ঠিক কবে থেকে আমরা এত বিদ্বেষ-পরায়ন হলাম তা আমার জানা নেই। অনলাইনে না এলে জানতাম না একজন মানুষের মৃত্যু নিয়েও এমন উল্লাস হতে পারে। তবে বিরুদ্ধ মতকে দমনের জন্য হত্যার পাশবিক খেলা খুব বেশি নতুন নয়। রগ কেটে দেয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনি-বিদ্যার অধ্যাপককে মেরে ম্যানহলে ফেলে দেয়ার ঘটনা আমরা দেখেছি। গতকাল যে হত্যাকান্ডটি আমরা দেখলাম, তা কি শুধু ধর্মীয় অনুভূতির কারণে?

ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদের উপর ঠিক একইভাবে একই জায়গায় হামলা হয়। কারণ তিনি তৎকালীন ক্ষমতাসীন জামাতের ভূমিকা নিয়ে একটা উপন্যাস লেখেন “পাক সার জমিন সাদ বাদ” নামে। বইতে জামাত-শিবিরের কর্মকান্ড নিয়ে লেখকের স্বাভাবসুলভ ক্রোধোন্মত্ততার কারণে কিছুটা অতিরঞ্জন হয়তো ছিল, এটা তার সাহিত্যের বৈশিষ্ট। এর জন্য তিনি একটি মহলের টার্গেটে পরিণত হন।

এর আগে হুমায়ুন আজাদের আরেকটি বই প্রকাশ হয়েছিল যেখানে ইসলামের নবী (স) এর জীবনী নিয়ে একটা মনগড়া গল্প ফাদা হয়। মজার ব্যাপার হল অনেকে সেই বইটি সম্পর্কে জানেই না। নোবেল বিজয়ী হোসে সারামাগোও প্রায় একই ধাচের একটি উপন্যাস লিখেছিলেন যিশুখ্রিষ্টকে নিয়ে যেটা পশ্চিমাদের মধ্যেও বেশ সমালোচিত হয়। কিন্তু হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসটি বেমালুম আড়ালে চলে গেল, সেটা নিয়ে কেউ কথা বলল না, মহানবী (স) কে নিয়ে ব্যঙ্গ করায় কোন তৌহিদী জনতা লং-মার্চের ডাক দিল না। তাদের গলার কাটা হিসেবে দেখা দিল বরং “পাক সার জমিন সাদ বাদ” বইখানা।

মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই পড়ে নি এমন তরুন বা যুবক বাংলাদেশে কমই আছে। তার মত জনপ্রিয়তা শুধু কেবল তার বড় ভাইয়ের ভাগ্যেই জুটেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই তা ঘৃণায় পরিনত হল, কেন?
এক বড় ভাই, যিনি প্রচুর বই পড়েন, একদিন জানালেন জাফর ইকবালের প্রায় প্রতিটা সায়েন্স ফিকশন আসলে বিদেশী গল্প থেকে মেরে দেয়া। বিষয়টা জেনে যারপরনাই হতাশ হয়েছিলাম। কিন্তু অবাক হই তার এই প্রবণতা প্রায় দশ বছর পর আজ লোকের চোখে পরছে। এবং তাই না, হঠাৎ করেই সবার চোখ খুলে গেল, সবাই বুঝে গেল তার গল্পের ভিলেন সব ধার্মিক এবং ধর্মীয় লেবাস পরা, তিনি নাস্তিক, তার লেখার প্রতিটা পরতে পরতে নাস্তিকতা, প্রতিটা লাইনে তিনি কৌশলে নাস্তিকতা শিখিয়ে যাচ্ছেন!

এবং এমন “চোখ খুলে যাওয়া”র কারণ একটাই, তিনি একটা গোষ্ঠির সমালোচনা করেন, এমনকি তাদের নিয়ে সাদাসিদা কলামও লিখেন।

এদিকে লেখিকা তসলিমা নাসরিনের অপরাধ ছিল তিনি “লজ্জা” নামে একটা উপন্যাস লেখেন, যেটা মূলত বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার কারণে মৌলবাদীদের হিন্দু নির্যাতনের পরিসংখ্যান-সর্বস্ব। এতেই মৌলবাদীরা তার কল্লা চায়! এ কারণে তাকে নির্বাসনেও যেতে হয়!

ব্লগার “থাবা বাবা” আদপে ধর্ম নিয়ে কি পরিমান কটুক্তি করেছিল আমার জানা নেই, তার কোন লেখা আমি পড়িনি। তবে লেখাগুলো নাকি বেশ পুরোনো, প্রায় ৫-৬ বছর আগের। কিন্তু ৫-৬ বছর আগে তাকে কেউ হামলা বা টার্গেট করেনি, তাকে খুন করা হল অনেক পরে, যখন তিনি শাহবাগে গেলেন।

উপরের উদাহরণগুলোয় আমরা কি দেখতে পাই? আমাদের আক্রমণাত্মক ও হিংসাত্মক ধর্মানুভূতির স্বরূপটা আসলে কি? কেবল ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি আঘাত করার কারণেই কি একজন ব্যক্তি কারো টার্গেটে পরিণত হচ্ছে? নাকি ধর্ম কেবল ঢাল মাত্র, আসল উদ্দেশ্য অন্য? আজকে অভিজিৎ রায় খুন হলে ধর্মের দোহাই দিয়ে উল্লাস করছেন, তারা একবার ভেবে দেখুন আপনারা কাদের টুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন, কাদের অপরাধকে না জেনে জাস্টিফাই করছেন। একবার ভেবে দেখবেন।

৬১২জন ৬১২জন
0 Shares

৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