মাঝে মাঝেই মনে প্রশ্ন জাগে, আমি কি বাঙ্গালী? কেন নয়? আমি বাংলায় কথা বলি, তাই আমি বাঙ্গালী। আমি মাছ, মাংস, আলু, পটল, শাক-সব্জি, বিরিয়ানী, পোলাও সব সারাবছর ধরে খাই। অবশ্যই আমি বাঙ্গালী।
ছোটবেলায় চৈত্রের শেষে গ্রামে বেড়াতে গেলে চাচাদের সাথে বাজারে হালখাতার দাওয়াতে যেতাম। রাতে আম্মা আর চাচীরা মিলে কত ধরণের পিঠা বানাতেন। এবাড়ি ওবাড়ি পাঠাতেন। পরদিন সকালে আমরা সেসব খেয়েই দিন শুরু করতাম। তখন পান্তা-ইলিশ খাওয়ার চল ছিলো না। পয়লা বৈশাখের প্রধান আকর্ষণ ছিলো মেলায় যাওয়া। বিকেল বেলা আব্বা বা বড় কোনো চাচার সঙ্গে সব ভাই-বোনেরা মিলে বৈশাখী মেলায় যেতাম। মাটিতে পসরা সাজিয়ে বসে থাকা দোকানিদের কাছ থেকে কত কি কিনতাম! টমটম, মাটির পুতুল, হাতি, ঘোড়া, হাড়ি-পাতিল, বাঁশি, পাখা, কাঁচের পাইপের মত রঙ্গিন পানির রকেট, মুড়ি, খই, মোয়া, মুড়কি, বাতাসা…দু’হাতে যেন আর আটতো না। একটু বলে নেই, আমার পছন্দের খেলনা ছিলো রঙ্গীন পানির রকেট আর টমটম। সবশেষে কাঠি লজেন্স বা রঙ্গিন আইসক্রীম খেতে খেতে দড়ি বেঁধে টমটম চালাতে চালাতে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতাম। রাতে সেসব খেলনা নিয়ে হুলুস্থুল। কার বাঁশি বেশি জোরে বাজে, কার টমটমের আওয়াজ বেশি, কার কাছে চিনির তৈরী হাতি, ঘোড়া, পাখি বেশি আছে এসব নিয়ে প্রতিযোগিতা। সারা বাড়ি এসব নিয়ে ছোটরা ছোটাছুটি করতাম কিন্ত সেদিন কি এক আশ্চর্য কারণে বড়রা কিছুই বলতেন না বা বিরক্ত হতেন না। খেলা শেষে বসতো গল্পের আসর। আব্বা-চাচারা মিলে তাদের ছোটবেলার নানান রঙের গল্পগুলো শোনাতেন।
আস্তে আস্তে বড় হতে হতে আমার চেনা বৈশাখে বদলে যেতে লাগলো। শুরু হলো পান্তা-ইলিশের আয়োজন। দেখি বৈশাখের আগে ইলিশ কেনার ধুম পড়ে যায়। ঈদের মত নতুন জামা-কাপড় কেনারও ধুম পড়ে। মার্কেটগুলো জমজমাট। দর্জির দোকানে উপচে পরা ভীড়। একে উপলক্ষ্য করে আবার বুটিক হাউজগুলোর নানা আয়োজন। বিভিন্ন জায়গায় কনসার্ট। টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোর নানা বৈশাখী অনুষ্ঠানের আয়োজন। মেলাগুলো স্টল নির্ভর হয়ে গেলো। কত রকমারি ডেকোরেশনের মাধ্যমে ক্রেতা আকৃষ্ট করার চেষ্টায় নিমগ্ন তারা। লাউড স্পীকারে গান বাজে। কপোত-কপোতীরা মাথায় রঙ্গীন ফুলের বেড়ী বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। এ যেন এক অন্যরকম বাংলাদেশ। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবার এ দিনে নিজের মত করে বৈশাখ পালন করার চেষ্টা। দেশ জুড়ে চলে সার্বজনীন এক উৎসবের আমেজ। এসব দেখতে বেশ লাগে।
