সাতঃ 
বড়ইতলা গ্রামটা একেবারে সীমান্তবর্তী। রাজশাহী শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে কিন্তু বেশ দূর্গম একটা এলাকা। একপাশ দিয়ে যাচ্ছে পদ্মা নদী। দারুণ সুন্দরও বটে। গ্রামটা খুবই ছোট। আর তাই আমিনুর রহমানের বাড়ি খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হয়নি।
 
পরিত্যক্ত একটা বাড়ি। আশেপাশের মানুষজনের সাথে কথা বলব ঠিক করলাম। বাড়ির সামনেই একটা চায়ের দোকান। দোকানদার লোকটা বেশ বৃদ্ধ। এর কাছে তথ্য পাওয়া যেতে পারে …
“ চাচা! সামনের বাড়ির আমিনুর রহমান কে চিনতেন? ” 
– হ্যাঁ চিনতাম।
“ ওনার কি হয়েছে? ” 
– কি আর হবে? মারা গেছে।
“ কবে? ” 
– প্রায় ৩০ বছর আগে।
“ কিভাবে? বয়স কত হয়েছিল? ” 
– আমরা সমবয়সীই ছিলাম। ছেলেপেলে শান্তি দেয় নাই। বাঁচবে কেমনে! আপনারা কারা ?
“ আমরা পুলিশের লোক। ” 
– পুলিশ কেন?
“ আমিনুর সাহেবের ছেলে আমজাদ রহমান, চিনেন? ” 
– ওই হারামি টা !!
“ মানে? ” 
– ওই হারামিটার জন্যই তো বাপটা মারা গেলো।
“ কিভাবে? দেখুন যা বলছেন একটু খুলে বলুন। ” 
– আমজাদ আমিনুরের বড় ছেলে। ডাক্তারি পাশ করে সে। আমিনুর তখন ছেলেকে এলাকার মাতবরের সাথে বিয়ে দিবে পরিকল্পনা করে। কিন্তু জোয়ান ছেলে তখন এক হিন্দু নার্সের প্রেমে পড়ে। তাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর আর কোন খবর জানি না। এ ঘটনার পর মাতবর আমিনুরের উপর চড়াও হয়। গরীব লোকটাকে একদম নিঃস্ব করে দেয়। ফলে মারা যায় সে। আর আমজাদের ছোটভাই আফজাল অনেক কষ্ট করে দিনমজুরি করে দিন কাটাত। সে মারা গেলে বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
 
তারমানে তিথীর মা হিন্দু ছিল। সম্ভবত দুই ধর্মের দুইজন বিয়ে করায় দুইদিক থেকেই ওর কোন আত্মীয় নেই। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার!
“ এ বাড়ির মালিক কে এখন? ” 
– আফজালের দুইজন ছেলে ছিল, আরিফ রহমান ও আবির রহমান।
“ তারা আসে এখানে? ”
– নাহ। বাবার মৃত্যুর পর তাদের আর এখানে দেখা যায়নি। শুনেছি দিনাজপুর চলে গেছে। ওদের নানাবাড়ি।
“ দিনাজপুরের কোথায় বলতে পারেন? ” 
– নাহ। কোন ধারণা নেই সে ব্যাপারে।
“ আচ্ছা অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ” 
তারমানে এখন আমাদের দিনাজপুর যেতে হবে। তিথীর দুই চাচাতো ভাইয়ের সাথে দেখা করতে হবে।
 
দিনাজপুর যেয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে কাঙ্খিত ঠিকানায় উপস্থিত হলাম। আফজাল রহমানের দুই ছেলের ছোটজন আবির আর তার মা কে পাওয়া গেলো। পরিচয় জানিয়ে আসার কারণ বললাম। শুনে ভীষণ অবাক হল তারা। আমজাদ রহমান আর তার স্ত্রীর নিখোঁজের ব্যাপারে কিছুই জানেন না তারা। এমনকি তাদের যে মেয়ে আছে সেটাও প্রথম জানলেন আমাদের কাছ থেকে।
 
