আজকে ঢাকা শহরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে। অর্থাৎ বৃষ্টির সীজন চলে এসেছে। বৃষ্টির সীজন চলে আসা মানে রাস্তার ধারে ছাউনিবিহীন লোকদের দূরাবস্থার শুরু। যারা এতোদিন ছাউনিবিহীন ফুটপাতে নিশ্চিন্তে দিন কাটিয়েছে তারা এখন হয়তো জায়গা বদল করে আশ্রয়ের খুঁজে অন্য কোথাও জায়গা করে নেবে।
প্রথম যেদিন পথের ধারে অপ্রকৃতস্থ মানুষটিকে দেখতে পাই, কেমন ভয়ভয় লাগছিলো। তার বেঢপ আকারের পেটটিই এমন ভীতিবিহ্বল করেছিলো আমায়। তখন শহরজুড়ে ঘনশীত। দুটো কম্বল ঢাকা দিয়ে পড়ে থাকতে দেখতাম। একদিন দাঁড়িয়ে আছি, তখন সকাল ১০:৩০ বাজে। হঠাৎই দেখি গায়ের ঢাকা দেয়া সব কাপড় ছেড়ে সে উঠে দাঁড়িয়েছে। হনহন করে ফুটপাতেরই এক কলা বিক্রেতার নিকটে এসে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তার চাহনি যে কেমন ছিলো আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবো না। তবুও অপ্রকৃতস্থ মানুষ, কেনো কি কারনে এমনভাবে হন্তদন্ত করে এসে দাঁড়ালো সেটা নিশ্চিত হতেই কলা বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলাম। সে বললো, ক্ষিদা লেগেছে হয়তো। মেয়েটির চাহনি আর কলা বিক্রেতার বর্ণনা আমাকে রীতিমতো অশান্ত করে তুললো। বললাম, একহালি কলা দিয়ে দেন। লোকটি একহালি কলা আমার হাতে দিয়ে বললো, নেন। আমি বললাম, আমি দিতে পারবো না, আপনিই দিয়ে দেন। কলা হাতে পাওয়ামাত্র আমি তার ক্ষুধার্তরুপ দেখেছি সেদিন। ‘ভাত দে’ সিনেমার দৃশ্যটা চোখের সামনে ফুটে উঠলো। সারাটা দিন আমার যন্ত্রণায় কেটেছে। তার পরদিন অফিস যাওয়ার পথে একবাটি ভাত দিলাম তাকে। না না সরাসরি তার হাতে দেয়ার সাহস হয়নি আমার। অই কলা বিক্রেতার কাছে দিয়েই অফিসে চলে গেলাম। বিক্রেতা অভয় দিয়ে বললো, ভয় নেই, নিরীহ গোছের। পরেরদিন আমি নিজেই হাতে দিলাম। চেহারায় খুশিখুশি ভাব। কি করে যেনো তারপর থেকে আমাদের অফিসের লাঞ্চের সাথে তার জন্যও একবেলার খাবার বরাদ্দ হয়ে গেলো। এর মধ্যে একদিন জানতে চাইলাম, নাম কি? দুদিন জিজ্ঞাসা করার পর জানতে পারলাম। এমনি করে বৃহশপতিবার পার হয়ে যখন শুক্রবার এলো, আমার তো এদিন আর ওদিকে যাওয়া হয়নি। দুপুরে খেতে বসেছি, বারবার মনে হতে লাগল, পাগলিটা কি আজ অপেক্ষা করছে? গলা দিয়ে যেন খাবার নামছিল না। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে আমার চেহারা দেখে সালেহ জিজ্ঞেস করল, কি পাগলিকে দিতে চাইছো? লও, দিয়ে আসি। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল এই ভেবে, রোজকার নিয়মে সে অপেক্ষা করবে হয়তো। যাহোক, এর পরের সপ্তাহে তাকে জানিয়ে আসলাম, যে আমি কিন্তু দুদিন আসবো না। ততোদিনে টুকটাক কথা হতো পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে। সে জানতে চাইলো, ক্যা? আইবা না ক্যা? আরো অপ্রাসঙ্গিক কথা। তবে ততোদিনে এটাও বুঝেছি, বিত্তবানরা এদের রাস্তার আবর্জনা মনে করলেও দিন আনি দিন খাই কিছু লোক ঠিকই কমবেশি এদের দিকে তাকায়।
