‘ডোরামাথা রাজহাঁস’ বা ‘বাদিহাঁস’ বা ‘রাজহাঁস’ Anatidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি জলচর পাখি। যার দৈর্ঘ্য আকারভেদে ৭২-৭৫ সে.মি. এবং ওজন দেড় কেজি থেকে প্রায় সোয়া তিন কেজি। এরা একটাই প্রজাতি এবং এদের কোনো উপপ্রজাতি নেই। এদের শরীর দেখতে অনেকটা ধূসর বর্ণের। সাদা মাথা থেকে সাদা একটি লাইন গলার নিচ পর্যন্ত নেমে গেছে। মাথায় দুটি কালো দাগ বা ডোরা দেখা যায়। যার জন্য এই পাখিটি ‘ডোরামাথা’ নামে পরিচিত। মাথা সাদা বর্ণের হয়। দেহ ফিকে সাদা রঙের। ডানার পালকের অগ্রভাবে কালো রঙ দেখা যায়। পুরুষ ও মেয়েপাখি দেখতে একই রকম। কোনো পার্থক্য নেই। এদের চোখ বাদামী। ঠোঁট হলুদ ও নাক কালো। পা ও পায়ের পাতা গাঢ় হলুদ বর্ণের। বাচ্চা ও অপ্রাপ্ত বয়সের রাজহাঁসের মাথায় কালো ডোরা দাগ নেই। কপাল সাদা এবং গাল ও গলা মলিন। পিঠ ও পেটের রঙ একই।
ডোরামাথা রাজহাঁস লতাপাতা ঘেরা জলাশয় ও সমুদ্র উপকূলীয় দ্বীপে এমনকি বড় বড় নদীর চরে বিচরণ করে। দলবদ্ধ হয়ে বাস করতে পছন্দ করে। এদের ঝাঁকে প্রায় ১০০টি পর্যন্ত রাজহাঁস থাকে। যদিও আমাদের দেশে নদীর চরগুলোতে ঝাঁকের সংখ্যা কম দেখা যায়। তবে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় এদের সংখ্যা অনেক। দলবদ্ধভাবে বিচরণ করতে পছন্দ করে। একা একা খুব কমই দেখা যায়। নদীর চরাঞ্চলে জেগে ওঠা চরে কৃষক যখন নতুন ধানের চারা রোপণ করে তখন এদের বিচরণ চোখে পড়ার মতো। এরা খুব সকালে ও সূর্য ডোবার আগে ধানক্ষেতে অবস্থান করে। দিনের বাকি সময় পানিতে ভাসে। এরা তীরের পাখি হিসেবেও পরিচিত।
কঁচি ঘাসের আগা ও ধানের চারা ও জলজ উদ্ভিদ এদের প্রধান খাবার। যার জন্য মাঝে মাঝে এরা চরাঞ্চলে কৃষকের ধানের জমিতে হানা দেয় খাবারের জন্য। মে থেকে জুন মাসের মধ্যে উঁচু জলাভূমিতে এরা প্রজনন করে থাকে। প্রজননের সময় নদী বা উপকূলের ধারে মাটিতে লতাপাতা দিয়ে বাসা বানিয়ে এক সঙ্গে ৩-৪টি ডিম দেয়। মেয়েপাখি একাই ডিমে তা দেয়। ৩০ দিনে ডিম থেকে বাচ্চা ফুঁটে বের হয়। বাবা ও মা উভয়ে মিলে বাচ্চা লালন-পালন করে।
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় ডোরামাথা রাজহাঁস হিমালয় পর্বতের চূড়া প্রায় ২৯০০০ হাজার ফুট উপর দিয়ে পারিযায়ী হয়ে আমাদের দেশে আসে। (যদিও এটি নিয়ে মতবিরোধ আছে।) তবে এটা সত্য যে, প্রকৃতিবিদ আর শারীরতাত্ত্বিকদের কাছে এ এক বিরাট প্রশ্ন। কেন ডোরামাথা রাজহাঁস হিমালয় পর্বতমালার কম উচ্চতার গিরিপথ দিয়ে না এসে এত বেশি উচ্চতা দিয়ে পরিযান করে? যেখানে অন্যসব পরিযায়ী পাখি অহরহ সেসব গিরিপথ ব্যবহার করে। আবার অনেকে মনে করেন এত উচ্চতায় অক্সিজেনও বা কীভাবে এরা সংগ্রহ করে? এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, এরা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার অন্যতম বাহক। কাক, দাঁড়কাক, শিয়াল, গাঙচিল ও সিন্ধু ঈগল প্রভৃতি এদের প্রধান শত্রু।
ডোরামাথা রাজহাঁস বাংলাদেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি। শীতকালে আমাদের দেশে উপকূলে ও রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ভোলা, সিরাজগঞ্জ ও হাওর এলাকায় দেখা যায়। এছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, সাইবেরিয়া, আফগানিস্তান ও চীনে এদের বিচরণ দেখা যায়।
বাংলা নাম: ডোরামাথা রাজহাঁস বা বাদিহাঁস বা রাজহাঁস।
ইংরেজি নাম: Bar-headed goose
বৈজ্ঞানিক নাম: Anser indica
ছবিগুলো মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ ও রাজশাহীর পদ্মার চর থেকে তুলা।
২৫টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
অবাক বিষয় জানলাম,
২৯০০০ ফট উপরে তো অক্সিজেন নেই!!
কেমনে কী!! কে জানে!!
