গ্রামের বাড়ি থেকে খবর এলো চাচাতো বোনের বিয়ে। যেমন তেমন নয়, আপন চাচাতো বোন, তার বিয়ে। আমি বলে দিলাম, “যাবো নাহ্।” কেন যাবো না? কারণ আমার পরীক্ষা। কী পরীক্ষা? ৭ম শ্রেণির ১ম সাময়িক পরীক্ষা! এটাও কি এমন কোন পরীক্ষা যে একটা দিতে না পারলে জীবনে বড় কোন ক্ষতি হয়ে যাবে? আমার কাছে তাই…কারণ এটা দিতে না পারলে ক্লাসে প্রথম হতে পারব না। মনে পড়ে সেই যে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম, এর পর থেকে জীবনের সকল হাসি আনন্দকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছিলাম ক্লাসে ১ম হবার মাঝেই! শিক্ষা জীবনের শেষ অব্দি (মাস্টার্স) এর থেকে বের হতে পারিনি। আমার কষ্ট মানে কারো থেকে ২/১ নাম্বার কম পাওয়া, আর সুখ মানে ক্লাসে ১ম হওয়া।
এই যে প্রতিযোগিতা, এটা আমাকে কি দিলো? হ্যাঁ দিয়েছে হয়ত এককালীন কিছুটা সুখ, একটু বাড়তি কেয়ার। মা, বাবা মুখভরে মানুষকে বলতে পারত “আমার মেয়ে ক্লাসে ১ম হয়েছে!” কিন্তু কেড়ে নিয়েছে বিশাল কিছু! আমি পুতুল খেলতে বসেও পড়ার চিন্তা করতাম। খেতে বসে তাড়াহুড়ো করতাম।বৌ ছি আর দড়িলাফ খেলে অবশ্য খুব আনন্দ পেতাম। এছাড়া আর কোন খেলা আমাকে তেমন টানেনি। লুকিয়ে ‘তিন গোয়েন্দা’ পড়লেও মাথায় থাকতো পরীক্ষার টেনশন। আমি কোনদিন কোন আত্মীয়ের বিয়েতে পুরোটা উপভোগ করতে পারিনি। অথচ বৌয়ের জন্য কেনাকাটা, শপিং, লাগেজ গোছানো হৈহৈ করা এসব আমাকে খুব টানে! মন চাইতো আগে থেকে গিয়ে কদিন ধরে আনন্দ উপভোগ করি। কিন্তু ঐ যে পরীক্ষা, ওটা আমাকে সব কিছু থেকে থামিয়ে রাখতো।
কিসের সাথে কি মেখে মুখ শাদা করা লাগে, কি দিয়ে কি সাজতে হয়, চুলে কত রকম স্টাইল করা যায়, কোনটাই আমি শিখিনি। আমি জানি কোন বই কোন পরীক্ষায় কাজে লাগে। কখন কেমন ব্যাগ কাঁধে ঝোলালে স্মার্ট লাগে, কিসের সাথে কি মিলিয়ে পরা লাগে এতসব ভাবতে গেলে আমার মাথা ভারী হয়ে আসে। মনে হয় এর থেকে কঠিন বোধহয় আর কিছু নেই। আমার ধারনা সবেতেই আমাকে বেমানান লাগবে। তবে আমি জানি কোন রচনায় কি কি পয়েন্ট দিলে মার্কস বেশি আসবে। ছোটবেলা থেকেই নোট করে পড়েছি।
জীবনের কত হাসি,আনন্দ, রং,রস,মিষ্টান্ন সবকিছু উপেক্ষা করে শুধু বৈ (বই) এর মাঝে মুখ গুঁজেছি। চাকরী পেতে হবে এমন মনোভাব তখন ছিলো না। তবে মনে হতো আমাকে একটা ভালো কিছু করতে হবে। বাবা মাকে ভালো রাখতে হবে। নিজের জীবনে যত রকম উপেক্ষা দু চোখে দেখেছি তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। সফল হতে হবে।
