টাকা মানুষকে বদলায়, নাকি মানুষ টাকাকে বদলায়? যেভাবেই বলা যাক না কেন, অর্থ যে সকল অনর্থের মূল, চিরন্তন এই বাণীই কঠিন সত্য। হঠাৎ যারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়, তারাই পাল্টে যায়। এ জীবনে তো কম দেখা হলোনা! যে একসময় হৃদয়ের খুব কাছের ছিলো, সে-ই একসময় অর্থের অহঙ্কারে তার পা ফেলেনা। বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তরা নিজেদের বদলে ফেলে অর্থের কারণে। তারা হাত পাততে দেরী করেনা আর একসময় তাদের হাতে যখন অঢেল সম্পদ, তাদের থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যায়না। অনেক কথাই বলে ফেললাম। এবারে আসি কিছু উদাহরণে। নামগুলো ভিন্ন, কিন্তু কাহিনী সত্যি।
এক : অধরা এবং মেঘলা দুজনেই খুব ভালো বন্ধু। মেঘলার জীবন খুবই কষ্টের, খেটে খাওয়া জীবন। আর অধরা বড়োলোক না হলেও আর্থিকভাবে সচ্ছল। যদিও অর্থ তার জীবনে কখনো অনর্থ আনেনি। আর তাই সবসময়ই মেঘলার প্রতিটি কষ্টে অধরা পাশে থাকে। হঠাৎ ভয়ঙ্কর অসুখে শয্যাশায়ী হলো অধরা। তারপর ওর চাকরি চলে গেলো, তারপর থেকে একটু একটু করে বদলে গেলো মেঘলা। তার গাড়ী হলো, বাড়ী হলো, অর্থকড়ি হলো। কিন্তু অধরার জন্য তার আর সময় নেই। একটু মাথাব্যথা হলেই যে মেঘলা অধরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো, আজ চলৎশক্তিহীন অধরা একা, বড়ো একা।
দুই : হিমেলরা খুবই গরীব। তাদের অবস্থা এমনই যে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। পরিবারে ছয়জন সদস্য। চাকুরীজীবি একজনই হিমেলের বাবা। টানাপোড়েনের সংসার শুধু উনার আয়েই চলে। তো একদিন হিমেলদের বাসায় এসে ওঠে তার এক কাজিন অরূপা। অরূপা ওখানে একটা নামকরা কলেজে পড়ার জন্য সুযোগ পায়, কোনো হোস্টেল না থাকায় হিমেলদের বাসাতেই এসে ওঠে। অরূপার বাবা ওখানে থাকা-খাওয়ার জন্য হিমেলের বাবাকে টাকা দিতে চায়, কিন্তু উনি সে প্রস্তাব খুবই ভদ্রতার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। তাই অরূপার বাবা প্রতি সপ্তাহে এসে বাজার করে দিয়ে যেতেন। একসময় অরূপার কলেজজীবন শেষ হয়। অরূপা চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। ওদিকে হিমেলের হঠাৎই আমেরিকা প্রবাসী একটা মেয়ের সাথে পরিচয় থেকে প্রেম হয়ে যায়। বিয়ে করে হিমেল চলে যায় বিদেশ। দিনে দিনে হিমেলদের আর্থিক অবস্থা ফিরে যায়, সুদিন এসে পড়ে। কিন্তু হিমেল এবং তার পরিবারের মন-মানসিকতার একটুও বদল হয়নি।
তিন : চৌধুরী সাহেব এলাকার বেশ গণ্যমান্য একজন ব্যক্তি। আর্থিকভাবে তিনি আহামরি কিছু নন, সাধারণ একজন চাকুরীজীবি। তবে উনার ব্যবহার এবং সততার কারণে সকলেই উনাকে ভালোবাসেন এবং শ্রদ্ধা করেন। সকলেরই উপকার করেন, উনার দ্বারা কখনোই কারো অপকার হয়নি। সবসময়ই উনার বাসা ভরপুর থাকতো। কেউ না কেউ কোনো না কোনো সমস্যা নিয়ে আসতেন সমাধানের জন্য। এমনও হয়েছে নিজে ধার করে অন্যকে সাহায্য করেছেন। নিজে কখনো তোষামোদ করেননি, আর সহজ-সরল ছিলেন বলে বুঝতেও পারেননি উনাকে ঘিরে আছে তোষামোদকারীদের দল। একসময় চৌধুরী সাহেব চাকুরী জীবন থেকে অবসরে গেলেন। যারা উনাকে ঘিরে ছিলো, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করলো। শুধু তাই নয় যাদের উপকার করেছিলেন তিনি, সেসব মানুষরা চৌধুরী সাহেবের আর খবরই করেনি।