“ কে হত্যা করতে চেয়েছিল তিথীকে বের করতে পেরেছেন? ” কিছুটা আতঙ্কিত গলাতে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রমহিলা।
– বুলবুল নামে এক সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী।
বলেই বুলবুলের ছবিটা বের করে দেখালাম ওনাকে।
 
এক মূহুর্ত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে থমকে রইলেন তিনি। তারপরই বিস্ফোরিত হল তার চোখ আর কণ্ঠ …
“ আরিফ !
অসম্ভব, স্যার। আমার ছেলে কিছুতেই এ কাজ করতে পারে না। ” 
ঘটনার আকস্মিকতায় আমরাও হতবাক। কি করতে এসে কি হয়ে গেলো। বুলবুলের আসল নাম ছিল একরামুল হক, যেটা এতবছর ধরে সবাই জেনে এসেছে সেটা আসলে অপরাধ জগতে প্রবেশ করার পরেই এই নাম হয়েছিল। তার পিতৃপ্রদত্ত আসল নাম কিন্তু কেউ বের করতে পারেনি সেটা বের হয়ে গেলো এত সহজে আর কাকতালীয়ভাবে!
ভাগ্য এত ভালো আমাদের !
আমাদের নিরুত্তর থাকাটা মহিলাকে আরও বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। উনি এখন কাঁদছেন। হতবিহবল ভাবটা সামলে নিয়ে বললাম,
“ দেখুন, আপনি কি নিশ্চিত আপনার ছেলে আরিফই আমাদের বুলবুল? ” 
– জ্বি স্যার। কোন সন্দেহ নেই এতে।
“ আমাদের কাছে বেশ জোরালো প্রমাণ আছে যে আপনার ছেলেই এই খুনটা করার চেষ্টা করেছিল। ”
– জানি না স্যার। আরিফ আসলেই অপরাধকাজের সাথে জড়িত, বছরদেড়েক আগেও সে এক আর্মি অফিসার খুন করে এসেছিল। কিন্তু সে তিথীকে কেন হত্যা করতে যাইবে? ও তো তার বোন! আত্মীয়ের ব্যাপারে আরিফ খুবই বিশ্বস্ত!
“ নিজের স্বার্থে আঘাত আসলেও … ? ” 
– জ্বি অফিসার। আমার ছেলেকে আমি চিনি। ও নিজের জীবন দিবে প্রয়োজনে কিন্তু আত্মীয়ের জন্য সর্বোচ্চটুকুই করবে।
“ ও কোথায় থাকে জানেন? ”
– এক এক সময় এক এক জায়গায় থাকে, বলেছে। তবে বগুড়ার শিবচর নামক জায়গায় ওর একটা বড় বাড়ি আছে নাকি! একদিন কথায় কথায় বলছিল যে জমিদার বাড়ি কিনেছে।
“ আপনাদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে? ”
– নাহ। কখনোই না। হয় সামনাসামনি নাহয় লোক মারফৎ।
“ এখানে লোক পাঠায়? ”
– হ্যাঁ। শামসু নামের একজনকে পাঠায় সবসময়।
“ আচ্ছা কোনভাবে যদি খবর পান বা তার লোক আসে বা সে নিজেই আসে তাহলে কি আমাদের জানাবেন? ”
– মা হলেও আমি চাইব সে যে অপরাধ করেছে তার শাস্তি হোক।
“ জ্বি অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ”
 
