“প্রিয় আব্বু,
পত্রের শুরুতে হাজার হাজার সালাম নিও। আশা করি ভালো আছো। আপনার দোয়ায় আমরাও ভালো আছি। আজ দুসপ্তাহ পর চিঠি লিখতে বসেছি। তুমি মনে হয় অনেক বেশি রাগ করেছ! কি করব বলো? স্কুলে যে পরীক্ষা ছিল। তাই লিখতে পারিনি। তোমার চিঠির উত্তরও দিতে পারিনি। এ জন্য সত্যিই দুঃখিত।
কালকে মন খারাপ ছিল। স্কুলে সবাই বলে তুমি নাকি দূর আকাশের তাঁরা হয়ে গেছ। কিন্তু আমি যে তোমার কাছে চিঠি লিখি। তুমিও উত্তর দাও। আমি খুব মজা করে তোমার লেখা চিঠি পড়ি। এইবার দেরি করোনা আব্বু। তুমি আমাদের কাছে চলে এসো।
জানো আব্বু!! আমাদের বাড়ির সামনের কাঁঠাল গাছে এবার ৩২ টা কাঁঠাল এসেছে। আমি গুনে রেখেছি। এবং উঠানের বাম পাশে লিচুগাছে ১০৮ টি লিচু এসেছে। গত বছরও এসেছিল। ১৪ টি লিচু তোমার জন্য রেখেছিলাম ফ্রীজে, তুমি আসো নাই।
ভাইয়া আমাকে এমনি এমনি মারে। তুমি ওকে বকে দিও। আজকে সকালে পুকুর থেকে মাছ মারার পর বড় দেখে একটি কৈ মাছ রেখেছিলাম তোমার জন্য। আম্মু বলেছে তুমি নাকি কৈ মাছ খুবই পছন্দ কর। আর তা দেখে ভাইয়া আমাকে মেরেছে। ওকে আচ্ছা করে বকে দিয়।
গত চিঠিতে বলেছিলাম না, আমাদের আমগাছে একটি পাখি বাসা করেছে। আজ নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি ছোট দুটি পাখির বাচ্ছা কিচিরমিচির করছে। মা পাখিটি কোথা থেকে আদার নিয়ে আসে আর ওরা খায়। আমার তা দেখতে খুব ভাল লাগে।
আজকের মত বিদায় নিচ্ছি।চিঠি পাওয়ার পর উত্তর দিতে দেরি করনা। আমি অপেক্ষায় থাকব।
ইতি,
তোমার আদরের মেয়ে..
তানিহা।”
চিঠির পিছনের গল্পঃ
টেবিলের উপর রাখা ডায়েরীর পাতা উল্টাতেই লেখাটি চোখে পড়ল। পড়ে অঝোরে কেঁদেছি অনেকক্ষণ। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট গল্পের লেখক মার্কিন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক Ernest Hemingway (আর্নেস্ট হেমিংওয়ে) তার ছোট গল্পটি ছিল
“For sale. Baby shoes. Never worn” গল্পটির বাংলা অনুবাদঃ ”বিক্রির জন্য। শিশুর জুতা। ব্যবহৃত নয়” এইটাই। গল্পটির ভাবার্থ এইরকম ”বাচ্চার জন্য জুতো কেনা হয়েছিল, কিন্তু সেই বাচ্চাটা পৃথিবীর আলোই দেখেনি, মায়ের গর্ভেই শিশুটির মৃত্যু হয়” আমার বোনের ছয়বছর বয়সে এরকম একটি ছোট গল্পের জন্ম হয়। “একটি মেয়ের বয়স ছয় বছর, তার বাবা জীবিত আছে কিন্তু তাদের এখনো দেখা হয়নি।” আব্বু বিদেশ যাওয়ার পর তানিহার জন্ম হয় এবং তিনি সেখানে আনলিগেল হয়ে যান। এবং টানা ছয় বছর পর সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তানিহার বয়স বেড়ে এখন আট। গল্পটিও বয়সের সাথে সাথে বড় হতে চলেছে। ডায়েরীর পাতা উল্টাই এবং খন্ড খন্ড হরেক রকম লেখা দেখি। সবই বাবাকে লিখা আমার বোনের চিঠি।
