আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে যেমন বড় বড় রুইকাতলা বের হয়ে যায় তেমনি আইনের জালে অনেক সময় বেকসুর লোকও আটকা পড়ে। আমরা সাধারণ মানুষ আইন আদালতের কথা শুনলেই আৎকে উঠি। উঠারই কথা। কারণ, শরীরে একটা রোগ হলে তা হয়তো সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বা শরীরের কোনো অঙ্গ পঁচে গেলে তা কেটেও হয়তো বেঁচে থাকা যায়। আর না সারলেও ভোগে শুধুমাত্র রুগি। কিন্তু আইনের জালে আটকা পড়লে সেখান থেকে বের হওয়া মুশকিল। আর এতে ভোগে পুরো একটা পরিবার। রোগে ভুগতে থাকলে মানুষের সহানুভূতি পাওয়া যায় কিন্তু কোনো সঠিক কারনে বা বিনা কারনে আইনের আওতায় আসলে সে ব্যাক্তি ও তার পরিবার পুরো সমাজের চোখে একপ্রকার অচ্ছ্যুতই হয়ে যায়।
একটা ঘটনা দিয়ে আলোচনাটা শুরু করা যেতে পারে।
পাবনার এক বাসায় আমি ভাড়া থাকতাম। আমি মানে তিনি থাকতেন। আমি মাঝে মাঝে যেতাম। দুইতলার একটা ফ্ল্যাট বাসা। দোতলায় বাড়ির মালিক বৌদির সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। খু্বই সংসারী এক পরিপাটি নারী যাকে বলা চলে। স্বামী, দুই মেয়ে, শাশুড়ী ও দেবর নিয়ে পরিপূর্ণ এক সংসার তার। এতোবড় সংসারে কাজের সহকারী ছাড়া নিজে পুরো সংসার সামলাতে গিয়ে বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়া একটু কষ্টসাধ্যই বটে। তাও যদি বাচ্চারা ছোটোছোটো হয়।
তার দেবরের সাথে পাশেরই এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একরকম নিন্মশ্রেণীরই বলা চলে। আমি কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে হিসেব করে বলি নাই। বলেছি তাদের পারিবারিক আচার আচরনের কারনে। সহজ ভাষায় উচ্ছুন্যে টাইপ। একদিন ঐ মেয়ে তার দেবরের রুমে এসে ডেটিং করার সময় বৌদি তা দেখে ফেলে এবং বৌদি একরকম মেয়েটিকে ধমক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
সবথেকে বড় কথা বৌদি একদম উচ্চস্বরে কথা বলেনি। শুধুমাত্র একটা ধমক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। কারণ, মানসন্মান ও লোক জানাজানি হওয়ার ভয়ে। আমি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। মেয়েটিও কম যায় না! সে পরের দিন তার মায়ের সাথে থানায় গিয়ে মামলা করে। আর নারী সংক্রান্ত এমন সব মামলা মিথ্যা কি সত্য তা যাচাই করার আগেই নিতে হয়। আর এ আইনটি হলো এমন যে কোনো প্রকার স্বাক্ষীর দরকার হয় না। সে ভিকটিম অর্থাৎ মেয়ের অভিযোগই যথেষ্ট। আর মেয়েটি শারাীরিক সম্পর্ক স্থাপনের কারনে মেডিকেল রিপোর্টও ওদের পক্ষে চলে আসে।
যাইহোক মামলা হলো মানে এখন কার্যকর এর পালা। যথারীতি পুলিশ এসে বৌদিসহ তার দেবরকে এ্যারেস্ট করে নিয়ে গেলো। আমি আবার ঘটনার পরের দিনই চলে আসি শশুরবাড়িতে। আসলে তখন আমি শশুরবাড়িতেই থাকতাম। তাই মামলা করা ও এ্যারেস্ট করার সময় আমি ওখানে ছিলাম না। নতুবা এ কাজটা হয়তো সহজ হতো না। অন্তত বৌদির মতো মানুষকে এ্যারেস্ট করাটা ও তার বিরুদ্ধে মামলাটা নেয়া।