এবার তাহলে বগুড়া যাওয়ার পালা। অনেক সহজেই বুলবুল ওরফে আরিফের অবস্থান জেনে যাচ্ছি আমরা। ভাগ্য এত ভাল কেন হচ্ছে!
আর আরিফের মায়ের কথামত বুলবুল তিথীকে হত্যা করতে পারেই না!
তাহলে কি আমরা এতদিন ভুল মানুষের পিছনে ছুটে এসেছি তিথীর হত্যাকারী সন্দেহে!
“ স্যার! মহিলার কথা কি পুরাপুরি বিশ্বাস হয়? আমার তো হয় না। বুলবুলের আসল নাম ছিল একরামুল হক। ”
সঙ্গে থাকা সহকারী এসআই সাইফুলের প্রশ্ন।
– কেন? একরামুল হক নামটা এসেছে 
“ বুলবুল তিথীকে গুলি করেছে এটা পানির মত পরিষ্কার। ”
– তাই? কে বলল? আপনি দেখেছেন?
থমকে গেল লোকটা।
“ না মানে, আমরা তো এতদিন এটাই দেখেছি। ”
– আমাদের তো ভুলও হতে পারে!
“ মহিলার কথা ঠিক বলছেন? ”
– ছেলের ব্যাপারে মায়ের কথা দুনিয়ার অন্য সবার চেয়ে ঠিক। আর মহিলা স্বীকার করেছে যে ছেলে অপরাধ করেছে। এক্ষেত্রে আরিফ তিথীকে খুন করতে চেয়েছে এটা মনে হলে উনি সেটাও বলতেন। লুকানোর কিছু ছিল না এখানে।
“ তাও ঠিক। এখন কি হবে? ”
– কি আর হবে! বগুড়া যেতে হচ্ছে। দেখা যাক কি আছে ভাগ্যে।
আর ভাবতে ইচ্ছা হচ্ছে না। ভাগ্য যখন এতদূর নিয়ে এসেছে দেখা যাক এবার ভাগ্য আমাদের কোথায় নিয়ে যায়!
আটঃ 
বগুড়া রওনা দিয়েই ফোন করলাম বগুড়া জেলা সিআইডিকে। তাদের অনুরোধ করলাম সাদা পোশাকে পুলিশ যেন গোটা শিবচর এলাকাটা ঘিরে ফেলে এবং অনুসন্ধান চালিয়ে বের করে বুলবুলের বাড়ি কোনটা। আরামবাগের ঘটনা জানিয়ে সতর্কও করলাম।
তারা জানালো সাবধানতার সাথেই তারা বাড়িটা খুঁজে বের করবে আর নিশ্চিত হয়ে নিবে যে সেখানে বুলবুল আদৌ আছে কিনা!
প্রায় দেড়শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে আমাদের। সময় লাগবে প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা। অর্থাৎ বগুড়া সিআইডি তাদের অনুসন্ধানের জন্য বেশ সময় পাবে।
 
ঘণ্টা দুয়েক পরে ফোন আসলো বগুড়ার সিআইডি অফিসার সিনিয়র এএসপি আব্দুল মালেকের। জানালেন, আরিফ আহমেদ নামক ব্যক্তির বাড়ি তারা শনাক্ত করতে সম্ভব হয়েছেন। তবে গত দুই দিন আগে আরিফ নাকি সর্বশেষ এ বাড়িতে এসেছিল বলে খবর বের করতে পেরেছেন তারা। কিন্তু এ মূহুর্তে সে এখানে নেই। তারমানে আরো একবার আশার আলো দপ করে নিভে গেল! আর মাত্র ঘণ্টা দেড়েকের পথ, তাই এ খবর শুনেও সিদ্ধান্ত নিলাম যে বগুড়ায় গিয়ে বুলবুলের বাড়ি থেকে ঘুরে আসব। দেখা যাক ওর বাড়ি ওর ব্যাপারে কি তথ্য দেয়!
 
শিবচর এলাকাটা বেশ দূর্গম। সেখানে পৌঁছে বুলবুলের বাড়িটা দেখে বেশ অবাক হতে হল। পুরান আমলের বিশাল জমিদার বাড়ির কাঠামোর উপর আধুনিকতার প্রলেপ যেন অদ্ভুত ছবির মত এক সুন্দর বাড়ি সৃষ্টি করেছে। এলাকার লোকজন বাড়ির মালিকের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানে না। উত্তরাধিকার সূত্রে যে বাড়ির মালিক ছিল সে সপরিবারে আমেরিকাতে সেটেল হয়ে যাওয়ায় এই বাড়ি বিক্রি করে গেছে। তবে বুলবুলের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেল এলাকার পুলিশের এক ইনফর্মারের কাছ থেকে। লোকটা দাগী আসামী। এখন এলাকায় টুকটাক ব্যবসা করে আর ইনফর্মারের কাজ করে। তাকে বুলবুলের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতেই আবারো বললো যে দুই দিন আগে তাকে দেখেছিল সে। এরপরে কোন খবর জানে না। তবে বছর দেড়েক আগে নাকি এখানে এক বয়স্ক দম্পতি, সাথে তাদের মেয়ে নিয়ে এসেছিল। মাসখানেক আগ পর্যন্ত তারা এখানে ছিল।
 
