“সুখের আকাশে বিষাদ রাত” বইটি বেরুলো যেদিন, সেদিন আমার বড় মামী আমাদের ছেড়ে চলে যান ধরা-ছোঁয়া’র বাইরে অন্য এক জগতে। ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন দীর্ঘদিন। শুনেছি, দীর্ঘ রোগ ভোগের পর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতর মানুষেরা জীবনের প্রতি, বেঁচে থাকবার প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আমার মামী সব যন্ত্রণা সয়েও তীব্রভাবে বেঁচে থাকতে চাইতেন। প্রতিটি ভোরে চোখ মেলে আনন্দে সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতেন আরও একটি ভোর পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছেন বলে।
প্রথম বই বের হবার সুসংবাদ আমার আর স্বজনদের জানানো হয়নি। প্রকাশের দ্বিতীয় দিনেই আমার মফঃস্বল শহর চাঁদপুরের “তাজমহল” লাইব্রেরী পঞ্চাশ কপি বই নিয়ে যায়। যে শহরে আমার জন্ম, বেড়ে উঠা, সেই শহরে তখন একুশের বইমেলা চলছিলো। সেই মেলায় আমার লেখা বই ! আমার সীমাহীন আনন্দে থাকবার কথা। কেননা, সেই শহরের প্রতিটি ইট-পাথর, ধূলিকণা আমার চেনা। আমার অতি আপন। কিন্তু আমি সমস্ত দিন বিষাদে ডুবে থাকলাম। নির্ঘুম রাত কাটালাম।
২০১২ তে মায়ের মৃত্যুর পর পাগলের মতন দেশে ছুটে যাওয়া আমার বুকভরা শূন্যতার দিনে আপার বাসায় ছুটে এসেছিলেন বড় মামী। কষ্টকর, যন্ত্রণাদায়ক কেমোথেরাপি ্নেয়া, প্রতিনিয়ত যমের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষটি এতোটা পথ পেড়িয়ে, পাঁচতলার সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলেন ! এসে আমায় জড়িয়ে ধরলেন যখন, তাঁর দুর্বল দেহের কাঁপুনি, হৃদস্পন্দন আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম। ধরে সোফায় বসিয়ে দিতে দিতে ক্ষোভে, অভিমানে বলি, এই শরীরে এভাবে আসা মোটেই ঠিক হয়নি। তিনি দু’চোখ মুছলেন। অনেক আবেগে, কৃতজ্ঞতায় বললেন, “দুঃসময়ের দিনে যে উপকারটুকু করলে, আমি কোনদিন তোমার ঋণ শোধ করতে পারবো না”। আমার আর বলা হয়নি, বিদেশে আসবার আগে আমার ভীষণ দুর্দিনে তিনি যে এগিয়ে এসেছিলেন, সেকথা আমি প্রতিনিয়ত স্মরণ করি।
২০১৩ তে আবারো দেশে গেলে অন্যবারের মতই সব আত্মীয়ের বাসায় যাই। দেখা করি। তেমনি মামার কল্যাণপুরের বাড়িটিতেও যাই। সেসময়ে মামী ব্যথাতুর এক জীবনের নিভুনিভু প্রাণটুকু নিয়ে শুয়ে। আমায় দেখে উঠলেন। ডায়নিং টেবিলে একসাথে বসে আমরা সন্ধ্যাকালীন খাবার খেলাম। বেশীক্ষণ বসে থাকতে পারলেন না। বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকলেন। ঘর ভর্তি আমার কাজিন’রা। অনেকদিন পর আমার যাওয়াকে ঘিরে সবার এক হওয়া। সেই প্রথম ভাই-বোনদের মাঝে থেকেও আমার এতটুকু উচ্ছ্বাস হয়নি। ভেতরে ভেতরে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিলাম এই ভেবে__ এই যে আমি ফিরে যাবো, আর তো কোনদিন দেখা হবে না। আর তো এমন মমতায়, ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরা হবে না।
সেদিন অনেক কোলাহল মুখর বাড়িটিতে আমার মাঝে ভীষণ এক নৈঃশব্দ্য নেমে আসে। অসহায় আমি মামীর পাশে গিয়ে বসি। তিনি ইশারায় আরও কাছে যেতে বললেন। আরেকটু গা ঘেঁসে বসলে গালের সাথে গাল লাগিয়ে রাখেন ক্ষণিক।আমি স্পষ্টতই নোনা জল গড়িয়ে যাওয়া টের পাচ্ছিলাম। তিনি একটু শ্বাস নিয়ে বললেন, “আমি তোমার ঋণ কোনদিনই শোধ করতে পারবো না, আমায় ক্ষমা করে দিও”। আমি হাত দুটো চেপে ধরি শুধু। আমরা দু’জন প্রাণী রুমটিতে। আমাদের দু’জনেরই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়। আমার সেদিনও বলা হয়নি__ একদিন এই আপনিই আমার দুর্দিনে পাশে ছিলেন, ঋণী তো আমিই। আমি অধম কৃতজ্ঞতাবোধ কিংবা ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে পারি না।