যাইহোক মামলাটা এরকম ছিলো যে, মেয়েটি বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো আর বৌদি তার চুলের মুঠি ধরে মুখ চিপে জোর করে তার দেবরের ঘরে নিয়ে আসে। আর তার দেবরের হাতে সে নির্যাতিত হয়!! যা একেবারেই বানোয়াট। সত্যি, আমি যদি সেখানে উপস্থিত না থাকতাম তবে হয়তো আমিও তাদের ফাঁসি চাইতাম।
আর মামলাটা তথ্যপ্রযুক্তির আইনেও চলে আসে। কারণ, মেয়েটির মোবাইলে ও ছেলেটির মোবাইলে তারা তাদের প্রেমের ভিডিও আপলোড করে। যা তাদের উভয়ের ইচ্ছাতেই হয়েছিলো। মেয়েটি তাই মামলাতে উল্লেখ করে। যথারীতি ছেলেটির মোবাইলে ওসব একান্ত ছবিগুলো পেয়ে যায়।
মামলাটি তাই আরো পাকাপোক্ত হয়।
এ মামলাটিতে কিছুতেই বৌদির জামিন হচ্ছিলো না। তার দেড় বছরের দুধের বাচ্চাটির যে কি অবস্থা তা আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি বাচ্চাটির কান্না দেখে হু হু করে কেঁদেছি। আশেপাশের মানুষ কেঁদেছে। আর ওর মায়ের জেলখানায় কি অবস্থা তা আসলে মা হিসেবে বুঝতে পারি কিছুটা।
এবার আসি জেলখানায় এরকম নীরিহ ঘরের ভদ্র মেয়ে বা মহিলারা কীভাবে থাকতে পারে। জেলখানার পরিবেশ কেমন মোটামুটি তা আমরা সকলেই জানি। ছোটো একটা রুম। সেখানে শোয়ার সামান্যতম ব্যাবস্থা নেই। একজন মানুষ কোনোরকম যদিও শুতে পারে পাশ ফেরার উপায় নেই। বালিশ তো নেই। বাথরুমে একজন গেলে কোনোরকম বাথরুম সারার আগেই লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলো চিল্লাতে থাকে। কেনার পর থেকে গায়ে দেয়া কম্বলগুলো কখনোও ধোয়া হয়েছে কিনা তা সন্দেহ। সে এক দুর্বিসহ দিনই বলা চলে।
জেলখানায় শুধু খারাপ মানুষই থাকে না অনেক ভালো মানুষও যায়।
প্রায় চার মাস জেলে থাকার পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বৌদির জামিন হলো।
একপর্যায়ে কোর্টে মেয়ে পক্ষের সাথে একরকম মিটমাট হওয়ার পরে সে মামলা থেকে বৌদি রক্ষা পায়। তবে তার তিল তিল করে গড়ে তোলা বেশকিছু গয়না টাকা পয়সা জমি শেষ হয়ে যায়। আজকের তার এই ভালো অবস্থানে আসার পিছনে যথেস্ট পরিশ্রম ও ত্যাগ করতে হয়েছে।
কিন্তু পরিশ্রম করে হয়তো সে সব সম্পদ আবারো ফিরে পাবে৷ কিন্তু মানসম্মান? তা কি করে ফিরে পাবে? অবশেষে চির অভিমানে তারা তাদের বাকি সম্পত্তি বিক্রি করে এদেশ ছেড়ে চলে যায় ইন্ডিয়া।
কিন্তু এটা কি সমাধান হলো? যে দেশে যার জন্ম, যে দেশে বেড়ে ওঠা সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে হলো অন্য একটি দেশে। সে দেশেও কি পারবে সে সহজে সবকিছু মেনে নিতে মানিয়ে নিতে? পারবে না। ইন্ডিয়ার মতো দেশে বাংলাদেশিদের সেরকম হয়তো ভারো কিছ করার মতো থাকে না। কারণ, জন্মভূমি মানেই জন্মভূমি।
আমরা অনেক সময় দেখি প্রাপ্ত বয়ষ্ক একজন নারী বা কোনো দুই সন্তানের মা যখন কোথাও থেকে প্রতারিত হয় সে একটা মামলা ঠুকে দেয় যে তাকে ফুসলিয়ে ওমুক যায়গা নিয়ে গিয়ে এতোদিন ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। আসলে কি বিষয়টা তাই? মোটেও না। ফুসলিয়ে কথাটির মধ্যেই তো মিথ্যা লুকানো আছে। হ্যাঁ দিতে পারে প্রতারণার মামলা। কিন্তু প্রতারণা আসলে কিসের? যে মহিলা স্বামী সন্তানকে ছেড়ে অন্য একটি লোকের সাথে চলে গেলো সে কি করে প্রতারণার মামলা করতে পারে!