অথচ জীবন পানি করা এই সনদগুলো, যা অর্ধেক জীবন কয়লা করে অর্জন করলাম, তা আর কদিন পর অকেজো হয়ে পরবে। মুখ থুবড়ে পরবে আমার সারা জীবনের সঞ্চয়! বাকি জীবনটা এত এত এত বড় যে…
আবার যদি একটা সুযোগ পেতাম, ফিরে যেতে পারতাম বাল্যকালে, তাহলে কি করতাম? শুধু মাত্র পরীক্ষা পাশের জন্য যে ৩৩ পেতে হয়, ততটুকুই তুলতাম। আর বাকি দিনগুলো, দিনের বাকি সময়টুকু নিজের মনের ইচ্ছে মত খরচ করতাম। মন যেটাতে অগাধ সুখ পায়, কেবল তাই করতাম। হুম…
১৮টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ আপনাকে এতো সুন্দর করে কথাগুলো বলার জন্য। সত্যিই তো কোন কিছু পাবার জন্য দেখা যায় অনেক সুখ চাওয়া পাওয়া বিসর্জন দেই। দিনশেষে ফলাফল শূণ্য। জীবন একটাই একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না তেমনি শৈশব কৈশোর চলে গেলেও ফিরে আসে না। সবকিছু উপভোগ করার জন্য একটা বয়স, সময় থাকে সেটা পেরিয়ে গেলে আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। শুভ কামনা রইলো
নীরা সাদীয়া
তা ঠিক বলেছেন। অনেক শুভ কামনা রইলো।
সুপায়ন বড়ুয়া
ভালো লাগলো। করোনা বলে ঘ্যানঘ্যানি আর ভাল লাগছে না।
শুভ কামনা।
নীরা সাদীয়া
হুম, একঘেয়ে হয়ে গেছে।
ছাইরাছ হেলাল
কিছু সিন্দাবাদের ভূত আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে/রাখে।
ফিরে যেতে পারলে সত্যি সত্যি অন্য রকম কিছু হতো।
নীরা সাদীয়া
হয়ত তাই হতো…
হালিম নজরুল
লেখার স্টাইল ভাল লাগলো।
নীরা সাদীয়া
ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
সুখ যে আসলে কিসের মাঝে আছে তাই জানিনা আমরা।
তেত্রিশ পেয়ে পাশ করলে এখন আক্ষেপ হতো প্রথম কেন হতে পারিনি ?
লেখা ভাল হয়েছে।
নীরা সাদীয়া
যে যা পায় না, তাই চায়….
রুমন আশরাফ
বাল্যকালে আমরা প্রায় সবাই ফিরে যেতে চাই। ভাল হয়েছে লেখাটি।
নীরা সাদীয়া
ধন্যবাদ আপনাকে।
ফয়জুল মহী
ভালো লাগলো
নীরা সাদীয়া
ধন্যবাদ জানবেন।
তৌহিদ
আমারও মাঝেমাঝে সেই ছেলেবেলায় ফিরে যেতে চাই কিন্তু বাস্তবতা আসলে ভীন্ন এক সময়ে নিজেকে পরিচালিত করেছে। একটা সময় ৩৩ পেয়েই পাশ করার পরে মনে হতো আহা! আমিও ফার্স্ট হতে পারতামতো!!
ভালো থাকবেন আপু।
নীরা সাদীয়া
এটাই ঘটে। যে যেটা পায় না, সেটা চায়।
নাজমুল হুদা
সময়ের ধারাবাহিকতায় আমরা কিছু ফেলে আসি। আবার ফিরতেও চাই পিছনে। কিন্তু সময় আমাদের পিছনে যেতে দিবে না এটাই জীবন।
ভালো থাকবেন আপু সবসময়।
নীরা সাদীয়া
এটাই জীবন, এটাই নিয়ম।