প্রতিবারের মতই পা ছুঁয়ে সালাম করি বিদায়ের সময়। কিন্তু প্রতিবারের মতন এবার আর তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি। শুধু চোখের কোন বেয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। বালিস ভিজে যাচ্ছিলো।
মামনী নেই আজ প্রায় দু’সপ্তাহ হয়। আমি আমার মাতৃহারা বোনগুলোর খবর লই নি। একটিবার ফোন করে সান্ত্বনার বানী শুনাইনি।আমি অথর্ব কখনোই কাউকে সান্ত্বনাও দিতে পারিনা।
বইমেলায় আমার বইটি মাত্র নয় দিন সময় পেয়েছে। শেষ দিন স্টলের সব বই শেষ। সালমা মনি আপু বই কিভাবে পেতে পারে জানতে চাইলেন। লেখাটি যখন লিখছি, তখন আমার প্রকাশক এর মেসেজ ভেসে উঠলো স্ক্রিনে__ “আজ একজন ফোন করেছিলো, ২০ কপি নিবে”। একজন নতুন লেখকের বই এতটা ভালবাসবে মানুষ, জানা ছিল না। এতসব ভালোবাসায় আমার অনেক ভাল থাকবার কথা। কিন্তু ওই যে, বইটির ভুমিকায় লিখেছিলাম__
“প্রতিনিয়ত অনেক ভাল থাকা সময়গুলোতেও আচ্মকা বিষাদ নেমে আসে। সেইসব বিষাদ সকলের অগোচরে ভেতরটা আর্দ্র করে তোলে। কখনো বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস নামায়। যেমনটি ঝকঝকে নীলাকাশে হঠাৎ খণ্ডখণ্ড কালো মেঘ জমে, বৃষ্টি ঝরায়।এভাবেই এগিয়ে যায় জীবন ক্রমশ সমাপ্তির দিকে”…
হুম… প্রিয় সোনেলা’ , আমার সুখের আকাশে আজ বিষাদ রাত। স্রষ্টা’র কাছে আমার মামনী’র জন্যে দোয়া রইলো, অনেক দোয়া …
সুস্থ ভাবে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত যে কতটা সুন্দর, মূল্যবান তা আমরা কেমন অবলীলায় ভুলে থাকি, তাই না ?
২৮টি মন্তব্য
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সত্যিই লিখাটি পড়ে বিষাদে মন চেয়ে গেলো। অনেক অনুভূতিপ্রবণ আর মায়াবী মানুষ আপনি। সম্পর্ক এমন একটা জিনিস যা দূরের মানুষকেও কাছে টানে। মামীর সাথে আপনার সম্পর্ক রক্ত সম্পর্ককেও ছাড়িয়ে গেছে।
অনেক দোয়া রইলো মামীর জন্য।
রিমি রুম্মান
শুভকামনা আপনার জন্যেও।
ভাল থাকুন আপু, অনেক ভাল।
জিসান শা ইকরাম
আল্লাহ্ আপনার মামীকে জান্নাত বাসিনী করুন…… আমীন
লেখাটি পড়ে আপনার মামীকে নিজের মামীই যেন মন হচ্ছে
সম্পর্ক গুলোকে আমরা যেন যত্নে রাখি।
আমিও বিষাদের সময়ে কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারিনা,
কেমন এক দম আঁটকে আসে ঐ সময়।
নিজের আনন্দ বেদনাকে সোনেলার সাথে শেয়ার করে আমাদেরকেও একান্ত আপন বানিয়ে ফেলেছেন আপনি
আপনি জনপ্রিয় হবেন এই বিশ্বাস আমাদের ছিল এবং আছেন
আপনার জন্য আমরাও গর্বিত
একটি লেখা আসতে পারে আপনাকে নিয়ে
শুভ কামনা -{@
রিমি রুম্মান
সোনেলা আমার আপন ঘর।
মানুষগুলোও সব আপনজন ।
শুভকামনা আপনাকে।
-{@
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু তোমার এই আবেগ-অনুভূতি তোমাকে সবার থেকে আলাদা করে তুলেছে।
মামীর আত্মা শান্তি পাক এই প্রার্থনা করি।
খুব সত্যি সুস্থভাবে বেঁচে থাকার মতো সুখ কিংবা শান্তি-স্বস্তি আর কিছুতেই নেই।
ভালো থেকো সুস্থতায় এবং তার স্বস্তিতে। -{@
রিমি রুম্মান
তুমি ভাল হয়ে উঠেছ তো, নীলা’দি ?
