আর মাত্র ক’দিন পরেই নিউইয়র্ক সিটির স্কুলগুলোয় গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হতে যাচ্ছে। সারা বছর পড়াশোনা, ঘড়ির সময় ধরে ঘুমোতে যাওয়া, এলার্মের শব্দে দিনের আলো ফোটার আগেই উঠে তৈরি হয়ে স্কুলের দিকে ছুটা, সবমিলিয়ে একটা রুটিন জীবন যাপন করতে হয় আমাদের। বছরের সব ঘুরে বেড়ানো, আনন্দ, দেশ বিদেশ বেড়াতে যাওয়া, সবই জমিয়ে রাখা হয় প্রতীক্ষিত এই দীর্ঘ দু’মাসের গ্রীষ্মকালীন ছুটির জন্যে। আমরা যেমন ছোটবেলায় অপেক্ষার প্রহর গুনতাম কবে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবে, কবে গ্রামে নানাবাড়ি দাদাবাড়ি বেড়াতে যাবো, অনেকটা তেমন। ছুটিতে কে কী করবেন, কিংবা কীভাবে ছুটির দিনগুলো উদযাপন করার পরিকল্পনা করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে আমার ছেলের সহপাঠী নোরার মা জানান, তিনি তার দেশ সুদূর আফ্রিকার ঘানায় সপরিবারে বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা করেছেন। সন্তানকে তার পূর্বপুরুষদের ভিটে দেখাতে নিয়ে যাবেন। ড্যানিয়েলের বাবা জানান, তিনি এবার তার কর্মস্থল থেকে ছুটি পাবেন না, বিধায় ছেলেকে সাঁতার শেখানোর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবেন, আর ছুটির দিনগুলোতে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে শহরের আশেপাশেই বীচে, ওয়াটার পার্কে, চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবেন। পাহাড়, লেক অথবা জঙ্গলের দিকে দিনভর বারবিকিউ করে সময় কাটাবেন বলে ভাবছেন। বিষয়টা চমৎকার। মনে পড়ে, আমার সন্তানের হাঁপানি সমস্যা নিয়ে আমি যখন পেডিয়াট্রিকসের কাছে যেতাম, তিনি সবসময় আমাকে উপদেশ দিতেন বাচ্চাদের সাঁতার শেখানোর বিষয়ে। নিজের সন্তানের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, সাঁতারে শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে ফুসফুসের সংকোচন-প্রসারণের ফলে এর কার্যক্ষমতা বাড়ে। এতে শিশুদের হাঁপানি নির্মূল হয়, কিংবা হাঁপানির ঝুঁকি কমায়। শুধু শারীরিক কারনেই নয়, মেধা বিকাশেও খেলাধুলা, সাঁতার জরুরি। তাই তো আমাদের সন্তানদের গ্রীষ্মের ছুটিতে সাঁতার শিখে নেয়াটা জরুরি। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজও এগিয়ে থাকলো।
আমার এক আত্মীয়কে জানি, যিনি প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে সন্তানদের নিয়ে দেশে বেড়াতে যান। স্থানীয় এক অভিজাত হোটেলের সুইমিং পুলে সন্তানদের সাতার শেখানোর কাজটিও সেরে নেন। এতে তাকে বেশ আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় যদিও, তবুও তিনি মনে করেন এটি তার সন্তানদের জন্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার ভাষায় দেশে নিয়মিত না গেলে তারা আত্মীয় পরিজনদের চিনবে না, তাদের কথা বুঝবে না এবং দেশের প্রতি মায়া, টান অনুভব করবে না। এতে ধিরে ধিরে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। আমার ছেলের নেপালি সহপাঠী তেনজিনের মা সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে দারুণ সিরিয়াস। তিনি জানান, গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি তার সন্তানকে কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। সামনের দিনগুলোতে ভালো স্কুলে সুযোগ পাবার বিষয়টি হাতছাড়া