আমি এখনও বৈশাখী মেলায় যাই, সকালে হাজার টাকায় কেনা ইলিশ দিয়ে পান্তা-ইলিশ খাই। কিন্ত পরদিন থেকেই সকলের সঙ্গে খাঁটি বাংলায় কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করি। অফিসে ইংরেজীতে চিঠি-পত্র চালাচালি করি। বাংলায় কিছু লিখতে গেলে দুনিয়ার বানান ভুল করে বলি, ‘অনেকদিন বাংলা লেখার প্র্যাক্টিস নেই তো, তাই।‘ হিন্দী গান না বাজালে আমার জন্মদিন, গায়ে-হলুদ, বিয়ে, বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠান জমেই না। ছেলে-মেয়েদের বাংলা শেখাবার আগে খাঁটি ইংরেজী কিভাবে শেখাবো তা নিয়েই ব্যাস্ত থাকি। বাসায় তাদের সাথে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলি না বা উৎসাহিত করি না। বাংলা বই পড়তে উৎসাহ দেবার বদলে ল্যাপটপ/ট্যাব কিনে দেই গেমস খেলার জন্য। আমার বাচ্চা ভুল বাংলা বললে লজ্জ্বা পাই না বরং ভুল ইংরেকি বললে আমার মাথা কাটা যায়। সারাদিন হিন্দী ডোরেমন কার্টুন দেখে আমার বাচ্চা যখন গড়গড় করে হিন্দীতে বলে, ‘মাম্মা, পাপাকো বুলাও না।’ তখন আমি গর্বে আকাশে হাটি। ভাবি বাহ! বেশ বেশ! ভালো তো!
আমি কি তবে এখনও বাঙ্গালীই আছি? না অন্য কিছু হতে চলেছি?
২৬টি মন্তব্য
চাটিগাঁ থেকে বাহার
সব তো আপনিই বলে দিলেন, আমি কী বলতাম!
খুব ভালো হয়েছে লেখাটি। দক্ষ শিল্পীর মতো ছোটকালের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন।
নীহারিকা
আমি মোটেই দক্ষ লেখক নই ভাই। শুধু ঘটনাগুলো লিখে গেলাম।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
শুন্য শুন্যালয়
টমটম আমারও দারুণ প্রিয় ছিলো আর অইযে কারটায় বেশি শব্দ হয় এই প্রতিযোগিতা আমাদেরও ছিলো। 🙂
আমরা সব শেষে শুধু বাংলাদেশীই রয়ে যাবো।
গোছানো সুন্দর একটি লেখা। এবারে বুঝি আর ১১:৫৯ র রিস্ক নেন নি? 🙂
নীহারিকা
সেসব দিনের কথা মনে পড়লে এখনো যেন বাচ্চা হয়ে যাই। লেখাতে তাই বুঝাতে চেয়েছি যে বাংলাদেশী বাঙ্গালী থেকে শেষে শুধু বাংলাদেশীই না থেকে যায়।
আরে এ লেখা সুন্দর বললেতো শরম পাই।
আরো ২ টি লেখা জমা দেয়া যাবে কিন্ত টাইম আছে ১ টির। ১১ঃ৫৯ এর হ্যাট্রিক করবো ভেবেছিলাম, তা আর হলো না।
নীলাঞ্জনা নীলা
অবশ্যই বাঙ্গালী। সময়ের সাথে পাল্টে যায় সবই। আমাদের বাবা-মায়েরা যেভাবে পহেলা বৈশাখ পালন করেছে, আমরা ঠিক সেরকম করিনি। আবার আমাদের সন্তানরাও আমাদের মতো পালন করতে পারবেনা। আমি তো পহেলা বৈশাখে মেলা কখনই পাইনি। মেলা হতো শ্রাবণ মাসে ঝুলন উৎসবে। মেলার কথা থাক। তবে এটুকু জানি মননে এবং চেতনায় আমি বাঙ্গালী, বাংলাদেশী। সম্মান করি আমার ভাষাকে। অপমানিত হতে দেইনা।
খুবই সুন্দর লিখেছেন। এতো ভালো কি করে লেখেন আপা? :c
নীহারিকা
ভাষার সন্মান আমাদের নিজেদেরই রাখতে হবে।
