অন্ধ বিশ্বাষে মানুষ চিরকালই অন্ধ। এই অন্ধ বিশ্বাস মানুষকে চিরকাল নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারের মুখোমুখি হতে বাধ্য করে। এবং এর প্রভাব পড়ে ব্যাক্তি মানুষটির উপর, পরিবারের উপর, সমাজের উপর, রাষ্ট্রের উপর।

মানুষ মাত্রই ধর্ম ভীরু। কিন্তু ধর্ম কখনোই মানুষের স্বাভাবিক চলার পথকে কঠিন করেনি। ধর্মীয় জীবন মানেই ইন্দ্রিয়গোচর জগতে বিশ্বাসী জীবন নয়। ধর্মীয় জীবন মানেই সহজ সরল যৌক্তিক জীবন বিধান। কিন্তু অযৌক্তিক অন্ধ বিশ্বাসই মানুষের এই সহজ সরল জীবনকে জটিল করে।

মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষকেই আল্লাহ্ সব কিছু বিচার বিবেচনা করার জ্ঞান দিয়েছে। কিন্তু অন্যের পাপ পূণ্য ও ভূত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্ঞান আল্লাহ্ কাউকেই দেননি। আমরা কখনোই মানতে চাইনা আমাদের জ্ঞান অতি সামান্য। আমরা হঠাৎ কারো বিপদ দেখলে, খুব সহজেই বলে ফেলি,”অমুক এই পাপ করেছিল বলে আজ এই অবস্থা”! কারো সন্তান অটিস্টিক হলে, কারো সন্তানের হঠাৎ বিপদ হলেই বলে, কি পাপ করেছিলো “? এই কথার মতো শেরেকি কথা আর হতেই পারে না। আর আল্লাহ্ শেরেকি করা মানুষকে কিছুতেই ভালোবাসে না, ক্ষমা তো করেনই না।

যারা লোক দেখানো নামাজ পড়ে, পর্দা করে, তাদের মতে যারা পর্দা বলতে বোরখা পরে না, বাস্তব ও যুক্তি সঙ্গত কথা বলে, তারা নামজই পড়ে না ! যা একেবারেই ভুল ধারনা।

ইসলামের পাঁচ রুকনের মধ্যে ইমান হল সর্ব প্রথম। আল্লাহর দরবারে মানুষের সেবা করাই হল সর্ব প্রথম ইবাদত। নামাজ তো অবশ্যই আছে। তবে তা লোক দেখানো নয়

আল্লাহর কাছে অন্যায় করলে আল্লাহ্ মাফ করে দেন। কিন্তু মানুষের ক্ষতি করে, মানুষের মনে কষ্ট দিলে আল্লাহ্ ও তা মাফ করেননা। আল্লাহ্ এ ব্যাপারে বলেছেন,” এক বান্দা অন্য বান্দার কাছে অন্যায় করলে, ঐ বান্দা মাফ না করা পর্যন্ত আমিও মাফ করতে পারি না”। মানুষ মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে দীর্ঘশ্বাষ ছাড়লেই সেইটা হয় অভিশাপ। মুখে অযথা অভিশাপ দিলে তা কোনো কাজেই আসে না। তা সে যতো বুজুর্গ ব্যাক্তিই হোন না কেন। যতোটুকু হাদিস মতে জেনেছি, নামাজ পড়লে এক ওয়াক্ত থেকে অন্য ওয়াক্ত পর্যন্ত নিজের অজান্তে করা ছোট ছোট ছগিরা গুনাহ মাফ হয়। কবিরা গুনাহ্ নয়।

সাধারণ মানুষগুলোকে ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে কিছু লোক দেখানো নামাজি, হাদিস জানা ওয়ালা লোক তাবিজের নামে ব্যাবসা করে যাচ্ছে। অন্যের হাতে দোয়া তাবিজে কখনোই রোগ সারে না। ভূত পেত্নীও বলে কিছু নেই। হ্যাঁ ধর্মীয় আমার বিশ্বাস মতে আমার মন অশান্ত হলে, শরীর খারাপ হলে আমি যেটুকু যা পারি নিজেই নিজের জন্য দোয়া চেয়ে আল্লাহর কাছে। সন্তানের জন্য, নিজের বাবা মা, স্বামীর জন্য আমার মন থেকে যে দোয়া বের হবে তা কি অন্য কারো কাছ থেকে বের হবে ?

