একান্ত কিছু কথা

রিমি রুম্মান ২ মার্চ ২০১৬, বুধবার, ০৯:১২:৫৯পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৮ মন্তব্য

“সুখের আকাশে বিষাদ রাত” বইটি বেরুলো যেদিন, সেদিন আমার বড় মামী আমাদের ছেড়ে চলে যান ধরা-ছোঁয়া’র বাইরে অন্য এক জগতে। ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন দীর্ঘদিন। শুনেছি, দীর্ঘ রোগ ভোগের পর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতর মানুষেরা জীবনের প্রতি, বেঁচে থাকবার প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আমার মামী সব যন্ত্রণা সয়েও তীব্রভাবে বেঁচে থাকতে চাইতেন। প্রতিটি ভোরে চোখ মেলে আনন্দে সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতেন আরও একটি ভোর পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছেন বলে।

 

প্রথম বই বের হবার সুসংবাদ আমার আর স্বজনদের জানানো হয়নি। প্রকাশের দ্বিতীয় দিনেই আমার মফঃস্বল শহর চাঁদপুরের “তাজমহল” লাইব্রেরী পঞ্চাশ কপি বই নিয়ে যায়। যে শহরে আমার জন্ম, বেড়ে উঠা, সেই শহরে তখন একুশের বইমেলা চলছিলো। সেই মেলায় আমার লেখা বই ! আমার সীমাহীন আনন্দে থাকবার কথা। কেননা, সেই শহরের প্রতিটি ইট-পাথর, ধূলিকণা আমার চেনা। আমার অতি আপন। কিন্তু আমি সমস্ত দিন বিষাদে ডুবে থাকলাম। নির্ঘুম রাত কাটালাম।

 

২০১২ তে মায়ের মৃত্যুর পর পাগলের মতন দেশে ছুটে যাওয়া আমার বুকভরা শূন্যতার দিনে আপার বাসায় ছুটে এসেছিলেন বড় মামী। কষ্টকর, যন্ত্রণাদায়ক কেমোথেরাপি ্নেয়া, প্রতিনিয়ত যমের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষটি এতোটা পথ পেড়িয়ে, পাঁচতলার সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলেন ! এসে আমায় জড়িয়ে ধরলেন যখন,  তাঁর দুর্বল দেহের কাঁপুনি, হৃদস্পন্দন আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম। ধরে সোফায় বসিয়ে দিতে দিতে ক্ষোভে, অভিমানে বলি, এই শরীরে এভাবে আসা মোটেই ঠিক হয়নি। তিনি দু’চোখ মুছলেন। অনেক আবেগে, কৃতজ্ঞতায় বললেন, “দুঃসময়ের দিনে যে উপকারটুকু করলে, আমি কোনদিন তোমার ঋণ শোধ করতে পারবো না”। আমার আর বলা হয়নি, বিদেশে আসবার আগে আমার ভীষণ দুর্দিনে তিনি যে এগিয়ে এসেছিলেন, সেকথা আমি প্রতিনিয়ত স্মরণ করি।

 

২০১৩ তে আবারো দেশে গেলে অন্যবারের মতই সব আত্মীয়ের বাসায় যাই। দেখা করি। তেমনি মামার কল্যাণপুরের বাড়িটিতেও যাই। সেসময়ে মামী ব্যথাতুর এক জীবনের নিভুনিভু প্রাণটুকু নিয়ে শুয়ে। আমায় দেখে উঠলেন। ডায়নিং টেবিলে একসাথে বসে আমরা সন্ধ্যাকালীন খাবার খেলাম। বেশীক্ষণ বসে থাকতে পারলেন না। বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকলেন। ঘর ভর্তি আমার কাজিন’রা। অনেকদিন পর আমার যাওয়াকে ঘিরে সবার এক হওয়া। সেই প্রথম ভাই-বোনদের মাঝে থেকেও আমার এতটুকু উচ্ছ্বাস হয়নি। ভেতরে ভেতরে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিলাম এই ভেবে__ এই যে আমি ফিরে যাবো, আর তো কোনদিন দেখা হবে না। আর তো এমন মমতায়, ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরা হবে না।

 

সেদিন অনেক কোলাহল মুখর বাড়িটিতে আমার মাঝে ভীষণ এক নৈঃশব্দ্য নেমে আসে। অসহায় আমি মামীর পাশে গিয়ে বসি। তিনি ইশারায় আরও কাছে যেতে বললেন। আরেকটু গা ঘেঁসে বসলে গালের সাথে গাল লাগিয়ে রাখেন ক্ষণিক।আমি স্পষ্টতই নোনা জল গড়িয়ে যাওয়া টের পাচ্ছিলাম। তিনি একটু শ্বাস নিয়ে বললেন, “আমি তোমার ঋণ কোনদিনই শোধ করতে পারবো না, আমায় ক্ষমা করে দিও”। আমি হাত দুটো চেপে ধরি শুধু। আমরা দু’জন প্রাণী রুমটিতে। আমাদের দু’জনেরই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়। আমার সেদিনও বলা হয়নি__ একদিন এই আপনিই আমার দুর্দিনে পাশে ছিলেন, ঋণী তো আমিই। আমি অধম কৃতজ্ঞতাবোধ কিংবা ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে পারি না।

প্রতিবারের মতই পা ছুঁয়ে সালাম করি বিদায়ের সময়। কিন্তু প্রতিবারের মতন এবার আর তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি। শুধু চোখের কোন বেয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। বালিস ভিজে যাচ্ছিলো।

মামনী নেই আজ প্রায় দু’সপ্তাহ হয়। আমি আমার মাতৃহারা বোনগুলোর খবর লই নি। একটিবার ফোন করে সান্ত্বনার বানী শুনাইনি।আমি অথর্ব কখনোই কাউকে সান্ত্বনাও দিতে পারিনা।

বইমেলায় আমার বইটি মাত্র নয় দিন সময় পেয়েছে। শেষ দিন স্টলের সব বই শেষ। সালমা মনি আপু বই কিভাবে পেতে পারে জানতে চাইলেন। লেখাটি যখন লিখছি, তখন আমার প্রকাশক এর মেসেজ ভেসে উঠলো স্ক্রিনে__ “আজ একজন ফোন করেছিলো, ২০ কপি নিবে”। একজন নতুন লেখকের বই এতটা ভালবাসবে মানুষ, জানা ছিল না। এতসব ভালোবাসায় আমার অনেক ভাল থাকবার কথা। কিন্তু ওই যে, বইটির ভুমিকায় লিখেছিলাম__

“প্রতিনিয়ত অনেক ভাল থাকা সময়গুলোতেও আচ্‌মকা বিষাদ নেমে আসে। সেইসব বিষাদ সকলের অগোচরে ভেতরটা আর্দ্র করে তোলে। কখনো বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস নামায়। যেমনটি ঝকঝকে নীলাকাশে হঠাৎ খণ্ডখণ্ড কালো মেঘ জমে, বৃষ্টি ঝরায়।এভাবেই এগিয়ে যায় জীবন ক্রমশ সমাপ্তির দিকে”…

হুম… প্রিয় সোনেলা’ , আমার সুখের আকাশে আজ বিষাদ রাত। স্রষ্টা’র কাছে আমার মামনী’র জন্যে দোয়া রইলো, অনেক দোয়া …

সুস্থ ভাবে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত যে কতটা সুন্দর, মূল্যবান তা আমরা কেমন অবলীলায় ভুলে থাকি, তাই না ?

 

 

৫২১জন ৫২০জন
0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