চমকে উঠলাম আমি। সাথে সাথেই তিথী আর তার বাবা-মার ছবি বের করে দেখালাম। দেখে বললো যে এরাই নাকি থাকত এখানে!
কি অদ্ভুত ব্যাপার! কেন থাকত তারা এখানে? তাহলে কি তিথীর বাবা জেনে গিয়েছিলেন যে বুলবুল ওরফে আরিফ তার ভাতিজা। জানলেও কি এমন কারণ ছিল যে সপরিবারে ঢাকা ছেড়ে এসে পড়তে হবে এখানে!
ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। আর লোকটা বলছে যে মাসখানেক আগে তারা এলাকা ছেড়েছে তারমানে প্রায় একটানা দেড় বছরের কাছাকাছি সময় তারা এই এলাকাতেই ছিল! কিন্তু পুরো দুনিয়া ব্যাপারটা জানত না। কি এমন হয়েছিল যে এভাবে সবাইকে অন্ধকারে রেখে এরকম দূর্গম জায়গায়, এক ভয়ংকর অপরাধীর বাড়িতে এসে তাদেরকে থাকতে হবে!
 
পুরো বাড়ি তল্লাশি করে কিছুই পেলাম না। কিন্তু মনের মধ্যে কি যেন একটা খোঁচাচ্ছিল। কিছুতেই যাচ্ছিল না। আপাতত বাড়ি বন্ধ করার ও ২৪ ঘণ্টা পাহারা দিয়ে রাখার নির্দেশ দিলাম। বগুড়ায় এখন কিছু করার নেই। সুতরাং অহেতুক সময় নষ্ট না করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আমরা। ঢাকায় আসার পরেই ফোন আসলো মোবাইলে …
“ হ্যালো! এএসপি আব্দুল্লাহ বলছি। ”
– হ্যালো, আমি মেজর আকবর, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স!
“ জ্বি স্যার। বলেন। ”
মনে পড়লো মেজর আকবর ছিলেন বুলবুলের কেসের ইনচার্জ।
– আপনি নাকি বুলবুল ওরফে একরামুল হকের কেসের দায়িত্বে আছেন।
“ ইয়েস স্যার। একরামুল হক নয়, আরফ আহমেদ হচ্ছে বুলবুলের আসল নাম। ”
– ও বের করে ফেলেছেন! আমাদের এজেন্টরা দিন দুয়েক আগে নিশ্চিত হয়েছে যে একরামুল হক আসলে একজন ফেইক লোক, যাকে সৃষ্টি করে বুলবুলের কাভার তৈরি করা হয়েছে। যাই হোক, আপনারা তো বের করেই ফেলেছেন আসল পরিচয়টা। এবার যেটা জানেন না সেটা জানাই।
“ বলেন। ” হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে আমার!
 
“ আমাদের সোর্স বের করেছে যে ড্রাগমাফিয়ার জেনারেলের সাথে বুলবুলের বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। ”
– কি কারণে জানেন?
“ হ্যাঁ। আজিমপুরের ওখানে এক ডাক্তার নাকি জেনারেলের আরেক ব্যবসা যেটা ছিল কমবয়সী মেয়েদের অপহরণ করে এনে স্টেরয়েড দিয়ে দ্রুত বড় করে তাদের পাচার করা, সেটার বিরুদ্ধে কিভাবে যেন প্রমাণ যোগাড় করে ফেলেন। তবে সমস্যা হয় সেটা জেনারেল জেনে যায় এবং বুলবুলকে দায়িত্ব দেয় লোকটাকে সপরিবারে হত্যা করার। এরপর সেই পরিবার উধাও হয়ে যায়। ডাক্তারের মেয়ের নাম, আরিশা রহমান তিথী, এজেন্টরা বের করেছে ভার্সিটি লাইফে তার সাথে এক ছেলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল … ”
– জ্বি, তার নাম আব্দুল্লাহ। পুলিশের এএসপি, বর্তমানে কর্মরত আছে সহকারী পরিচালক, এডিএসইউ, বাংলাদেশ পুলিশ।
 
