থাকুক একান্ত আপন হয়ে

রিমি রুম্মান ৯ ডিসেম্বর ২০১৫, বুধবার, ০৯:২৮:২৬পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩৫ মন্তব্য

মাসব্যপী আলোকোজ্জ্বল সাজে সজ্জিত নগরীর সমস্ত মানুষ যখন বড়দিনের উৎসব পালন করছিলো, ঠিক সেই সময়ে আমার বড় ছেলে রিয়াসাতের সহপাঠী মায়া’র পরিবারে ভয়াল এক অন্ধকার নেমে আসে। পাঁচ বছর আগের সেইদিনটি ছিল পঁচিশে ডিসেম্বর। দেশ থেকে খবর এলো মায়া’র বাবার অবস্থা ভীষণ খারাপ। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওদের দেশে যেতে হবে। সাত বছরের মায়া, এক বছর বয়সী ছোটভাই মাহিন সহ ওর মা’কে প্রতিবেশী বাঙালিরা টিকেট কেটে প্লেনে তুলে দিল। দীর্ঘতম এক যাত্রা ! পৃথিবীর দীর্ঘতম এক পথ, যে পথের দূরত্ব শেষ হতে চায় না কোনভাবেই। প্রিয়জনের কাছে পৌঁছাবার অপেক্ষা’র পথ…

তিনমাস পর দেশ থেকে ফিরে মায়া স্কুলে আসতে শুরু করে। মায়া’র মা’কে দেখে আমরা অন্যসব মায়েরা যারপরনাই বিস্মিত হলাম। স্বামী’র মৃত্যু একজন নারীকে এতোটাই টুকরো টুকরো করে দিল যে, তাঁর দেহে শুধু নিভুনিভু প্রাণটুকুই অবশিষ্ট ছিল। হয়তো ছোট্ট দু’টি সন্তানের জন্যে এটুকুই ছিল কেবল !

অনেকগুলো দিন মাস পেরিয়ে গেলো। তিনি আসা-যাওয়ার পথে কারো সঙ্গেই কথা বললেন না। নিরবে একাকি ঘুমন্ত ছেলেটিকে স্ট্রলারে ঠেলে সকালে স্কুলে আসেন মায়া’কে নিয়ে। ঠাণ্ডা আর তুষারপাতের এই দেশে সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য।

 

সব আঁধারই একসময় আলোর দিকে এগিয়ে যায়। তিনিও একটু একটু করে স্বাভাবিক হলেন। জানালেন, বাচ্চাদের জন্মের পর মা হিসেবে তাঁকে তেমন কিছুই করতে হয়নি। ওদের বাবা’ই সব যত্ন-আত্তি নিতো। এমন কি মধ্যরাতে উঠে ফিডার খাওয়ানো, ডায়পার বদলানো সবই করতেন নিজ থেকে। তাই সেই মানুষটার মৃত্যুর পরের সময়টা মায়া’র মা’য়ের জন্য অথৈ সমুদ্রে ডুবে যেতে যেতে খড়কুটো ধরে কোন মতে ভেসে থাকবার মতন।

 

স্বামী কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। বাড়ি বানিয়েছেন। বাড়ির কাজের চূড়ান্ত সমাপ্তির আগে দেশে গিয়েছেন বাকি কাজ নিজে সামনে থেকে তদারকি করবেন বলে। খুব ভোরে ফজরের ওয়াক্তে জায়নামাজে সেজদারত অবস্থায় বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। সে-ই যাওয়া না ফেরার দেশে। সে-ই যাওয়া মায়ার এই জগত ছেড়ে।

 

পুত্রহারা বাবা পুত্রবধূকে থেকে যেতে বললেন সেখানে। তেমনটি হলে হয়তো সুন্দর হতো। কিন্তু বাস্তবতা কি আসলেই এতোটা সহজ, সুন্দর ? স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর পরিবারে একজন নারী কি আসলেই সন্তানদের নিয়ে ভাল থাকবার কথা ? যেখানে স্বামী জীবিত থাকতেই সেই পরিবারে ভাল থাকা হয়না বেশীরভাগ নারীর। তাছাড়া বিদেশে জন্মানো শিশু দু’টি নিয়ে মায়া’র মা দেশে থাকতে ভরসা পেলেন না। বাচ্চাদের সামনে অনেক দীর্ঘ পথ। ওদের এটা লাগবে, ওটা লাগবে, নানান রকম আবদার থাকবে। শ্বশুরের কাছে কতক্ষণ, কতবার চাওয়া যায় ? এদিকে নিউইয়র্ক থেকে প্রতিবেশীরা নিয়মিত ফোন করেন, সাহস দিলেন ফিরে আসবার জন্যে। শেষে ফিরে এলেন। শ্বশুরবাড়ির মানুষজন অসন্তুষ্ট হলেন। কেউ বললেন, নিজের খেয়াল খুশি মত চলার জন্যে বিদেশ বিভূঁইয়ে ফিরে যাচ্ছে। কেউ বললেন, আবার বিয়ে করার ইচ্ছে হয়তো, তাই ফিরে যাচ্ছে…