আর এইটা কোনো লেখা? এইটা হইছে ল্যাহা 😀
আপনার মত লেখকদের লেখার পাশে এ কিছুই নয় আপা। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
নীহারিকা আপা আপনি অনেক ভালো লেখেন। মন থেকে বললাম কথাটা।
মৌনতা রিতু
জান, আমি কি কিনতাম, কেরোসিন দিয়ে চালানো যেতো পানিতে এক ধরনের ছোট টিন দিয়ে তৈরি নৌকা।
ভট ভট শব্দে পানিতে চলতো সত্যি। কিন্তু কিছুদূর যেতেই তলিয়ে যেতো। সাথে সাথে পানিতে নেমে তা উঠাতাম।
সত্যিই পাল্টে গেছে সব। আমরা হেরে যাচ্ছি পাশ্চাত্যের কাছে।
খুব সুন্দর লেখা হইছে। আমার মেমন এবার ক্যাডেট থেকে এসে বলছে,” মা, জান ওখানে সব সময়ই ইংরেজীতে কথা বলতে হয়। নতুবা অনস্মার্ট মনে করে সবাই।” ছেলে আমার এই ক’দিনেই চামচ দিয়ে খাওয়া শিখে এখন হাত দিয়ে খেতে অস্বস্তি বোধ করছে।
এখানেই আমাদের গর্ব তাই না! তবুও কিন্তু খচখচ কষ্ট ঠিকই থাকে। ঐতিহ্যের অহংকারের কষ্ট।
নীহারিকা
সেই স্টীমার আমারও ছিলো দু’টো। একটা লাল আর একটা পেস্ট কালার। সলতে দিয়ে আগুন ধরাতে হতো 🙂
এই দিন বদলের খেলায় কোথায় যেনো সরে যাচ্ছি আমরা। সেটাই কষ্ট দেয় নিজেকে।
তবুও নিজেকে বাঙ্গালী হিসেবে ধরে রাখবার চেষ্টা থাকবে আজীবন।
আপা, ধন্যবাদ আপনাকে।
ইঞ্জা
দাদী, জানি সেইসব দিন আর ফিরে পাবোনা কিন্তু আমরা চট্টগ্রামের মানুষ এখনো ঐতিয্য ধরে রেখেছি, চট্টগ্রাম শহরে এখনো জব্বরের বলি খেলা (কুস্তি) হয়, মুড়ি, মুড়কি, মোয়া, পুড়নো ঐতিয্যের নানা রকম চিনি দিয়ে খাবার দাবার সহ কতো ধরণের যে খাবার পাওয়া যায়, এখনো, টমটম, প্যাঁপু বাশি, লাঠি দিয়ে ঠেলে নেওয়া হেলিকপ্টার, আহা কতো যে কি না আছে।
কিন্তু আমরা এখনো ইলিশ সহকারে পান্তা খাইনা কারণ এ আমার সংস্কৃতি নয়।
নীহারিকা
চাইছি নতুনের সাথে পুরোনো ঐতিহ্যগুলোও যেন বেঁচে থাকে আমাদের মাঝে।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাই।
ইঞ্জা
শুভকামনা
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
এ প্রশ্ন আমারও আমি কি সত্যিই বাঙ্গালী?এ বাংলা ভাষার জন্যই কি রফিক বরকত প্রান দিয়েছিলো এর সার্থকতা কোথয়।খুজেও পাই না।সুন্দর প্রতিবাদী বাস্তবতার নিরিখে লেখা। -{@
নীহারিকা
নতুনের সাথে পুরোনো ঐতিহ্যগুলোও যেন বেঁচে থাকে আমাদের মাঝে।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
সুন্দর স্মৃতিচারণ,
মেলার সে-সব দিন আর ফিরে আসবে না,
শিকড়কে অস্বীকার করার উপায় নেই।
নীহারিকা
খুব মিস করি সেই দিনগুলোকে।
ঠিক বলেছেন, ‘শিকড়কে অস্বীকার করার উপায় নেই।’
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
ম্যাগাজিনে ‘একান্ত অনুভুতি’ নেই,
সঠিক বিভাগ নির্বাচন করুন!!