শামীম চৌধুরী
অলিখিত ও অসমর্থিত সূ্ত্রে জানা যায় যে, এরা নাকি উড়ার আগেই ডানার ভিতর অক্সিজেন সংরক্ষন করে রাখে। এই কারনে একটি ঝাঁকে যদি দুই থেকে তিনশত পাখি থাকে তার মধ্যে প্রায় এক চুতুর্থাংশ পথে মারা যায়। বাকিটা উপরওয়ালাই ভালো জানেন।
ইঞ্জা
এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা, ওরে বাবা ভয় পেলাম ভাই।
অসাধারণ সব ইনফরমেশন, চমকপ্রদ হলো হিমালয়ের চুড়ার উপর দিয়ে আসা, এইটাই ভাবনায় ফেললো ভাই, দেখি এই বিষয়ে গুগল সার্চ করবো এখন।
শামীম চৌধুরী
এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জার বাহক হিসেবে কাজ করে শুনার পর থেকে গত তিন বছর যাবত এই পাখির ছবি তুলি না। কারন এই পাখির খুব কাছে যাওয়া যায়। খাবার খেলে আর উড়ে না। একই জায়গায় বসে থাকে ও গোসল করে। জ্বী ভাই গুগল বা উইকিপিডিয়াতে সার্চ দিলেই সব তথ্য পাবেন।
ইঞ্জা
না ভাই কাছে যাওয়ার দরকার নেই, দূরে দূরেই থাইকেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
ভালো লাগলো এমন এক রাজহাঁস জাতি সম্পর্কে জানতে পেরে। আমাদের আশেপাশে সচরাচর যেসব পালিত হাস/ রাজহাঁস দেখি, ওগুলোকে খুব বেশি উড়তে দেখিনা। একটু আধটু যাও উড়ে ,ওটাকে আকাশে উড়া বলা যাবেনা। আর এই রাজহাঁস দেড় থেকে তিন কেজি+ ওজন নিয়ে এতো উপর দিয়ে কিভাবে উড়ে,, এটা চরম বিস্ময়কর ব্যাপার !
শামীম চৌধুরী
এই ডোরা রাজহাঁসের গল্প আরো আছে। শুনলে অবাকই হতে হয় আপু।
জিসান শা ইকরাম
” আর এই রাজহাঁস দেড় থেকে তিন কেজি+ ওজন নিয়ে এতো উপর দিয়ে কিভাবে উড়ে,, এটা চরম বিস্ময়কর ব্যাপার ! ” — এই মন্তব্য করার ইচ্ছে ছিল আমারও, বাসায় এই মাত্র রাজহাঁসের এই ছবি দেখিয়ে আলাপ করছিলাম আমি।
শাহরিন
নতুন এক প্রজাতির হাস চিনলাম। অনেক ধন্যবাদ পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য।
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো আপনার জন্য।
শিরিন হক
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের অংশ পশুপাখি। আপনার এর প্রতি ভালোবাসা এবং মানুষের কাছে তা তঁলে ধরা সত্যি প্রসংসনীয়। আবারও নতুন কিছু জানলাম।ধন্যবাদ আপনাকে।
শামীম চৌধুরী
কষ্ট করে পড়ার জন্য কৃতজ্ঞ।
তৌহিদ
বাহ! অনেক কিছু জানলাম ভাই। আসলে প্রকৃতি তার নিজ মহিমায় সকল সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখেন। তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি সোনেলাকে সমৃদ্ধ করলো। ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ নয় তৌহিদ। এটা আমার ডিউটি সোনেলার জন্য।
তৌহিদ
ভালোবাসা জানবেন ভাইজান।
মোঃ মজিবর রহমান
এতো উপরে উঠে অবাক বিস্ময় ব্যাপার। জানলাম।
শামীম চৌধুরী
একমাত্র এই রাজহাঁস হিমালয়ের গিরি পথ ব্যাবহার না করে পর্বতের উপর দিয়ে উড়ে আসে। কেন আসে তা আজ পর্যন্ত গবেষকরা বের করতে পারেননি। আবার এদের ওজন দেড় থেকে সাড়ে তিন কেজি।
মোঃ মজিবর রহমান
অবশ্যই প্রকৃতির কোন কারণ থাকতে পারে ডোরামাথাহাস তাঁর সুবিধার কারনেই এতো উপর দিয়ে আসে।
আরজু মুক্তা
নতুন তথ্য,নতুন শিখার আনন্দ। ভালো লাগলো।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ আপু।
জিসান শা ইকরাম
ডোরামাথা রাজহাঁস সম্পর্কে জানলাম।
ধন্যবাদ আপনাকে।
হিমালয়ের উপর থেকে এরা উড়ে এদেশে আসে!
ভাবতে অবাকই লাগে আসলে।
শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
জ্বী ভাই, এটাই এদেরে চরিত্র।
শামীম চৌধুরী
সবাইকে ধন্যবাদ রাজহাঁস পাখিটি নিয়ে লেখাটি পড়ার জন্য। আশা করি যাদের পাখিটি সম্পর্কে ধারনা ছিলো না। উনাদেরকে একটা সম্যক ধারনা দিতে পেরেছি আমার এই ক্ষুদ্র চেষ্টায়। সবাই ভালো থাকুন। সোনেলার সাথে থাকুন।
তৌহিদ
আসলেই কিছু জানতামনা, আপনার লেখা পড়ে অনেক কিছু জানলাম।
হাফেজ আহমেদ রাশেদ
এতো উজন নিয়ে ওরা উরে বেড়ায় কীভাবে, আআশ্চর্য হলামও নতুন অনেক কিছু জানলাম,ধন্যবাদ জানবেন