একসম ঢাকা মিরপুর ১১ নম্বর একটি টেক্সটাইল মিলে চাকরি করতাম। একদিন শুক্রবার বিকালবেলা মিলের অনেকেই অনেক স্থানে বেড়াতে বেরিয়ে গেছে। আমি অন্য কোথাও না গিয়ে, গেলাম চিড়িয়াখানায়। চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করার টিকেট সংগ্রহ করে ঢুকলাম চিড়িয়াখানার ভেতরে। হরিণ দেখছি, জিরাফ দেখছি, সাপ দেখছি, ভাল্লুক দেখছি, উল্লুকও দেখছি! এরপর গেলাম চিতাবাঘের খাঁচার কাছে। দেখলাম চিতাবাঘ! শেষমেশ গেলাম রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামের বাঘের খাঁচার কাছে। হলুদের রঙের মাঝে কালো ডোরাকাটা বাঘ! যখন বাঘের খাঁচার সামনে গেলাম, বাঘ তখন খাঁচার ভেতর এক জায়গায় একাকী শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।
এমন সময় আমার সামনে দাঁড়িয়ে একজন ভদ্রলোক তাঁর ছোট শিশুটিকে তর্জনী উঁচিয়ে বললো, “ঐযে দেখ, আমাদের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার!” ভদ্রলোকের কথা শুনে একা একাই ভাবতে লাগলাম। আর নিজে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা, আমাদের দেশে এতো এতো পশু থাকতে, বনের হিংস্র পশু বাঘকে জাতীয় খেতাব দেওয়া হলো কেন? বাঘের কাছ থেকে কি ঘুষ নেওয়া হয়েছিল? নাহয় এই বাঘকে কেন রাষ্ট্রীয় বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হলো? এসবের উত্তর কিছুতেই মেলাতে পারিনি! তবুও ভাবছি!
ভাবতে লাগলাম! যেই হিংস্র পশুর নাম শুনলে এমনিতেই গায়ে কাটা ধরে! মনের ভেতরে লাগে ভয়! যেই বাঘের সামনে কেউ কখনো যেতে পারে না। যদিও আচমকা কেউ কখনো বাঘের সামনে পড়ে, তাহলে তাঁর আর রক্ষা নেই! হয়তো আহত, নাহয় নিহত! যারা এজাতীয় বাঘকে সম্মান করে জাতীয় উপাধি বা খেতাব দিয়েছে, তাঁরাও যদি বাঘের সামনে কখনো যায়, তো রক্ষা নেই! আর এই জাতীয় বাঘ দিয়ে আমাদের দেশের জনগণের একটা টাকাও আয় রোজগার হচ্ছে বলে মনে হয় না! বরং এই বাঘ রক্ষা করতে গিয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে অনেক অনেক অর্থকড়ি ব্যয় হয়। সময়সময় এই বাঘের আক্রমণে বাঘ রক্ষাকারী বনবিভাগের অনেকের জীবননাশও হয়ে যায়। অনেকসময় বাঘ সুন্দরবনের গহীন জঙ্গল থেকে লোকালয়ে ঢুকে অনেক মানুষকে আক্রমণও করে। সময়সময় বাঘের উৎপাতে সুন্দরবন ঘেঁষা মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। অথচ এই হিংস্র পশু বাঘকে দেওয়া হলো বিশেষ সম্মাননায় জাতীয় খেতাব, ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’।
আমার মতে এই হিংস্র পশু বাঘকে জাতীয় উপাধি বা খেতাব না দিয়ে, গৃহপালিত পশু গরুকে দিলে মনে হয় ভালো হতো! কারণ, এই পশুটি পৃথিবী সৃষ্টিলগ্ন থেকে আমাদের জীবনের সাথে মিশে আছে। যে প্রাণীটি আমাদের সবচেয়ে কাছে থাকে এবং বেশি উপকার করে থাকে তার নাম হলো গরু। এ প্রাণী খুব শান্তশিষ্ট ও অত্যন্ত নিরীহ। বাঘের মতো হিংস্র নয়!
এই পশুটি নীরবে-নিবৃতে সবার উপকারই করে আসছে। তা এই পৃথিবী নামক গ্রহটির সব মানুষেই জানে। জানা যায় এই প্রানীটিও নাকি একসময় বন্যই ছিল। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে নিতান্ত প্রয়োজনের তাগিদেই গুরুকে কাছে টেনে এনেছে। আর তখন থেকেই গরু গৃহপালিত পশু হিসেবে আমাদের ভালোবাসা কেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই গৃহপালিত পশু গরু আমাদের অর্থনীতিতেও বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে।
পৃথিবীতে থাকা অন্যসব বন্য পশুর তুলনায় গরু সবচেয়ে উপকারী পশু। গরুর দুধ অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। এই দুধ অনেক সময় মানবশিশুর মায়ের দুধের অভাব পূরণ করে। যেমন– ছোটবেলা কোনও শিশুর মা মারা গেলে সেই শিশুটি গরুর দুধ পান করেই বাঁচতে পারে। তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী গুরুকে মাতৃরূপে পূজাও করে থাকে। গরুর দুধ থেকে দই, ছানা, মাখন, ঘি, পনির, ক্ষীর ও নানা রকম মিষ্টি তৈরি হয়। বড়বড় ডাক্তার বাবুরা বলে, স্বাস্থ্যের জন্য নাকি এগুলোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। গরুর মাংস একটি উপাদেয় ও বলকারক খাবার। আবার মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ঈদুল-আযহায় লক্ষ টাকা দিয়ে এই পশুটিকে বাজার থেকে কিনে নেয়। তারপর খুবই আদরযত্ন সহকারে মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য পশুটিকে কোরবানি করা হয়।