একজন মানুষ বিনা বিচারে দিনের পর দিন জেল খেটে বের হয়ে এসে সে কি পারে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে?
আর উচ্চ আদালতে যদি একটি মানুষের সে অপরাধ যদি সত্যিই প্রামণিত না হয় তবে কেনো নিন্ম আদালত ও সে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কোনো কৈফিয়ত চাওয়া হয় না?
তবে হ্যাঁ, এক্ষেত্রে অনেকেই প্রচুর টাকা পয়সা খরচ করে উচ্চ আদালতে পার পেয়ে যায়। এর আরো একটা কারণ, আছে আর তা হলো ততোদিনে স্বাক্ষী পাওযার ব্যাপারটা। মামলার আলামত সঠিকভাবে সুরক্ষিত থাকার ব্যাপারটাও এখানে একটা বড় কারণ।
আমরা সাধারণ নাগরিক হিসেবে চাই সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ হোক। হোক আইনের সঠিক ব্যাবহার।
সকলকে শুভকামনা।
রিতু
কুড়িগ্রাম।
১৩টি মন্তব্য
মাহমুদ আল মেহেদী
জেলখানায় শাস্তি দেওয়ার আগেই শাস্তি হয়ে যায়।অনেক সুন্দর একটা বিষয় তুলে ধরেছেন ।
রিতু জাহান
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকুন সর্বদা। শুভকামনা রইলো।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আমরা সাধারণ নাগরিক হিসেবে চাই সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ হোক। হোক আইনের সঠিক ব্যাবহার….
তা হয়তো চাইতে পারি কিন্তু হবে বলে মনে হয় না কারন এ সব চাকুরী নিয়োগের শুরুতেই যে গলদ।জমি জমা বিক্রি করে নিয়োগে লগ্নিতো শোধ হতে হবে।আর বিচারের ক্ষেত্রে অসংখ্য মুহুরী বা এডভোকেট নামক দালাল থাকে যারা উৎ পেতে থাকেন।একটি মামলা পেলেই হল ন্যায় কি অন্যায় কোন বাছবিচার নাই মামলাকারীকে নিঃস্ব করে ছাড়বে।তাই এ ক্ষেত্রে সরকারী মনিটরিং এর পাশাপাশি জনগণের সচেনতা ও প্রতিবাদী হতে হবে ঠিক আপনার মতন তাহলে হয়তো সুশাসন কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে।
ধন্যবাদ।
রিতু জাহান
আমরা আসলে মনে হয় নাগরিক অধিকারগুলো কি কি তাই হয়তো জানি না। কোর্টের মুহুরী দালালদের নিয়েও লিখব।
ভালো থাকুন মনির ভাই।
সাবিনা ইয়াসমিন
সঠিক আঈনের প্রয়োগ যদি নিশ্চিত করা যেত তাহলে এমন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে হয়তো কেউই পরতো না। ইদানিং পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই যে খবর গুলো দেখতে পাই তাহলো, সন্দেহ ভাজন মামলায় পুলিশের গুলিতে নিহত বা বন্দুক যুদ্ধে এমুক তমুক লোক আহত। অনেকেই সে গুলোর পক্ষেও থাকে, পুলিশ ও আঈনের লোকদের উৎসাহিত করে নানা কমেন্ট দিয়ে।
আমার কথা হলো কেন ? সন্দেহ করে মানুষকে গ্রেফতার , হত্যা বা আহত না করে আঈনের আওতায় রেখে সঠিক বিচার করা কি একেবারেই অসম্ভব ?