নীহারিকা
ব্লগের বিভাগগুলোর মধ্যে “স্মৃতিচারণ” বিভাগটি পেলাম না কিন্ত ম্যাগাজিনে এ বিভাগটি রাখা হয়েছে। তাই যেহেতু ব্লগের অন্য বিভাগগুলোর সাথে পোস্টটি ম্যাচ করছে না কিন্ত ‘একান্ত অনুভুতি’ বিভাগের সাথে কিছুটা ম্যাচ করে বলে আমার মনে হয়েছে তাই পোস্টের বিভাগ ‘একান্ত অনুভুতি” সিলেক্ট করেছি কিন্ত পোস্টের নামের সাথে “স্মৃতিচারণ” বিভাগ লিখে দিয়েছি।
এখন ম্যাগাজিনের বিভাগগুলো যা আছে, “বিভাগঃ গল্প/ কবিতা / ছড়া / প্রবন্ধ / চিঠি / স্মৃতিচারণ এবং রম্য’ এর মধ্যে আমার লেখার সঠিক বিভাগটি কি হবে তা বুঝতে পারছি না, নাকি কোনোটিতেই ম্যাচ করছে না তা নিয়েও আমি কনফিউজড। যদি আপনাদের মনে হয় লেখাটি উল্লেখিত বিভাগগুলোর সাথে ম্যাচ করছে না, তবে ম্যাগাজিন থেকে বাদ দিতে পারেন। এব্যাপারে ব্লগ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত বলে মেনে নেবো।
শুন্য শুন্যালয়
ভাইয়ার মন্তব্যে আমিও এটা ভেবেছি। এরকম লেখা বাদ দেবার কথা কেনু কেনু?
স্মৃতিচারণ বিভাগে এটা রাখা হয়েছে আপু। ব্লগেতো আসলেই এই অপশন নেই। 🙁
নীহারিকা
আরে বিভাগ ম্যাচ না করলেতো ডিসকোয়ালিফাইড-ই হবার কথা।
এটা কোনো ব্যাপার না। 🙂
শুন্য শুন্যালয়
ধুর ধুর আপু খালি সেন্টিমেন্টাল হয়ে যায়। সঞ্চালকদের তাবড়ানি দিয়ে আরো কমেন্ট দেবেন তা না।
নীহারিকা
আরে আরে সেন্টিমেন্টাল কোথায়? আমি নিজেই বিভাগ নিয়ে কনফিউজড তাই তো হেল্প চাইলাম।
আর সঞ্চালকদের দাবড়ানি দেবো আমি? একবার ফান করে ‘ঝাড়ি’ শব্দ লিখেই যা হইলো তারপর আবার দাবড়ানির ‘দ’ উচ্চারণ করারও সাহস নাই।
মিষ্টি জিন
সবাই সব বলে ফেলছে। আমি শেষে এসে পড়েছি 🙁
স্মৃতিচারন ভালো লেগেছে ।
নীহারিকা
স্মৃতিচারণ ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো আপা।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
মেহেরী তাজ
আপু টমটম গাড়ি কোনটা? যেটা টেনে নিয়ে গেলে ফটফট/ ঠাশঠাশ করে শব্দ হয় ওটা?
ওটাকে তো আমরা ফটফটি গাড়ি বলি।
রকেট আমার ও পছন্দের ছিলো। ওটা এখন ও পাওয়া যায় আপু।
আপু এখন বাংলাদেশ এ জন্মালেই সে বাঙ্গালী। যে সঠিক বাংলা বলুক আর ভুল।
মেলার কথা পড়েই মন ভালো হইছে । 😀
নীহারিকা
হ্যা দুটো কাঠি থাকে ঢোলের মত একটা অংশের উপরে আর চাকা ঘুরলে সেই কাঠিগুলো আওয়াজ করে। রকেটও দেখিনা অনেকদিন। সব বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ হয়ে যায় তাই।
মন ভালো হইছে জেনে ভালো লাগলো 🙂