আমি দেখেছি ওয়াজ মাহফিলের নামে এই সব ভন্ডরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ওয়াজ মাহফিলের উপর আমার কোনো দ্বিমত নেই। তবে দ্বিমত তখনই আছে যখন তা নারীর নামে বাজে কথা বলা হয়, দানের টাকার দাতার নাম উচ্চারন করে জোরে মারহাবা বলা হয়। ওয়াজ মাহফিল বলতে আমি বুঝি, সুন্দর সুন্দর হাদিস বলুন যা এই সব মানুষ জানে না, কীভাবে নামাজ পড়তে হয় তাই শিখান, নারীর নমনীয়তা নিয়ে বলুন, পর্দা কোথায় কীভাবে করতে হবে তা বলুন। সেই সাথে অবশ্যই বলুন, পুরুষের পর্দা নিয়েও। পুরুষের চোখে যেমন নারীকে পর্দা ছাড়া দেখে নাউজুবিল্লাহ বলে ফেলে, তেমনি কিছু পুরুষ যখন বেশরমের মতো খোলা আকাশের নীচে লোক সম্মুখে এস্তেন্জা করে, তা দেখতেও বড়ই বিদঘুটে লাগে। হ্যাঁ নামাজ পড়তে গেলে চল্লিশ কদম হাঁটতে হয় প্রস্রাব করার পর। তবে তা লোক সম্মুখে, খোলা আকাশের নীচে নয়।

পাবনা সুজানগরে থাকতে আমার বাসার দোতলাতে আসতেন ভারতের ফুরফুরা শরীফের হুজুর মানে পীর সাহেব। ওটা ছিলো “খানকা শরীফ”। খানকা শরীফ হল যেখানে পীর সাহেবরা এসে কিছুদিন থাকে। সেখান থেকেই তারা বিভিন্ন জায়গাতে ওয়াজ মাওফিল করে বেড়ায়। তো ঐ বাসাতে থাকতেই দেখেছি এর বাস্তব চিত্র। আমাদের ইসলাম ধর্মে নিজের বাবা মা ছাড়া অন্য কাউকে ধর্ম মা বাবা ডাক সম্পূর্ণ হারাম। তাই পীর সাহেব ও তার সহধর্মিনী অবশ্যই এই ডাকটা মেনে নিবেন না। কিন্তু স্বচোখে দেখা তারা সহজেই তা মেনে নিচ্ছেন। ফুরফুরা শরীফের পত্নীকে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো, তার সাথে আসা দুইজন সহযোগি মেয়েকেও দেখেছিলাম। তারা খুবই আধুনিক, ভ্রু প্লাক করা ছিলো দুজন সহযোগীরই। কিন্তু এদের খুবই সাদরে সেবা যত্ন করছে এই দেশীয় হুজুগে সেবকেরা। তারাই বলছে ভ্রু প্লাক করা হারাম। তবে আমি যদি হাদিস না জানি তবে কোনটা মানব ? তাদের চাপিয়ে দেয়া বিশ্বাস নাকি চোখে দেখা বিশ্বাস ? ঐ বাড়িতে নীচতলায় থাকার সুবাদে, পীর সাহেব ও তার জামাইকে চা খাওয়ানোর সুযোগ হয়েছিলো। কিন্তু এখানে কথা আছে, তাদের হিসেব মতে, তাদের অন্তত জানতে হবে চা টা কে তৈরি করলো ? সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে তো ! কারণ তারা বে নামাজী লোকের হাতে কিছুই খায় না। সেখানে দেখেছি ওয়িজ করতে এসে তারা এ দেশ থেকে কতো টাকা পয়সা উপঢৌকোন নিয়ে গেছে।

আমি তো একবার বিশাল ঝগড়ার হাত থেকে বেঁচে গেছি। ঘটনা হল এক মহিলা, সুজানগর থেকে ইশ্বরদী যাবে খানকা শরীফে ওয়াজ শুনতে। কিন্তু তার খুবই আক্ষেপ যে তার শাশুড়ি ও মা খুবই অসুস্থ এবং বিছনায়। তাদের জন্য সে যেতেই পারছে না। তাই বোনের বাড়ি রেখে আসবে। আমার মুখ আর আমার আয়ত্বে থাকল না। বলেই ফেললাম, ” খালা তোমার ইমান নষ্ট হয়ে গেলো, হাতে পায়ে মোজা পরে পর্দা করার কষ্টটাই বৃথা গেল। মায়ের সেবাটাই আগে করো, এসব ঘুরাঘুরি পরে করো”। কারণ কেউ মারাত্নক অসুস্থ থাকলে তার সেবা করতে নামাজও কাযা করা যায়”। আর যাবা কোথায় মহিলা কয়েকজনই আমার উপর খেপে ভুম। আমিও কম যাইনা যুক্তি ও হাদিস দিয়ে বুঝিয়ে ছাড়লাম। পর্দার আড়াল থেকে পীর সাহেবের জামাই এই ঝগড়ার বিচারের রায় আমার পক্ষেই দিল। মুন্সিবাড়ির মেয়ে হিসেবে যেটুকু জানি এসব হাদিসের আলোচনায় হারব কেন ?