ওপাশ থেকে শব্দ করেই হাসলেন মেজর আকবর।
“ হ্যাঁ। একদম ঠিক বলেছেন। আমাদের এজেন্টরাও এটাই জানিয়েছে। তবে দিন চারেক আগে তিথীকে মতিঝিলে দেখে ফেলে জেনারেলের এক লোক। জেনারেলকে জানালে সে বুলবুলকে ধরে। এবং পরবর্তীতে বের হয়ে আসে যে বুলবুল আসলে ওই পরিবারকে হত্যা করেনি। বরং লুকিয়ে রেখেছিল। কারণটা অজানা আমাদের কাছে। যাই হোক এরপরেই শুরু হয় কোন্দল। বুলবুলের বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিতে পারেনি জেনারেল। বুলবুলকে সরিয়ে ফেলার হুকুম দেয়। কিন্তু এতদিনে বুলবুল প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। জেনারেলের লোকদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না বুলবুলকে ধরার। এজন্য জেনারেল এখন আপনাদের উপর নির্ভর করছে। আপনাদের মাধ্যমে সে এখন বুলবুলের কাছে পৌঁছতে চাচ্ছে। আর বলে রাখি, খুব গোপন সোর্সের খবর, শেয়ার করা উচিত না তারপরেও করছি নাহলে হয়তো আমার কথায় গুরুত্ব দিবেন না! জেনারেল এখন ঢাকায়। সুতরাং খুব সাবধানে থাকবেন আপনারা। আর যেভাবেই হোক বুলবুলকে বের করেন, জেনারেল তাহলে আপনাকে অনুসরণ করে বের হয়ে আসবে। আর আমরা তাকে অনুসরণ করব। ”
– জ্বি আচ্ছা। কিন্তু তিথীর বাবা-মা আছে কোথায়?
“ সেটা বলতে পারছি না। ”
– আপনাদের একটা তথ্য দিতে পারি যেটা আপনারা জানেন না।
“ কি? ”
– বুলবুলের আপন চাচা হচ্ছেন তিথীর বাবা। সম্ভবত সে কারণে তাদেরকে লুকিয়ে ফেলেছিল সে। বুলবুলের মায়ের ভাষ্যমতে তার সন্তান আত্মীয়দের ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল।
“ ও এই তাহলে কারণ। আর হ্যাঁ বুলবুল আসলেই আত্মীয়দের ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল। সে যে প্রথম ধরা পড়ে ছিনতাইয়ের জন্য, সেই ছিনতাইয়ের কারণ ছিল তার আত্মীয়ের অসুস্থতা। ”
– অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, স্যার।
“ আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। এখন থেকে ফোর্স ছাড়া মুভ করবেন না দয়া করে। আর কোন প্রয়োজন হলে বা যদি মনে হয় আমাদের সাহায্য দরকার সাথে সাথে ফোন করবেন। আমরা একসাথে কাজ করলে হয়তো এই জেনারেল কে বের করা যাবে! ”
– ইনশাল্লাহ, স্যার।
 