সুস্থ থাকো, নিরাপদ থাকো _ প্রার্থনা আমার।
নীলাঞ্জনা নীলা
কিছুটা ভালো হয়েছি আপু। সামনের ১০ মার্চে ডাক্তার। দেখি কি বলে!
মোঃ মজিবর রহমান
মামনী নেই আজ প্রায় দু’সপ্তাহ হয়। আমি আমার মাতৃহারা বোনগুলোর খবর লই নি। একটিবার ফোন করে সান্ত্বনার বানী শুনাইনি।আমি অথর্ব কখনোই কাউকে সান্ত্বনাও দিতে পারিনা।
আপু আমিও পারিনা আপনার মত স্বান্তনা দিতে তাঁর জন্য অনেকে বলে অসামাজিক, কিন্তু কি করব বলুন আমার মুখ দিয়ে ঐ মুহূর্তে নিজেই খুজে ফিরি প্রাপ্তির জন্য।
আপনার মামী বেহেস্তবাসী হোক এই কামনা করি।
আপনি ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন।
রিমি রুম্মান
আপনিও ভাল থাকুন।
শুভকামনা রইল।
মৌনতা রিতু
মানে সত্যি ভাষা নেই মন্তব্য করার।এতো চমৎকার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার উপস্থাপন।
ভালো থাকুন,তাঁরাও ভালো থাকুক এই কামনা।
রিমি রুম্মান
এমন মন্তব্যগুলো আমাকে আরও লিখতে অনুপ্রেরণা যোগায়।
ভাল থাকুন, অনেক ভাল। পাশে থাকুন, সবসময়।
শুভকামনা। -{@
আবু খায়ের আনিছ
সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা মামনিকে উনি জান্নাতবাসী করুন।
এত ভালো যার লেখা তার লেখা পাঠক প্রিয় হবেই। আর কিছু লেখার মত শক্তি আমার আঙ্গুলে নেই, খনিকের জন্য হারিয়ে গিয়েছে।
রিমি রুম্মান
আমি এত সহজ করে লিখি, তবু সবাই কত ভালোবাসে লেখাগুলো।
আমি উৎসাহিত হই, আরও লিখতে। সোনেলাতে এমন সব মন্তব্য পাই, উৎসাহিত হই__ যা আর কোথাও পাই না।
ভাল থাকুন, অনেক ভাল ।
আবু খায়ের আনিছ
আপনিও ভালো থাকবেন আপু। অনেক অনেক শুভ কামনা আপনার জন্য।
খসড়া
জীবনটাই আনন্দ বেদনার কাব্য।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন।
এমন করেই জীবন এগিয়ে যায় সমাপ্তির দিকে।
ভাল থাকুন, আনন্দে থাকুন। বেদনাকে জয় করে এগিয়ে চলুন।
শুভকামনা…
ছাইরাছ হেলাল
আপনার প্রতিটি লেখা আমাদের অনুভূতিগুলোকে সহসাই এলোমেলো করে দেয়,
আমরা তা হই ও, তারপর ও এক বিশেষ বিষাদ আমাদের ছুঁয়ে গেল,
আপনার মামী বেহেস্ত বাসী হোন এ কামনাটুকুই শুধু করতে পারি সাধ্যের মধ্যে থেকে।
আপনার বই মেলা থেকেই সংগ্রহ করেছি একাধিকটি, ভুলে একদিন আগে গিয়ে খুঁজেছি, পরের দিনে গিয়ে ঠিক ঠিক নিয়েছি।
আপনার লেখা বইটি শুধু আপনার না, এটি আমাদের সবার, এমন করেই ভাবি।
আপনি সব শোক আপনি কাটিয়ে ঊঠবেন ই, তা জানি, তেমন আশাও করি।
আপনার আরো সহস্র সাফল্য অবশ্যই কামনায় রাখি।
রিমি রুম্মান
শুধু আমার বইটি কিনবে বলে এবার মেলায় গিয়েছে আমার কিছু আপনজন।
