আমার ছোটবেলা কতো মজার। মা নিজের চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলো আমাদের তিন ভাই বোন জন্মানোর পরে। মাকে পাশে পেয়েছি সবসময়। শহরে বাসা তাই সেরকম কোনো মাঠ পাইনি খেলার জন্য, তাই গলিতেই পাড়ার ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করতাম। আমার শৈশব কেঁটেছে বিস্তর স্বাধীনতায়,আর এই মেয়েটির!!
>>এই আঙ্কেল শুনোনা …
মেয়েটার কথায় ফিরে আসি আমার শৈশব থেকে কারণ এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি মেয়েটার শৈশবে।
>>৩:৪৫ বাজে বাবু।
>>আমি বাবু না। আমি অনেক বড় হয়েগেছি জানো? আমি আর কাঁদিনা আগের মতো।
>>তোমার ঘরে তো ঘড়ি নেই আমি একটা কিনে দিই তোমাকে?নিবে?
>>না না নিবোনা। মামণি বলেছে অপরিচিত কেউ কিছু দিলে নিতে হয়না। ওরা পঁচা হয়।
>>তাই বুঝি?
>>হ্যাঁ।
>>তাহলে আমিও তো পঁচা,আমার সাথে যে কথা বলছো যদি আমিও ঐসব পঁচাদের মতো কিছু করি?
>>হি হি হি। আঙ্কেল তুমি তো আমায় ধরতেও পারবানা। তুমি নিচে আর আমি উপরে।
বেশ মজা লাগছিলো মেয়েটার সাথে কথা বলতে। জানিনা কেন ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছিলো না। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যতোক্ষণ না মেয়েটির মামণি আসবে ততোক্ষণ মেয়েটাকে আমি সঙ্গ দিবো। পাশের বাসার প্রাচীর টা বেশ ছোট,তাই প্রাচীর টাই উঠে বসলাম।
>>তো কি হয়েছে? আমি যদি উপরে এসে তোমার ঘর থেকে তোমায় ধরে নিয়ে যায়?
>>হি হি হি,আঙ্কেল তুমি না বোকা। আমার বাসায় তো তালা লাগানো,আমার ঘরেও।
কি বলে মেয়েটা!! ওর কথা শুনেই ছ্যাঁত করে উঠলো বুকের ভিতরে। বাসায় তো তালা লাগানোই এমনকি মেয়েটার ঘরেও!! যদি মেয়েটা ভয় পাই,যদি মেয়েটার ঘরে কিছু ঢুকে,যদি কোনোমতে ওর ঘর টাতে আগুন ই লেগে যায় কি করবে মেয়েটা? পুড়ে যাবে আগুনের লেলিহানে? পুড়ে যাবে এই নিষ্পাপ দেহ টা!!
>>তোমার ক্ষুধা লাগলে কি করো?
>>মামণি সারাদিনের খাবার আমার ঘরে রেখে যায়। কিন্তু জানো আঙ্কেল আমার একা একা খেতে ভালোলাগেনা। মামণি বলে গেছে এই সময়ে ঘুমাতে। কিন্ত আমার একা একা ঘুম ও আসেনা।
>>তুমি তোমার মামণির সাথে অফিসে যেতে পারোনা? আর তোমার স্কুল নেই?
>>আমি নাকি খুব পাঁজি মেয়ে। মামণি একবার অফিসে নিয়ে গিয়েছিলো। আমি পুরো অফিস দৌড়ে বেরিয়েছিলাম বলে মামণি আমায় আর অফিসে নিয়ে যায়না।আমি কি পাঁজি বলো?
>>না একদম না। তুমি একদম গুড গুড বারবি ডল। কিন্ত স্কুলে যাওনা কেন?