চার : বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব ভালো বিষয়ে সুযোগ পেয়েও পড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন রূপক আহমেদ। নিজের ভাই-বোনকে পড়ালেখা করিয়ে মানুষ করবার জন্য কোনোভাবে একটা চাকুরী যোগাড় করলেন। একসময় ভাই-বোনেরা প্রতিষ্ঠিত হলো, কিন্তু রূপক আহমেদ দুঃসময়ে কোনোরকম সাহায্য তো পেলেনই না, বরং অপবাদ পেলেন। উনি নাকি বাবার টাকা-পয়সা, সম্পত্তি-জায়গাজমি করায়ত্ত করেছেন। আর ওসব দিয়েই ভাই-বোনকে লেখাপড়া করিয়েছেন। রূপক আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, সেই সময় যদি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করতেন, আজ অনেক ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন।
পাঁচ : খুবই দরিদ্র পরিবারের মেয়ে উজালা। টানাটানির সংসার তার। লেখাপড়ায় বেশ ভালোই ছিলো, কিন্তু চালিয়ে যেতে পারেনি। উজালার বড়ো বোন একটা সম্বন্ধ নিয়ে এলো। বিয়ে হয়ে গেলো। পাত্র সচ্ছল, মানুষটাও ভালো। আস্তে আস্তে উজালার আর্থিক অবস্থা ভালো হলো। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে উজালার মন-মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। সে আগের মতোই নিরহঙ্কারী, সহজ-সরল মনেরই থেকে গেছে।
এমন আরোও অনেকের ঘটনা আছে। যা লিখতে গেলে বিশাল বড়ো হয়ে যাবে। অর্থ কীভাবে একজন মানুষের চরিত্রকে বদলে দেয়, এই কয়েকটি কাহিনির মধ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। সত্যি বলতে গেলে খুব কম মানুষ আছেন, অর্থ যাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারেনি।
☀🌞শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা সকলের জন্য।🙏🙏
হ্যামিল্টন, কানাডা
১৩ এপ্রিল, ২০১৯ ইং।
২২টি মন্তব্য
সাবিনা ইয়াসমিন
অর্থ যত অনর্থের মূল একথাটা খুব অসত্য নয়। আবার কিছু কিছু মানুষের জন্যে এই কথা পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়। আসলে ভালোমন্দ মিলিয়েই মানুষ। অনেক সময়েই অর্থকে শক্তি হিসেবে ভাবা হয়। কারণ অর্থ মানুষের মৌলিক এবং লৌকিক দুই ক্ষেত্রেই কাজে আসে। কিছু মানুষের প্রবৃত্তি শুরু থেকেই খারাপ থাকে, পর্যাপ্ত অর্থ বা শক্তি না থাকার কারনে সেটা তাদের মাঝে চাপা পড়ে থাকে। আবার কিছু মানুষের ভেতরটা এত সাধারণ আর নির্লোভ থাকে যে, তাদের অন্তরটাই তাদের চালিকা শক্তিতে পরিনত হয়।
কতটা বুঝতে পেরেছি জানি না। হয়তো আরো পড়ে কমেন্ট দিলে ভালো হতো। প্রথম হতে চাওয়ার আনন্দ নেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি কমেন্ট দিলাম। 😊😊
ভালোবাসা সব সময় ❤❤
নীলাঞ্জনা নীলা
চমৎকার বলেছেন আপু। ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ।
অনেক ভালো থাকুন।
প্রহেলিকা
সুন্দর, চোখের সামনে এমন অনেক কিছু আমিও দেখেছি। বাস্তবিক কিছু উদাহরণ দিয়ে আপনি আবারও প্রমাণ করলেন সবাইকে আসলে এক পাল্লায় মাপা যায় না। আপনার ভাবনার গভীরতা, দর্শন আর প্রকাশকে হিংসে করি।
নীলাঞ্জনা নীলা
হুম এক পাল্লায় সবাইকে মাপা যায়না, ঠিকও নয়।
ভালো লাগে মন্তব্য পেলে। লিখতে সাহস পাই।
মাহমুদ আল মেহেদী
চমৎকার ভাবে বলেছেন, বুঝিয়েছেন এবং ভালোলাগিয়েছেন, বাস্তব সব ঘটলাগুলো যা আমরা দেখি, বুঝি, জানি তারপরও যেন সব অধরা অজানা।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমরা মানুষ এমনই বদলে যাই। কিন্তু পজিটিভ পথে কতোজন আর পাল্টাই বলুন?
ভালো থাকুন।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার দেখার চোখ থেকেই লিখেছেন, চুড়ান্ত বাস্তবতার কথা,
এগুলোই এখন নিয়ম, ভাল বা মন্দ।
তবে আপনি আমাকে কিছু অর্থ দিলে কথা দিতে পারি আপনার সামান্য
অনর্থ করেই ছাড়ব, আপনার বৃহৎ হৃদয়ে ভেবে দেখতে পারেন।
এক খান কবিতা হবে!! জটিল!!