প্রতি ভোরে আমরা অন্যসব মায়েরা যখন হাত ধরে পরম মমতায় সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছি, কপালে চুমু দিয়ে বিদায় দিচ্ছি, ঠিক সেই সময়ে মায়া একাকি স্কুলে আসে। কোনদিকে না তাকিয়ে মাথা নুইয়ে স্কুল গেটের দিকে এগিয়ে যায়। আবার ছুটির সময়টাতে আমরা যখন স্কুল গেটে অধীর অপেক্ষায় সন্তানের জন্যে, তখন মায়া নামের ছোট্ট মেয়েটির জন্যে কোন অপেক্ষার দৃষ্টি নেই। নেই  অপেক্ষা শেষে জড়িয়ে ধরার কোন হাত, কোন বাহু। রোজ দুপুরে স্কুল শেষে ধীর, স্থির, শান্ত মেয়েটি চুপচাপ হেঁটে যায় একাকি বাড়ির উদ্দেশ্যে রুজভেল্ট এভিনিউ ধরে। কেননা, সেই সময় মায়া’র মা স্কুলের অন্য গেটে অন্যের সন্তানের জন্যে অপেক্ষায়। অন্যের সন্তানকে স্কুলে আনা-নেয়া করা, বেবিসিটিং করা সহ টুকটাক কিছু কাজ করে জীবনের কঠিনতম আরেক অধ্যায়ের শুরু সংগ্রামী সেই মায়ের।

আমরা সন্তানের পিছনে প্রচুর সময় এবং অর্থ ব্যয় করছি। কোচিং করাচ্ছি। আমাদের কারো কারো সন্তান স্কুলে অনারেবল এ্যাওয়ার্ড পাচ্ছে প্রতি বচ্ছর। আমন্ত্রিত অবিভাবক হিসেবে সেইসব এ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানগুলোতে যাচ্ছি। সন্তানের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে হাততালি দিয়ে তাঁদের উৎসাহিত করছি। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য যে, বাবাহীন, মায়ের সান্নিধ্যহীন ছোট্ট মায়া একাকীই ভাল রেজাল্ট করছে। সে প্রিন্সিপ্যালের হাত হতে এ্যাওয়ার্ড নেয়। ঘুরে দাঁড়িয়ে সব অবিভাবকের দিকে দৃষ্টি বুলায়। অতঃপর মাথা নুইয়ে নিজ আসনে গিয়ে বসে। সেই সময় এইটুকুন মানুষটি কেমন বোধ করতো জানিনা। তবে আমার ভেতরে তীব্র এক সুনামি বয়ে যেতো। নিজের সন্তানকে সেই অবস্থানে ভেবে গা শিউরে উঠতো। কষ্টে বুক চিরে কান্না পেতো।

পাঁচ বছর বাদে এখন মায়া এবং আমার ছেলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। দূরের মিডল স্কুলে বাসে একাকি যাতায়াত করে। আমাদের মায়েদের আর দেখা হয় না। গত গ্রীষ্মে বাঙালি পাড়া নামে পরিচিত জ্যাকসন হাইট্‌সে মেলায় অন্য অনেকের সাথে ষ্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে গান শুনছিলাম। অনেক কোলাহলের মাঝে কেউ একজন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন। অনেক আপন কারো জড়িয়ে ধরা। পিছনে ফিরি। মায়া, তাঁর মা, এবং ভাই মাহিন হো হো করে হেসে উঠলো আমায় চম্‌কে দিলো বলে। অতঃপর ওরা দু’ভাই বোন বাবল গান নিয়ে খেলায় মেতে উঠলো। একজন বাবল ছুঁড়ে দিচ্ছিলো গান থেকে। অন্যজন বাতাসে উড়ে যাওয়া বাবল ধরার চেষ্টা করছিল। ভাইবোনের এই খেলা, ক্ষণে ক্ষণে হেসে উঠা__ অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। মায়া’র মা কথা বলেই যাচ্ছিলো খল্‌বলিয়ে। অনেকদিনের জমানো কথা। বাতাসে চুলগুলো মৃদু উড়ছিল। শেষ বিকেলের সোনালি আলোয় মাখামাখি সংগ্রামী এক হাস্যোজ্বল নারী আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমার অসম্ভব ভালো লাগছিলো। অদ্ভুত মায়াময় হাসি। এই হাসিটুকু হারিয়ে গিয়েছিলো তাঁর জীবন থেকে অনেকগুলো দিনের জন্যে।

 

তবুও মানুষ দুঃখ, কষ্ট, হতাশা শেষে অসীম মনোবলে ঘুরে দাঁড়ায়। ডুবে যেতে যেতে স্রোতের বিপরীতে যুদ্ধ করে করে কিনারে উঠে আসে। কষ্টগুলো নোনা জলে ভাসিয়ে দিয়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়। এটাই জীবন। পৃথিবীতে কারো জন্যেই কিছু থেমে থাকে না। শুধু একান্ত নিভৃত সময়টাতে গহীনের ক্ষতগুলো জেগে উঠে। থাকুক না কিছু কষ্ট নিভৃতে, একান্ত আপন হয়ে।

রিমি রুম্মান

৮ই ডিসেম্বর, ২০১৫

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

 

৪৯৮জন ৪৯৮জন

৩৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