বাস্তবতায় নিজের অভিজ্ঞতায় শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখেছি, মেয়েরা ও বাড়ির অন্য লক্ষি পক্ষি ধর্মিক পর্দানশীল বৌ মায়ের নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়লেও, মাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ায় না। কারণ হাসপাতালে নোংড়া, পবিত্রতা থাকে না , নামাজ হবে না, পর্দা নষ্ট হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। হায়রে তাদের পর্দা হায়রে তাদের মা, হায়রে তাদের ইমান! সেই মুহুর্তে দৌড়ায় বাড়ির বাস্তব বাদী বে পর্দা খামখেয়ালী বৌটা। তার হুসই থাকে না সেই মুহুর্তে বুকে তার ওড়না থাকল কিনা, পায়ে তার জুতা থাকল কিনা। কারণ সেই মানুষটিকে বাঁচানোই তার উদ্দেশ্য থাকে। এই পর্দানশীল ধার্মীক লোকদেখানো কিছু নামাজী লোকই মনে করে, এই বাস্তববাদী লোকগুলা নামাজ পড়ে না, আল্লাহর নামই নেয় না।আমি সেদিন জিসান ভাইকে সন্ধ্যার কিছু আগে একটা ব্যাপারে ফোন দিয়েছিলাম, তো দু একটা কথা বলার পর ভাইয়া বলল,” আপু নামাজ পড়বা না ? আমি এখন নামাজে পড়ব পরে কথা বলব।”। জিসান ভাই ধর্মীয় গোড়ামি নিয়ে কথা বলেছে বলে ধরেই নেবে এই লোক নামাজ পড়ে না, আল্লাহকে ভয় করে না ! আপনাদের খসড়া ভাইয়া আমার ভাবী, ও অনেক বাস্তববাদী, মুখের উপর যেটা সত্যি তাই বলে দেয়, কিন্তু ওকে আমি দেখেছি, ওর মন অশান্ত হলেই কোরআন শরীফ পড়ে, দোয়া পড়ে। অনেক গীতিকার নাট্যকার শিল্পী নামাজ পড়ে পাঁচ ওয়াক্ত। এসব তারা লোক দেখিয়ে করে না। তাই হুট করে একজনের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করা ঠিক না। এই কথাগুলো বললাম, কারণ গতকাল আমি এক গুনি শিল্পীর বাসায় গেছিলাম। উনি অসংখ্য গান লিখেছেন। শিল্পকলা একাডেমি থেকে ওনার  আছে  সন্মানন। উনি বেঁচে নেই। ওনার এক সন্তান আছে মানসিক প্রতিবন্ধী। খুব খারাপ লাগে মুর্খ কিছু মানুষ নামে জড় পদার্থরা যখন এদের দেখে পাপ পূণ্যের হিসেব করে। আমি জানি এই সব মূর্খদের মগজে এসব ঢুকবে না। কারণ তারা নিজেদের অনেক বড় মনিষী মনে করেন সামান্য জ্ঞান অর্জনের কারণে। কারণ তাদের এই জ্ঞান ইন্দ্রিয়গোচর। আর ইন্দ্রিয়গোচর জ্ঞান জগৎ মূলত অসত্য। আর অসত্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অর্জিত কোনো কিছুর মূল্যই থাকতে পারে না। সক্রেটিসের মতে, জ্ঞানকে অবশ্যই বুদ্ধি বা যুক্তিনির্ভর হতে হবে। ইন্দ্রিয়গুলো জ্ঞান সব সময়ই ব্যাক্তিগত, ভ্রান্তি সম্ভব এবং অনিশ্চিত যখন অন্যের জন্য ক্ষতিকর। একমাত্র যুক্তি নির্ভর জ্ঞানই নিশ্চিত এবং নিরপেক্ষ যা অন্যের জন্য কল্যাণকর। আর ইসলামের মূল কথাই হল, যুক্তি লব্ধ জ্ঞান যা সবার জন্যই কল্যাণকর। কিন্তু ভন্ড মুখোশধারী ধর্মের ব্যাবসায়ীরা আজ এই ইসলামকে ধ্বংস করতে তৎপর। তারা একটার পর একটা মিথ্যা যুক্তি দাঁড় করায়। আসলে অন্ধের কাছে যেমন কোনো রঙের অস্তিত্ব নেই, চক্ষুষ্মানের কাছে তার অস্তিত্ব আছে। অতএব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রং একজনের কাছে সত্য অন্য জনের কাছে নয়। কিন্তু সমান সমান সংখ্যার সাথে সমান সমান সংখ্যা যোগ করলে যোগফল সমানই হয়। এই সত্য কোনো ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করে না। এ সত্য বুদ্ধিগম্য, ব্যক্তি নিরপেক্ষ ও চিরসত্য।

তাই ধর্মের এই সামান্য জ্ঞান দিয়ে কাউকে বিচার করতে যাওয়া ঠিক নয়।

৬৫৭জন ৬৫৬জন

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