নীলাঞ্জনা নীলা
বরং আমায় কিছু অর্থ দিন, সঠিকভাবে খরচ করবো নিশ্চিত।
জটিল কবিতা, সেটা আবার কি? ওই ব্যাপারে আপনিই তো একাই একশো। 😁
ছাইরাছ হেলাল
এড়িয়ে যাওয়া খুব সহজ কাম।
নীলাঞ্জনা নীলা
এড়িয়ে আর যাবো কোথায়!
সীমার বাইরে কেবলই সীমা
অস্থিরতা গ্রাস করে কেবল, গলা চেপে বসে থাকে একশো একটা স্মৃতি।
কোথায় যাবো আমি!
বৃত্তের বাইরে কেবলই বৃত্ত এঁকে চলছে শ্বাস-প্রশ্বাস।
আরজু মুক্তা
লিখা আসে যখন অনুভূতিগুলোর তীব্র দহন মাথার ভিতরে আসে!আমাদের ব্যস্ততা ছুটি দেয়না!কি আর করা!মনের জানালা মাঝে মাঝে খুলে কথা বলার চেষ্টা করা আরকি!জানালায় বাতাসের তীব্রতা না থাকলেও ক্ষতি নেই!মৃদুমন্দ বাতাস তাকলেও চালিয়ে নেয়া যাবে!
নীলাঞ্জনা নীলা
বাহ! এতো সুন্দর মন্তব্য!
মুগ্ধ হোলাম।
ভালো থাকুন।
শুভ নববর্ষ।
তৌহিদ
অর্থ অনর্থের মুল এটা নিজের জীবনেই পরিক্ষিত আপু। আর অর্থ হলেও অনেক ক্ষেত্র মানুষের আচরন ব্যবহার পরিবর্তন হয়না।
প্রত্যেকটি লেখাই প্রমান করে আপনার জীবনদর্শন কতটা নিখুঁত। মুগ্ধতা রেখে গেলাম আপু।
শুভ নববর্ষ 🌹
নীলাঞ্জনা নীলা
আসলে এসব মানুষ আমাদের চারপাশেই আছে। মিষ্টি মুখ আর স্বার্থপর হৃদয়ের কী দারুণ রসায়ন দেখেছি আমি নিজেই। স্বার্থপর আমরা সকলেই, তবে যারা বিপদের সময় পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ বলে আমি মনে করি।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
তৌহিদ
শুভেচ্ছা জানবেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
ভালো থাকুন।
জিসান শা ইকরাম
ঘটনাগুলো আমাদের চারপাশের অত্যন্ত চেনা জানা,
অর্থ কাউকে পাল্টায় আবার কাউকে পাল্টায় না।
যারা মন মানসিকতায় অত্যন্ত দরীদ্র তারাই অর্থের মধ্যে এসে অহংকারী হয়ে যায়।
ভালো লিখেছ নাতনী।
শুভ কামনা।
নীলাঞ্জনা নীলা
নানা দারুণ বলেছো তো, মন-মানসিকতায় দরিদ্র। বাহ দারুণ! তুমি-আমি কিন্তু বিশাল বড়োলোক, তাই না?
অনেক ভালো থেকো।
শুভ নববর্ষ নানা। 🌹🌹
রিতু জাহান
এমন অনেক বাস্তব চিত্র প্রতিনিয়ত দেখি আপু।
হাসি পায় যারা টাকার বান্ডিলের সাথে নিজেদের চরিত্র যখন পাল্টে ফেলে। আবার তাদেরই দেখেছি হঠাৎই পড়ে যেতে।
যারা সব সময় একই রকম চলে তাদের কখনোই সমস্যা হয় না আপু।
তাদের জীবন সহজ হয় না তবু থেমেও থাকে না।
বেশ লিখেছো
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু আজকাল আঙুল ফুলে কলাগাছ সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই এমন অবস্থা।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ভালোবাসা শান্তসুন্দরী আপু।
নাজমুল হুদা
অর্থের সাথে মানুষের মানসিক পরিবর্তন অবশ্যই লক্ষণীয়।
তবে সেটা যেন হয় অর্থনীতির চাহিদা রেখা বা যোগান রেখার মতো। আবার ভারসাম্য রেখাও যেন হয়।
ধন্যবাদ আপু ভালো লাগলো লেখাটি।
সাখিয়ারা আক্তার তন্নী
হঠাৎ যারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়, তারাই পাল্টে যায়।
আপু,এই কথাটা চিরন্তন সত্য।