আর একজন নারী হয়ে অন্য নারীদের নিয়ে কথা বলাটা অনেকেই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন। বর্তমানে নারী প্রতারনার বেশিরভাগ মামলাগুলোই সার্থগত মনে হয়। পরকীয়া জনিত ঘটনা গুলোই পরবর্তিতে প্রতারনা মামলার রুপ নেয়। এইসব নারী নামের কলঙ্কগুলো সমাজটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ।
অনেক দিন পর তোমার চমৎকার একটি সামাজিক পোষ্ট পেলাম। খুব ভালো লিখেছো বরাবরের মতোই। অনেক ভালো থেকো প্রিয়। শুভ কামনা অবিরত,,,❤❤❤❤
রিতু জাহান
পুলিশের দূর্ণিতির চেয়ে কোর্টের অবস্থা আরো ভয়াবহ।
মনে করো তাৎক্ষণিক যদি প্রমাণিত হয় যে এই লোক ধর্ষক তবে আমি সেক্ষেত্রে ক্রসফায়ারের পক্ষে।
এমনকি মাদকবহনকারী সে মাদক ব্যাবসায়ীর ক্রসফায়ারের পক্ষেও আমি। কোনো কথা হবে না। যাস্ট একটা গুলি।
হ্যাঁ, আগের মতো এরকম পোষ্ট লেখার চেষ্টা করব। আগে ব্লগে এমন সব অসংগতি নিয়েই লিখতাম আমি।
ভালবাসা নিও। ভালো থেকো। পাশে থেকো।
জিসান শা ইকরাম
আমাদের মন মানসিকতা অত্যন্ত নিম্নস্তরের, যেকারনে আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজন, প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন এর সুযোগ নেয়। সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত দেশ সমুহে এমন হয়রানী মুলক মামলা হয়না। এমন বিষয়ের মামলার কথা কারো মনেই আসেনা।
দুদকের এক মামলায় এক ব্যাক্তিকে পুলিশ এরেস্ট করে নিয়ে এসেছে. অথচ যে অপরাধী সে এই লোক না, ৪ বছর সে অন্য মানুষ হিসেবে জেল খানায়। এই তো আমাদের দেশের বিচার ব্যাবস্থা।
মিথ্যে মামলাকারীদের উলটো বিচারের আওতায় এনে বিচার করা উচিৎ।
সামাজিক সমস্যা নিয়ে অনেক ভালো একটি পোস্ট দিলে।
রিতু জাহান
শুনছি মিথ্যা মামলা করলে এখন শাস্তির বিধান আসতেছে।
হ্যাঁ, ভাইয়া এখন এমন কিছু পোষ্ট লিখব ভাবছি।
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইলো ভাইয়া।
ছাইরাছ হেলাল
আলোর সাথে কিছু অন্ধকার থেকেই যায়!
যারা বা যে ভুক্তভোগি হয় সেই জানে এর যন্ত্রণা।
সচেতনামূলক লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
চালু রাখুন।
রিতু জাহান
কৃতজ্ঞতা রইলো গুরুজী। দোয়া রাখিয়েন।
মোঃ মজিবর রহমান
সুন্দর একটি লেখা আপু। এর প্রেক্ষিত অনেক কাহিনী ও ঘটনা মনে পড়ে। তাহল,
১. পুলিশের গ্রেপ্তার করলে যেভাবেই হোক তাঁর বাড়ি বা অভিভাবককে জানাতে হবে,
২. লোভ লালসা ত্যাগ করে আসল অপ্রাধী সনাক্ত করা।
৩. পথেঘাটে সময় অসময়ে ইচ্ছে করে গ্রেপ্তার করলে তাতক্ষনিক তাঁর পরিবারকে জানান
৪. অবৈধ্য স্বাক্ষি বা ভাড়া স্বাক্ষি থেকে বিরত করা।
আমি আমার জীবনে বেশ কিছু অপকর্ম পুলিশের দেখেছি, সেখান থেকে মনে করলে মনে হবে এরা অমানুষ। আবার এমন পুলিশও দেখেছি তাঁরা অতিসততায় মানুষকে মুগ্ধ করে।
তৌহিদ
আমাদের দেশের আইনে কিছু ফাঁকফোকর আছে। আর আছে কর্ম অদক্ষতা। এরকম মামলায় ভিক্টিমের কথাই সবাই গন্য করে। একবারো ভাবেনা সে মিথ্যে না সত্যি বলছে। আর দেশের মানুষ পুলিশি হয়রানীর ভয়ে স্বাক্ষী দিতে যায়না। ফলে অনেক নিরপরাধ মানুষ সাজা ভোগ করে। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখাটি ভালো লাগলো আপু।
সুরাইয়া পারভিন
কথায় তো আছে আইনের চোখ অন্ধ
কোনো কিছুর সত্যতা যাচাই করার দরকার মনে করে না বলেই কতো নির্দোষ মানুষকে শাস্তি পেতে হয়