সোনেলা পরিবারের সকলেই আমার আপনজন। এমন করে পাশে থাকলে আমার এগিয়ে যাওয়া কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
ভাল থাকুন। শুভকামনা।
অরুনি মায়া
আপু আপনার মামী জন্নাতবাসী হন সেই দোওয়া করি |
বইটির নামের সাথে সেদিনের মুহূর্তগুলো কেমন যেন মিলে গেল |
আপনার বইটি আমার জন্যও একটি আনা হয়েছে | এখনো হাতে এসে পৌঁছেনি, তবে পৌঁছে যাবে |
ভাল থাকবেন আপু |
রিমি রুম্মান
আমাদের জীবন এমন করেই এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক ভাল থাকার সময়গুলোতে আচ্মকা বিষাদ নেমে আসে। এটিই জীবন। এটিই আমাদের সকলের জীবনের গল্প।
ভাল থেকো। ভালোবাসা ।
ব্লগার সজীব
সুখের আকাশে বিষাদ রাত , বইয়ের নামের মতই আপনার এই লেখা আপু। স্রষ্টা’র কাছে আপনার মামনী’র জন্যে দোয়া করি আপু, আল্লাহ্ ওনার আত্মাকে শান্তি দিক।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকো। শুভকামনা নিরন্তর।
মুহাম্মদ আরিফ হোসেইন
আপনার লেখা পড়তে পড়তে শরীর মন সব স্থীর হয়ে গেছে।
বিষাদ, হালকা আনন্দের ঝটকা! এইতো জীবন।!।
রিমি রুম্মান
জীবন এমন করেই এগোয়। সুখ, অতঃপর বিষাদ…
ভাল থাকুন সকলকে নিয়ে।
শুভকামনা। -{@
সালমা আক্তার মনি
আপু যত কিছুই করি জীবনটার নিয়ন্ত্রন তো আমাদের হাতে না। মামীকে আল্লাহ বেহেস্তবাসী করুন। আর উনার পরিবারের সাথে সাথে আপনাকেও সহ্য করার শক্তি দিক।
এই লেখাটাও চোখের পানি না ঝরিয়ে রাখেনি আপু। নয় দিনেই আপনার বই সাড়া ফেলেছে। যারা পড়ছেন তারাই বলছেন।
আমার নামটা লিখে অসীম কৃতজ্ঞতায় বেঁধে রাখলেন। ভালো থাকবেন সবসময়।
রিমি রুম্মান
আমার বইটি নিজে পড়েছো, অন্যকে পড়তে উৎসাহিত করেছো… এটি আমার জন্যে অনেক বড় প্রাপ্তি।
তোমাকেই সোনেলা’য় দেখে আমি যারপরনাই আনন্দিত।
ভাল থেকো সবসময় প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে। -{@
ইলিয়াস মাসুদ
আপু আমি সম্পর্কের এমন ছিন্নতা সহ্য করতে পাড়ি না
কেমন রুদ্ধ হয়ে আসে সমস্ত শরীর
আমরা দূরে থাকি বলেই হয়তো সম্পর্কের অস্তিত্ব এত গাঢ় হয়
মামীর জন্য প্রার্থনা রইল
আপনার বইয়ের কথাই খুব শিহরন হচ্ছে,পড়তে মন চাইছে এখুনি
কি করে পাবো? মাঝে মাঝেই NY যাওয়া হয় আমার
এখানের কোন লাইব্রিতে রাখার ব্যাবস্থা করেছেন কি?
ভাল থাকুন
রিমি রুম্মান
বইটির যে কয় কপি নিউইয়র্ক এনেছিলাম সব আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসবে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। আগামী বইমেলায় নতুন যে বইটি বেরুবে, আশা করছি আপনার জন্য একটি রেখে দিব যত্ন করে।
শুভকামনা। -{@