ফোনটা রেখে দিলেন মেজর আকবর। আমি ভাবছি সামান্য একটা ঘটনা কোথা থেকে কোথায় চলে আসল। তিথীর উপর হামলা তাহলে কে করেছিল প্রশ্নটা আবার আসে। আর বুলবুলই বা সে সময়ে ওখানে কি করছিল। নাহ এই কেস আগের মতই ধোঁয়ায় রয়ে গেছে আসলে। এখন পর্যন্ত যা বের হয়েছে সেটা কিছু প্রশ্নের জবাব দিলেও আসল রহস্যের ধারে কাছ দিয়েও যাচ্ছে না। তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে !!
চিন্তা করেই যাচ্ছি, কিন্তু মাথায় কিছু আসছে না। এবার কি তাহলে ভাগ্যও আর সাথে কাজ করবে না!
নয়ঃ 
অনেক ভেবে চিন্তা করেও কোন কুল পাওয়া যাচ্ছে না। কিভাবে পাওয়া যেতে পারে বুলবুলকে। আর তিথীর বাবা-মা’ই বা কোথায়! যেহেতু জেনারেলের সাথে বিরোধ চলছে তাহলে বুলবুল এমন কোন জায়গাতে থাকবে না যে জায়গার ব্যাপারে জেনারেল জানে। এমন কি কোন জায়গা আছে ? থাকলে কোথায় সেটা ?
আচ্ছা! জেনারেল কি জানে বুলবুলের মা-ভাইয়ের কথা? যদি জানে তাহলে কি তারা জেনারেলের কাছ থেকে নিরাপদ ?
নাহ ভাবতে ভাবতেই তো পাগল হয়ে যাব! কিন্তু এখন করব কি? আবার দিনাজপুর যাব। রেকর্ড বলে কাউকে ঘায়েল করার জন্য পরিবার জেনারেলের খুব পছন্দনীয় অস্ত্র। তাহলে কি বুলবুলের পরিবারের উপর একটা ভয়ংকর আঘাত আসতে চলেছে! কিন্তু বুলবুল কি এতই বোকা! সেও নিশ্চয়ই জানে যে জেনারেল কিভাবে আঘাত করতে পারে, সুতরাং সে নিশ্চয়ই তার পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে চাইবে! তাহলে বুলবুলের পরিবারকে ট্র্যাক করেও হয়তো বা বুলবুলের কাছে পৌঁছানো যাবে! আবার জেনারেল যদি বুলবুলের আগেই তার পরিবারের কাছে চলে যায় তাহলে তাকেও ধরা যাবে। সুতরাং আবারো যেতে হবে দিনাজপুর। এখন ঢাকায় বসে কোন কাজ নেই। তবে যাওয়ার আগে তিথীকে একবার দেখে যেতে হবে। মেয়েটা ৭ দিন ধরে কোমায়। আর ওর সিকিউরিটিও বাড়ানো দরকার।
 
দিনাজপুর রওনা দেওয়ার আগেই সেখানকার গোয়েন্দা পুলিশকে সতর্ক করে দিলাম যাতে বুলবুলের পরিবারের উপর কড়া নজরদারি করে। তাদের মোবাইল নাম্বারও ট্র্যাক করার জন্য টেকনিক্যাল ল্যাবকে নির্দেশ দিয়ে রাখলাম। সব আয়োজন শেষ করেই দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আশা করছি এবারও ভাগ্য সহায় হবে!
 
প্রায় ঘণ্টা তিনেক পর যখন সিরাজগঞ্জ অতিক্রম করছি তখনই দিনাজপুর পুলিশের কাছ থেকে মেসেজটা পেলাম।
“ এক লোক এসেছিল বুলবুলদের বাড়িতে। তার মিনিট বিশেক পর চলে গেছে। ”
ঠিক এক ঘণ্টার মাথায় মেসেজ পেলাম, “ বুলবুলের মা ও ভাই ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। ”
তারমানে কি বুলবুলই লোক পাঠিয়েছিল! সম্ভবত শামসু কে পাঠিয়েছে। বুলবুলের মা তো বলেছিল যে তাদের সাথে বুলবুলের ফোনে যোগাযোগ হয় না।
 
একটু পরেই টেকনিক্যাল ল্যাব থেকে ফোন আসলো …
“ স্যার! বুলবুলের মায়ের নাম্বার থেকে একটু আগেই একটা নাম্বারের সাথে প্রায় মিনিট বিশেক ধরে কথা হয়েছে। কলটা ট্রেস করে নেটওয়ার্ক টাওয়ারের লোকেশন হচ্ছে রাজশাহী জেলার সেনপাড়া ইউনিয়নে। ”
কি !! সেনপাড়া ইউনিয়ন! বড়ইতলা গ্রাম তো এই ইউনিয়নের অধীনেই। তাহলে কি বুলবুল তাদের সেই পরিত্যক্ত পৈতৃক বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছে? শামসুকে পাঠিয়ে সে নিজে ফোনে কথা বলেছে মায়ের সাথে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ এখন যে পরিস্থিতি তাতে লোক মারফৎ কেউ মায়ের সাথে কথা বলবে না। অথবা এমনও হতে পারে, বুলবুলের মায়ের সাথে তিথীর বাবা-মায়ের কথাও হয়েছে!
ড্রাইভারকে রাজশাহী যাওয়ার নির্দেশ দিলাম। এখন দিনাজপুর গিয়ে কাজ নেই।
 