প্রথমদিকে বাটি করে ৩/৪ দিন দিলেও এরপর থেকে পলিতে করে দিচ্ছি। আস্তে আস্তে ততোদিনে গরম পড়তে শুরু করলে পাগলি খোলস ছেড়ে বেরিয়েছে। মুখের চেহারা দেখে এতোদিন বয়স আন্দাজ করতে না পারলেও এখন অনুমান করি ২২/৩০ এর মধ্যে হবে। গায়ের কাপড়ের অবস্থা দেখে নিজের ব্যবহৃত পুরোনো এক প্রস্ত কাপড়ও দিলাম। কই কি? ফেলে রেখেছে। কতোজন আমাকে ভয় দেখিয়েছে, এ ইনফরমারও হতে পারে। কিন্তু আমি কেনো যেনো তার ক্ষুধার্তরুপটিই দেখেছি। অনেক বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হয়েছি যে সে মূলতই অপ্রকৃতস্থ। নারী জীবনে প্রতি মাসের যে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এ ব্যাপারেও যে সে বোধহীন এতদিনে এটাও স্পষ্ট।
একদিন দেখি, সে নাই। এমনটা আমার প্রায় প্রতিদিনই মনে হতো খাবার নিয়ে যাওয়ার সময়। কারণ, পাগলে কি না করে! তো, আশেপাশে ফুটপাতে ভাঙচুরের কাজ করছিলো মানুষদের জিজ্ঞাসা করতেই তারা দেখি জোরে একজন ডাক দিলো। ডাক শুনে সে এসেই আমার আমার বলে খাবারেরটা ব্যাগটা এদের হাত থেকে ছুঁ মেরে নিয়েই বললো, একটা থাল দেও। আমি বলি, থাল তো নাই। কাগজের ব্যাগ থেকে খাবারের পলি বের করে কতোক্ষণ রাস্তার এমাথা ওমাথা হাঁটলো। পরে রাস্তার ওপারে গিয়ে এক স্ট্রিট টি স্টল থেকে বাটি নিয়ে বসে খেলো। আমি এপার থেকে তাই দেখছিলাম। ও, আরেকটি কথা। এদিন দেখি আমার দেয়া জামা পাজামা সে তার আগের নোংরা রক্তমাখা জামার উপর দিয়েই গায়ে লাগিয়েছে। আজ সকালে যাওয়ার সময় আরো এমন কিছু দেখলাম, মনে হলো এই দুনিয়ায় একজন সুস্থ মানুষ হয়ে বেঁচে আছি এই ঢের। শুকরিয়া আল্লাহ্র দরবারে।
আজ ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি দেখে মনে হলো, এই বুঝি আমার একজন ক্ষুধার্ত মানুষের পেটের আগুন দূর করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার দিন চলে আসলো। যেখানে সে আস্তানা পেতেছে, ওখানে বৃষ্টি বাদলে টিকে থাকা দূরহ। আল্লাহ্ সকলের মঙ্গল করুক।
আমার এই প্রকাশটা কে কিভাবে নেবেন জানি না কিন্তু আমি এখানে তুলে ধরেছি একটা অনুভূতি থেকে। মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে মানুষের মাঝে সাধ্যমতো একটু সহযোগিতার মনোভাব জেগে উঠুক। সামাজিক প্রয়োজনে আমরা অনেক কিছু করি। মনের খোরাক যোগাতে আনন্দ উচ্ছ্বাস করি। বেঁচে থাকার জন্য এর প্রয়োজন আছে। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে সমাজকে নিয়ে চলতে কমবেশি আদানপ্রদানও করতে হয়। পাশাপাশি অসহায় নিপীড়িতের দিকেও যেনো একটু তাকাই। আত্মার সন্তুষ্টি লাভে, মনের সুখ খুঁজতে মাঝেমধ্যে এদের পাশে দাঁড়ালে, দেখবেন নিজেকে অন্য ভুবনে খুঁজে পাচ্ছেন।