তা ছাড়া, গরুর গোবর একটি উত্তম সার। অনেকে আবার গোবর শুঁকিয়ে ঘুঁটে তৈরি করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। গরুর চামড়া দিয়ে জুতা, ব্যাগ, সুটকেস, বাক্স তৈরি হয়। শিং ও খুর দিয়ে শিরিষ আঠা তৈরি হয়। হাড় থেকে তৈরি হয় বোতাম ও চিরুনি। হাড়ের গুঁড়ো একটি উত্তম সার। ষাঁড় ও বলদ লাঙল, গাড়ি ইত্যাদি টানে। আগেকার সময় আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে পাবলিক পরিবহণ বলতে গুরুর গাড়িই ছিল। সেসব গরু গাড়ি দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মালামালও আনা-নেওয়া হতো। এখনো আমাদের দেশের ৬৮ হাজার গ্রামের মধ্যে অনেক গ্রামের কৃষকরা জমি ও মইয়ের জন্যে গরুর উপরই নির্ভরশীল। এখনো তাঁরা জমি চাষাবাদের জন্য গরু ছাড়া আর কিছুর কল্পনাই করতে পারে না। গরুর এতো অবদানের পরও গৃহপালিত এই পশু গরুকে জাতীয় উপাধি বা খেতাব না দিয়ে জাতীয় খেতাব দিলো বনের হিংস্র পশু বাঘকে। গরু নিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে নিজে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, গৃহপালিত পশু গরুকে বাদ দিয়ে বনের হিংস্র পশু বাঘকে জাতীয় খেতাম দিলো কেন? কিন্তু কোনও সদুত্তর পেলাম না! দুঃখ শুধু এখানেই থেকে গেল।
লেখা একান্ত অনুভূতি থেকে।
ছবি সংগ্রহ ইন্টারনেট থেকে।
১৫টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
দুধে যতই ভিটামিন থাকুক, বাঘ আমাদের চাই ই।
উপস্থাপন কিন্তু সুন্দর হইছে!
নিতাই বাবু
বাঘ থাকুক সুন্দরবনে সুন্দরভাবে। আমি চাই গরুর কৃতিত্ব। এই পশুটি আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে মেশা। ওর দ্বারা অনেক উপকারও হয়। কিন্তু বাঘ দিয়ে চার আনার উপকারও হয় না।
জিসান শা ইকরাম
গরুর উপকারীতা এত! একসাথে এত উপকারীতা আগে ভাবিনি।
বাঘের তেজ দেখেই সম্ভবত একে জাতীয় পশু করা হয়েছে।
যুক্তিপুর্ন ভিন্ন চিন্তার লেখাটি অত্যন্ত ভাল লেগেছে।
নিতাই বাবু
ভালো লেগেছে শুনে আমি আনন্দিত হলাম, শ্রদ্ধেয় দাদা। ভালো থাকবেন আশা করি।
জিসান শা ইকরাম
আপনিও ভালো থাকবেন।
নতুন লেখা চাই।
মোঃ মজিবর রহমান
দারুন বললেন দাদা। খুব ভিন্ন ধাচে লেখা।
নিতাই বাবু
ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় মজিবর দাদা। আশা করি ভালো থাকবেন।
তৌহিদ
বিষয়টি কিন্তু ভাবনার, আসলেইতো! বাঘ জাতীয় পশু কেন? গরু নয় কেন? অথচ গরু কত উপকারী প্রাণী।
সুন্দর বর্ণনা করেছেন দাদা।
নিতাই বাবু
আসলে এই পৃথিবীর বিত্তবানরা কোনও সময়ও গরিব মানুষের সহ্য করতে পারে না। তাই এই সমাজে যারা বিচার বিশ্লেষ, তাঁরা ছোট-ব, ধনী-গরিবদের ব্যবধান খুঁজে। এই জাতীয় খেতাব দেবার সময়ও গরি ও নিরীহ পশু গরুকে ঘৃণা করে শক্তিশালী হিংস্র পশু বাঘকে বেছে নিয়েছে। এতেই প্রমাণ হয় যে, গরিব, নিরীহ, দুর্ব, অসিহায়দের কোনও দাম নেই, মূল্যও নেই।
তৌহিদ
শুভকামনা জানবেন দাদা
মনির হোসেন মমি
চমৎকার আরেকটি লেখা পেলাম।আসলে এর উত্তরই দিতে পারবেন যারা এরে জাতীয় পশুর উপাদি দিল।তবে হ্যা সম্ভবত বনের রাজা সৌন্দর্য এবং সুন্দরবনের কারনে হয়তো তাকে জাতীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়।আর আপনার যুক্তিটাও মন্দ নয়।লিখতে থাকুন।
নিতাই বাবু
শ্রদ্ধেয় মনির দাদা, আসলে এই পৃথিবীর বিত্তবানরা কোনও সময়ও গরিব মানুষের সহ্য করতে পারে না। তাই এই সমাজে যারা বিচার বিশ্লেষক, তাঁরা ছোট-বড়, ধনী-গরিবদের ব্যবধান খুঁজে। এই জাতীয় খেতাব দেবার সময়ও গরি ও নিরীহ পশু গরুকে ঘৃণা করে শক্তিশালী হিংস্র পশু বাঘকে বেছে নিয়েছে। এতেই প্রমাণ হয় যে, গরিব, নিরীহ, দুর্বল, অসিহায়দের কোনও দাম নেই, মূল্যও নেই।
সঞ্জয় মালাকার
যুক্তিপূর্ণ ভিন্ন চিন্তার লেখাটি অনেক ভালোলেগেছে।
নিতাই বাবু
ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় দাদা। আশা করি ভালো থাকবেন।
সঞ্জয় মালাকার
ধন্যবাদ ভাইয়া আপনি-ও ভালোথাকবে
শুভ কামনা রই।