বড়ইতলা গ্রামটা একদম সীমান্তবর্তী। রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। যে কারণে মাত্র শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূর হওয়া সত্ত্বেও গ্রামটা বেশ দূর্গম।
যাই হোক, গ্রামে পৌঁছে বুলবুলদের বাড়িটার দিকে যেতেই অবাক হয়ে গেলাম। আগে একদম পরিত্যক্ত বাড়িটার খুব বেশি উন্নতি হয়নি বটে কিন্তু বাড়ির বাইরে প্রায় ১৫-২০ জন লোককে দেখা যাচ্ছে। অনেকের কোমরেই চকচক করছে পিস্তল। বাড়ির সামনের যে চায়ের দোকানটা ছিল সেটাও দেখা যাচ্ছে না আর। দোকানদার চাচাকে অবশ্য গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের সামনে একটা ভ্যান নিয়ে চা বিক্রি করতে দেখলাম।
 
এবার অবশ্য আমাদের দেখে আর কথা বলতে রাজি হলেন না। খালি এতটুকুই বললেন,
“ এই বাড়ির মানুষ যে একদিন এমন হবে, কেউ ভাবতে পারিনি। ”
বুঝতে পারছি পুরা গ্রামেই বুলবুলের লোকেরা ছড়িয়ে আছে। আচ্ছা আমরা যে এসেছি এটা কি তারা টের পেয়েছে !!
হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে না। অবশ্য মাত্র দুজন এসেছি আমরা, টের পেলেও হয়তো গোণায় ধরছে না।
রাজশাহী এসেই ঢাকা থেকে অপারেশনাল ফোর্স পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলাম। তাদের আসতে সময় লাগবে বলে গ্রামে পৌঁছতেই রাজশাহী থেকে পুলিশ পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছিলাম। তারা রওনা হয়ে গিয়েছে। আপাতত তাদের আসার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। অবস্থা আর আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে না যে বুলবুল এত দ্রুত এখান থেকে মুভ করবে। বরং খুব সম্ভবত একটা দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তুলতে চাইবে সে।
 
এমন সময়েই মেসেজটা পেলাম দিনাজপুর পুলিশের কাছ থেকে …
“ শামসু নামের একজনের লাশ পাওয়া গিয়েছে। আর বুলবুলের মা ও ভাই রাজশাহী পৌঁছেছে। এখন নাকি নদী পার হচ্ছে! ”
শামসু মারা গিয়েছে। তারমানে জেনারেল পৌঁছে গিয়েছে তার কাছে! যাক বুলবুল একদম ঠিক সময়েই মা আর ভাইকে সরিয়ে নিতে পেরেছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে, শামসুর থেকে কি তথ্য বের করে নিতে পেরেছে জেনারেল!
আর যদি নিয়েই থাকে তাহলে কি সে এতক্ষণে রওনা দিয়ে দিয়েছে বড়ইতলা গ্রামটার উদ্দেশ্যে!
জেনারেল যদি এখন দলবল নিয়ে দিনাজপুর থেকে রওনা দিয়ে থাকে তাহলে হিসাব বলছে, সে এই বড়ইতলা গ্রামে আসবে রাত ১০-১১ টার ভিতরে। আবার আমাদের ইউনিটের অপারেশনাল ফোর্সও আসবে এই সময়ের আশেপাশেই। তাহলে কি এক ভয়ংকর ত্রিমুখী যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে সীমান্তবর্তী, দূর্গম, ছিমছাম ও নিশ্চুপ এই বড়ইতলা গ্রামটা!
(চলবে) 
৭৬১জন ৭৫৮জন
0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