এই লিখাটা লিখতে লিখতে এদিকেও বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।
★ লিখাটা গতরাতে লিখেছিলাম।
২২টি মন্তব্য
অরণ্য
এমন মানুষদের পাশে আমরা যেন বন্ধু হয়ে প্রতিবেশী হয়ে থাকতে পারি, এগিয়ে আসি তাই কামনা করব।
ভাল লাগলো লেখাটি।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ। সাধ্যমতো এটা করা উচিৎ।
রিমি রুম্মান
মানুষ মানুষের জন্যে __ এই হোক আমাদের সকলের মানবীয় অনুভূতি ।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
মানুষ মানুষেরই জন্য। -{@
জিসান শা ইকরাম
আপনার এমন মনোভাবকে শ্রদ্ধা জানাই,
সুস্থ্য আছি এটিই পরম ভাগ্য আমাদের।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
পরিপূর্ণভাবে বেঁচে আছি এটিই পরম সৌভাগ্য।
নীহারিকা জান্নাত
আপনার মত এমনভাবে অনেকেই ভাবতে পারি না।
ওদের দেখলে এড়িয়ে চলি। কিন্ত একটু সাহায্য সহযোগিতা পেলেই তারা মানুষ হিসেবে বাঁচার একটু সুযোগ পায়।
সবার মাঝে এমন অপ্রকৃতিস্থ, নিরীহ মানুষদের সাহায্য করার মানসিকতা জাগ্রত হোক।
শুভকামনা আপা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, আমিও আগে কখনো এমন ভাবতে পারিনি। কলা বিক্রেতার সামনে ক্ষুধার্ত তাকে ফ্যালফ্যাল করে দাঁড়ানো দেখেই আমার অনুভূতি ভীষণ রকম নাড়া খেলো।
নীলাঞ্জনা নীলা
রুবা’পু তুমি সত্যি মহান। এমন আমি নিজেও করতে পারবোনা।
এসব মানুষদের আমরা সবসময় এড়িয়েই যাই।
হুম এদের নিয়ে আমরা লেখালেখি করি, কিন্তু এদের জন্য কিছুই করিনা।
সমাজের ভন্ড মানুষদের ভীড়ে তোমার মতো কিছু মানুষদের জন্যই আজও মানবতা শব্দটি টিকে আছে।
ভালো থেকো আপু। -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এটা সেরকম কিছুই না। আমি তেমন কিছুই করতে পারছি না। যেদিন লিখলাম, তার পরেরদিন তাকে দেখি সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে জবুথুবু। ভোরে বৃষ্টি কমায় কোনরকমে বসে আছে। আমার দিকে তাকাতেই পারছিলো না। শুধু জিজ্ঞেস করলাম, রাতে কোথায় ছিলে? কিছুই বুঝাতে পারেনি। মনুষত্বের এমন বিপর্যয় দেখে আমি চোখের পানি সামলাতে পারিনি। এখানে আমার কিচ্ছু করার নেই। অসহায়বোধ আমাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে কেবল। কিন্তু সে তো বোধহীন, তাই বুঝিয়ে বলতেও পারছি না যে রাতে ওই পারে ছাউনির নিচে গিয়ে থেকো আর সকালে এখানে চলে আসবে, তাইলে আমি তোমাকে খাবারটা দিতে পারবো। শুধু একক্টুকু ভাবি, অন্তত ২৪ ঘন্টায় একবার সে ভরপেট খেতে পারুক। জানি না, ঝুম বৃষ্টি হলে কি করবে!