করতে নারাজ বলে। এ ছাড়াও এই গ্রীষ্মে বোটানিক্যাল গার্ডেন, মিউজিয়াম আর চিড়িয়াখানা ঘুরতে যাবার কথা ভাবছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষণীয় স্থানগুলোকে প্রাধান্য দিবেন। কেননা শুধু পড়াশুনা, কোচিং আর কুংফু ক্যরাতি ক্লাস করিয়ে সন্তানের ছুটির দিনগুলো বিভীষিকাময় করে তুলতে চান না তিনি। এদেশে খুব বেশিদিন হয়নি ইমিগ্রেন্ট হয়ে এসেছেন এমন চেনা এক বাংলাদেশি মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম সন্তানদের নিয়ে গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর পরিকল্পনার কথা। জানালেন, তাদের অঞ্চলভিত্তিক সংগঠনের বাৎসরিক পিকনিকে যাবেন একদিন। এর বাহিরে রোজ বিকেলে বাড়ির পাশের পার্কে যাবেন সন্তানদের নিয়ে। সময় কাটাবেন সন্ধ্যা অবধি। সন্তানরা সেখানে সমবয়েসি বন্ধুদের সাথে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আর আনন্দে ছুটোছুটি খেলবে। আর পার্কে আগত অন্য মায়েদের সাথে তারও গল্পে গল্পে সময়টা ভালো কাটবে। তার মতে, পরিবারের সকলের প্রযুক্তির বাইরে একসাথে সময় কাটানো, প্রাকৃতিক সাহচর্য আর নির্মল বাতাস আমাদের মানসিক স্থিতি তৈরি করবে, নিশ্চিত। মোট কথা, রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলা এই প্রবাস জীবনে গ্রীষ্মের ছুটি মানেই একরকম মানসিক স্বস্তি। সাধ্য অনুযায়ী সন্তানদের নিয়ে সুন্দর, আনন্দময় সময় কাটানোর প্রত্যাশা সকলেরই।
জীবনের এ বেলায় এসে আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, ছোটবেলার সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত কোনটি। আমি নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারবো, বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ছুটির দিনগুলোর কথা। কেননা, সারা বছরের সবচেয়ে আনন্দময়, মনে রাখার মতো মুহূর্তগুলো কাটতো সেই সময়টায়। বন্ধুদের সাথে গোল্লাছুট কিংবা ছুটোছুটি খেলে, গল্পের বই পড়ে, ঘন্টার পর ঘন্টা অবিরাম ঘুড়ি উড়িয়ে কিংবা দিনভর ভাইবোনেরা একে অপরের সাথে খুনসুটি করে। প্রবাসে আমাদের এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের সময় নিয়ে জানতে চাইলে তারাও একবাক্যে বলে উঠে সামার ভেকেশনের কথা। কিন্তু আমাদের সাথে তাদের সময় কাটানোর মাধ্যমের বিস্তর ফারাক। তাদের সময় কাটানোর বিষয়াদি ভিন্ন। ফেসবুক, কম্পিউটার গেমস, ভিডিও গেমস দখল করে নিয়েছে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সব আনন্দ। ওরা প্রকাণ্ড সব বৃক্ষের উপর দোল খাওয়া মাতাল বাতাসের হাহাকার দেখে না। দেখে না চৈত্রের খাঁখাঁ দুপুরের নিস্তব্দতা, উড়ে যাওয়া পাখি কিংবা হ্রদের সবুজ জলরাশি। আর তাই প্রতি বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা বন্ধুরা সপরিবারে তল্পিতল্পা সহ কয়দিনের জন্যে বেড়িয়ে পড়ি দূর দূরান্তে। নেট ঘেঁটে দর্শনীয় স্থান নির্ধারণ করি। কখনো সবুজ প্রকৃতিতে, পাহাড়ে কিংবা হ্রদের কাছাকাছি কোথাও যেখানে বুক ভরে শ্বাস নেয়া যায়। কখনোবা আধুনিক সব রাইড কিংবা খেলার উপকরণ আছে এমন জায়গা খুঁজে বের করে বেরিয়ে পড়ি ছুটির দিনগুলোতে সন্তানদের নির্মল আনন্দ দিতে। সাথে থাকে বন্ধুদের সন্তানরা। এতে করে তারা একে অপরের সাথে মেলামেশা আর খেলাধুলার সুযোগ পায়। সবাই মিলে একটি বিশাল পরিবার হয়ে উঠি আমরা। যেন এই দূরদেশে একান্নবর্তী কোন পরিবার। আমার ধারণা, এই যে শৈশবের ছোট ছোট সুখস্মৃতি, এইসব আমার সন্তানদের পরবর্তী জীবনে নানান চড়াই উৎরাইয়ের সময়গুলোতে বিষাদগ্রস্ততা থেকে টেনে তুলতে সাহায্য করবে। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে সাধ্য অনুযায়ী বাবা আমাদের এখানে ওখানে ঘুরতে নিয়ে যেতেন। কাপ্তাই, রাঙামাটি, কক্সবাজার সহ দেশের ভেতরেই ঘুরিয়ে দেখাতেন। নিদেনপক্ষে গ্রামে, দাদার বাড়ি কিংবা নানার বাড়ি। ছুটির দিনগুলোতে বাবা আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাবেন, সেই আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে আমরা লেখাপড়ায়, ভালো ফলাফল করতে মনোযোগী হতাম। অবশেষে প্রতীক্ষিত দিন ঘনিয়ে এলে আমাদের আনন্দের সীমা থাকতো না। কয়দিন বেড়িয়ে যখন বাড়ি ফিরে আসতাম, একবুক প্রশান্তিতে ভরে থাকতো মন। সুখময় সেইসব স্মৃতি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নতুন উদ্দামে নতুন বছরের পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠতাম।
১০টি মন্তব্য
মাসুদ চয়ন
ভালো লিখেছেন।গল্পের চিত্রপট গভীর বোধসম্পন।
রিমি রুম্মান
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
শিরিন হক
খুব ভালো লিখেছেন। বার্ষিক পরীক্ষা ও কবে আসবে আগে নিজে ছোটবেলায় ভাবতাম এখন ছেলের জন্য ভাবি। একদিন আর বসে থাকিনা আমরা।
জিসান শা ইকরাম
গ্রীষ্মের ছুটির জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।
নির্মল আনন্দ থাকত সে সব ছুটিকালীন দিনগুলোতে।
আজকাল সে নির্মল আনন্দ দখল করে নিয়েছে গেমস আর ফেইসবুক।
বর্তমান প্রজন্ম জানেই না আসল আনন্দ কি।
প্রবাসে ভাল থেকো দিদি ভাই।
প্রদীপ চক্রবর্তী
গ্রীষ্মের ছুটির নির্মল আনন্দ আজ আর নেই।
যা ধূসর দর্পণে হেম!
..
ভালো লেখনী দিদি।
ছাইরাছ হেলাল
সেই ছুটি আর ছুটি নেই, কোচিংয়ের পেছনে ভাগ-দৌড়।
নিতাই বাবু
আমি চাকরিজীবী। তাই ছুটি বলতে বাৎসরিক দুই ঈদে ৩দিন করে ছয়দিন ছুটু পেয়ে থাকি। ছুটি পেলেই চলে যাই মেয়ের বাড়িতে। থাকি নাতি নাতিনদের সান্নিধ্যে। ঘুরে বেড়াই গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে। কখনো বা ধান ক্ষেতের আইল ধরে। ছুটি শেষ হলে আবার ছুটে আসি ইট- পাটকলে গড়া শহরে।
কিন্তু এর আগে স্কুল জীবনের ছুটির স্বাদই ছিল আলাদা! সেই স্বাদ এখনকার সময়ের ছুটির স্বাদের সাথে মেলে না। ভিন্নতা রয়েই যায়!
সাবিনা ইয়াসমিন
স্কুল জীবনের যেকোনো ছুটিই আনন্দদায়ক হতো। লম্বা ছুটির বেলায়তো কোনো কথাই নেই। আমাদের সেইদিন গুলো এখন স্মৃতি। এখনকার বাচ্চারাও ছুটি উপভোগ করে, তাদের নিজস্ব সময় অনুসারে। পড়া-লেখা খুববেশি প্রতিযোগিতা মূলক হয়ে যাবার কারনে তারা আমাদের সময়ের মতো আনন্দ উপভোগ করতে পারেনা। তবে তাদের এই সময়টা বা ছুটির আনন্দ কেমন/কতটা ছিলো তা জানা যাবে তারা বড় হয়ে যাবার পর, তাদের স্মৃতিবার্তায়।
ভালো থাকবেন আপু, শুভ কামনা ❤❤
ইঞ্জা
আপু স্মৃতিকাতর হলাম, আজকালকার শিশুরা ভিডিও গেইমস, ক্যাবল টিভি নিয়েই পড়ে থাকে অথচ আমরা সেই সময় খেলাধু, দাদা বাড়ী, নানা বাড়ী সহ কতো জায়গাতেই না ঘুরতে যেতাম, যেখানে আনন্দ উল্লাসে সময়টা কাটতো।
খুব সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন লেখা দিলেন আপু, ধন্যবাদ।
শামীম চৌধুরী
খুব সুন্দর একটি গল্প পড়লাম। ভালো লাগলো।