(তিন মাস পূর্বে আমার একজন চাচাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করতে হল। টানা ১৬ বছর পর এসেছেন সৌদিআরব থেকে। উনার মেয়েও গিয়েছিল এয়ারপোর্টে। নাম আবিদা। বয়স ১৬ বছর। বাবাকে এই প্রথম দেখবে। আবিদা ভিড়ের মাঝে উঁকি দেয়, একজন একজন করে লোক বের হয়, তাদের মাঝে থেকে তার আব্বুকে খোঁজে। আধাঘণ্টা পর একজন বের হলেন লাঠি হাতে নিয়ে। আবিদা চিৎকার করে বলতে লাগল এই যে আমার আব্বু! এই যে আমার আব্বু!! (ছবিতে দেখেছিল)। এই যে দৃশ্য চোখে পড়ল। আমার মনে হল এরকম হাজারো ঘটনা আছে আমাদের দেশে।)
১৩টি মন্তব্য
চাটিগাঁ থেকে বাহার
কঠিন বাস্তবতা।
গাজী বুরহান
সত্যিই। এ এক কঠিন বাস্তবতা। এ কঠিন বাস্তবতা গুলো প্রতি বছর আমাদের জন্য এনে দেয় হাজার হাজার কোটি ডলার রেমিট্যান্স। যাহা আমাদের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি।
জিসান শা ইকরাম
ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো চিঠি পড়ে এবং এর পিছনের কথা জেনে।
এই চিঠি সম্পর্কে কি লিখবো ভেবে পাচ্ছি না আসলে।
গাজী বুরহান
লিখতে গিয়েও বারবার হাত কাঁপছিল। বাহার ভাই বলেছিলেন “কঠিন বাস্তবতা”। হুম, মন খারাপ হবার মত।
পিছনের গল্প না জানলে ইহা শুধু চিঠিই থাকত। তাই..
ধন্যবাদ আপনাকে।।
নীলাঞ্জনা নীলা
মন্তব্য করার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা।
এতোটাই কষ্ট হচ্ছে।
গাজী বুরহান
বুজতে পারছি আপনার আবেগ। এতসব কষ্টদায়ক, পীড়াদায়ক গল্পই তৈরি করেছে আমাদের দেশের দাম্ভিক শব্দ “রেমিট্যান্স”।
নীলাঞ্জনা নীলা
ঠিক বলেছেন।
নীহারিকা
এমন ঘটনাও ঘটে পৃথিবীতে জানা ছিলো না। বেঁচে থাকার পরও ১৬ বছর বয়সে প্রথম বাবাকে দেখা কিংবা একেবারে না দেখতে পাবার কষ্টের তুলনা করা যায় না। এমন কষ্ট আর কোনো বাবা বা তার সন্তানেরা যেন না পান।
গাজী বুরহান
সত্যিই।
আমাদের সিলেটে প্রবাসীদের সংখ্যা বেশি। এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। যেমন, টানা ২৯ বৎসর পর এসেছেন বাড়িতে। আমাদের এলাকারই, যে মেয়েকে তিনি দেখেন নাই সেই মেয়ের ঘরের নাতির বয়স ৭ বৎসর।
অপার্থিব
প্রবাসী শ্রমিক দের অনেকের জীবনেই এমন করুন ঘটনা ঘটে। ভাল লাগলো লেখা।
গাজী বুরহান
সত্যিই। আমার দেখা অনেক ঘটনা আছে যাহা হৃদয়ে কাটা দিয়ে যায়।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
নীরা সাদীয়া
আহা, মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল চিঠিটা পড়ে।
গাজী বুরহান
এরকম মন খারাপ সকলের হোক। পুলিশের হোক, সরকারের হোক, টাইকুনদের হোক, কৃপণদের হোক। আপনার মন খারাপ হয়েছে শুনে আমার মনটা বড্ড বেশি ভাল হয়ে গেল।
একটি বই থেকে উক্তিটা চুরি করে এনেছি আপনার জন্য। মাইন্ড করবেন না। আপু আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।