>>আমায় মামণি আর বাবা রুটিন করে স্কুলে রেখে আসে। আজ বাবার পালা ছিলো। কিন্তু বাবা আর মামণি রাগারাগি করার পর বাবা আর বাসায় আসেনি। মামণি বলে বাবা নাকি আর একটা নতুন মামণির সাথে থাকতে গেছে।জানো আঙ্কেল আমার স্কুলে যেতে খুব ভালোলাগে। অনেকে আসে স্কুলে। আমরা খেলা করি একসাথে, দৌড়ে বেরায়,আইসক্রিম খাই।
আমি কি বলবো? কাকে দোষী করবো? মেয়েটাকে নাকি মেয়েটার মামণিকে নাকি মেয়েটার বাবাকে নাকি এদের নিয়তিকে?? ছোট্ট মেয়েটি অপেক্ষায় থাকে মায়ের ঘরে ফেরার,মা অপেক্ষায় থাকে মেয়েটির বাবার ফেরার অপেক্ষায়, আর মেয়েটির বাবা অপেক্ষা করে সেই সময়ের যে সময়ে উনি বেরিয়ে আসতে পারবে দুই সংসারের এই গোলকধাঁধা থেকে।
>>আমি যদি তোমায় চকলেট দিই তুমি নিবে?
>>মামণি যে বকা দিবে শুনলে।
>>মামণি জানবেনা। এটা তোমার আর আমার সিক্রেট সিক্রেট।
>>আচ্ছা,ঠিকআছে।
আমি গলির সামনের দোকানটাই গেলাম। দোকান টা বন্ধ। তাই কিছুটা দূরের আর একটা দোকানে গেলাম। বেশকিছুক্ষণ লাগলো চকলেট কিনে আনতে। এসেই দেখি বারান্দা টা ফাঁকা। ভিতর থেকে একটি পূর্ণ নারীকন্ঠ শোনা যাচ্ছে। মেয়েটার মামণি এসে গেলো এতো তাড়াতাড়ি!! আরো কতো গল্প ছিলো মেয়েটার সাথে।হাত ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি ৫:৩০ বেজে গেছে। মেয়েটার সাথে গল্প করতে করতে কখন যে সময় চলে গেছে বুঝতেও পারিনি। মেয়েটা……
ইশশ,মেয়েটার নাম কি সেটাই তো শোনা হয়নি গল্পে গল্পে। চকলেট গুলোর দিকে তাকালাম। এরপর ছুঁড়ে দিলাম মেয়েটার বারান্দা বরাবর। হয়তো মামণির সাথে গল্পে মনেই থাকবেনা আমার কথা। আর আমারো হয়তো এদিকে আর আসা হবেনা। ভালো থাক মেয়েটা এটা ভাবতে ভাবতেই পা বাড়ালাম আমার ঠিকানায় ফেরার।।
৯টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
দারুণ গল্পে কঠিন বাস্তবতার ছোঁয়া ।
ইয়াগনিন সুলতানা
ভালো লাগাতে পেরে ভালোলাগলো।দোয়া করবেন ভাইয়া
ব্লগার সজীব
ভালো লেগেছে আপু।
ইয়াগনিন সুলতানা
🙂 ধন্যবাদ
অলিভার
এটা আর গল্প নেই, অনেকের জন্যেই এই শহুরে জীবনের বাস্তবতা। ছুটে চলছে সবাই, কিন্তু যাদের জন্যে এভাবে ছুটে চলেছে তাদেরই যদি এমন ভাবে নিঃশব্দে ধ্বংস করে দেয় তাহলে ছুটে চলার মূল্যটাই বা থাকলো কোথায়। অবশ্য বলেও লাভ নেই, ছুট লাগাতেই হবে। এটাই নিয়ম, এটাই নিয়তি….
বাস্তবতাকে এত সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করার জন্যে ধন্যবাদ 🙂
ইয়াগনিন সুলতানা
🙂 হুমম,এটাই এখন নিয়তি
শুন্য শুন্যালয়
খুবই নির্মম একটি সত্য নিয়ে লিখেছেন। আমার এক পরিচিত আপু সে তার বাচ্চাকে বাড়িতে নাকি চেয়ারের সাথে বেঁধে তারপর আসতো । মনটা খচখচ করে উঠলো লেখাটা পড়ে।
ইয়াগনিন সুলতানা
এটা আমার খুব কাছের একজনার কাহিনী।নির্মম বাস্তবতা
লীলাবতী
লেখাটি পড়ে শিউরে উঠলাম আপু। সচেতন হতে হবে ।