নীলাঞ্জনা নীলা
আহারে! এখানে অনেক দরিদ্র মানুষ আছে রুবা’পু। তবে খুব কমজনেই ভিক্ষা চায়। গিটার, ভায়োলিন বাজায় শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে। একজন বয়ষ্ক লোক যে দারুণ ভায়োলিন বাজায়, আমি উনাকে দুই ডলার করে দিতাম। এর বেশী পারিনি দিতে কখনো। আর একজন বুড়ীকে চিনতাম তাকেও দিতাম। সে একটা কৌটা নিয়ে বসে থাকতো ওয়াকারে। জানো আজ সেই বুড়ীকে বহুদিন পর পেলাম। খুব গরীব। এই মায়নাস ডিগ্রী ঠান্ডার মধ্যে সিগনালে বসা। আজ পারিনি পাঁচটা ডলার দিতে। ক্যাশ যা ছিলো ট্যাক্সিতে লাগবে, তাই দুই ডলার দিয়েছি। ওই বুড়ীটাকে দেখলেই কষ্ট হয় আমার। দেশে থাকতেও আমি তাদেরকেই সাহায্য করতাম, যারা একেবারে অথর্ব।
দেশ নাকি উন্নত হচ্ছে। প্লেনে উঠে ভ্রমণে যায় দেশের বড়োলোকেরা। অথচ তারা চাইলে কি না করতে পারে? মধ্যবিত্ত হওয়াটা আসলেই অভিশাপ।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
নিলাদি, সে অপ্রকৃতস্থ বলে ভিক্ষাও বুঝে না। তার কিছু ছবি আমি তুলেছি, দেখলে বুঝতে কতোটা অবোধ সে। ভালো থেকো, ভাল রেখো সাধ্যমতো।
সমস্যা হচ্ছে এদেশে ৯৯.৯৯% মানুষ আত্মকেন্দ্রিক। আর উচ্চাভিলাষীদের কথা আর নাইবা বলি।
নীলাঞ্জনা নীলা
রুবা’পু ছবিগুলো দিও।
মেয়েটা যেনো ঠিক থাকে। এদেরকে তো আরোও কতোকিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বুঝিয়ে বলতে পারেনা।
মেহেরী তাজ
সুস্থ মানুষ হয়ে যেভাবে বেঁচে আছি সেটাকেই সুন্দর মনে করে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই বারবার।
আপু আপনি প্রকাশ করলেন বলেই না জানলাম এমন কাজ আমাদের ও করা উচিৎ। আপনি বললেন তবেই না জানলাম এমন কাজে ভয় নেই শান্তি আছে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শুধু এক মুঠো ভাত ক্ষুধার্ত একটা মানুষের পেটের আগুন নেভাতে পারে।
সাধ্যমতো যেমন পারো করার চেষ্টা করো, আত্মার শান্তি পাবে।
মেহেরী তাজ
চেষ্টা করবো আপু। আপনাকে যখন মডেল হিসেবে পেয়েছে তখন করবোই! 🙂
মিষ্টি জিন
এদের দেখলে আমার ও মনে হঁয় সুস্হ স্বাভাবিক হঁয়ে পৃথিবীতে বেচে আছি এই ই ঢের।
মনের শান্তির জন্য আপনার মত এমন কাজ আমাদের করা দরকার ।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সেটাই। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে আমি অপ্রাপ্তির খেদ দেখি!
গাজী বুরহান
ফার্মগেট থেকে বসুন্ধরা মার্কেটে যাওয়ার পথে সামনে একটা লোক (অপ্রকৃতস্থ) কে দেখলাম। টাকা চাইল, দুটাকা দিয়ে কেটে পড়লাম। কাজ সেরে আসার পথে সেই একই যায়গায় দেখি লোকটি ক্ষুধার জ্বালায় মাঠিতে শুয়ে ছটফট করছে। আমরা কজন মিলে তার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম। আসলে প্রতিদিন এরকম ছোটখাটো কিছু কাজ করলে মন যে কত ভাল থাকে, তা বলে বোঝানো যাবে না।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
(y) (y) (y)
চাটিগাঁ থেকে বাহার
আমার একটি অভ্যেস আছে। পাগল দেখলে আমি কিছু না কিছু খাওয়াতে চেষ্টা করি। অন্তত এক প্যাকেট বিস্কিট হলেও। ওরা ভিক্ষুকের মত ভিক্ষা করে না। অনেকে খাবার নিতে চায় না।
আপনার উদ্যোগ ভালো লাগলো।
(y)
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শুনে আমারও অনেক ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা জানবেন।