রোকেয়াকে প্রথম যেদিন দেখি__
চুলগুলো লালচে, জট পাকানো, গায়ের রং রোদ পোড়া তামাটে, চোখজোড়া ফ্যাকাসে প্রাণহীন। ফ্রক পরিহিতা ছোট্ট একটি মেয়ে। যদিও আমিও তখন ছোটই, তবে ওঁর চেয়ে খানিক বড়। মা’কে টুকিটাকি সংসারের কাজে সাহায্য করবার জন্যে ওঁকে আনা হয়েছে গ্রাম থেকে। আগেকার অন্যসব ক্ষুদে সাহায্যকারীদের মতোই রোকেয়াকেও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হল। প্রতি ভোরে বাসার পাশের মসজিদে আমাদের সাথেই একযোগে আরবী পড়তে পাঠানো হল। আরবী পড়া শেষে টুকটাক থালা বাটি ধুইয়ে, খেয়ে, রেডি হয়ে মায়ের সাথে রিক্সায় চেপে বসতো স্কুলের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে ওঁকে স্কুলে নামিয়ে মা ছুটতেন অফিসে। আবার স্কুল ছুটি শেষে ওকে নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরতেন।
মাস খানেক বাদে রোকেয়ার গায়ের রং হয়ে উঠলো কাঁচা হলুদের মতন। চুলগুলো ঘন অন্ধকারের ন্যায়, কালো ঝরঝরে। ফ্যাঁকাসে চোখজোড়া নীলাভ, উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যদিও সেই সময়ে নীল্নয়নাকে বলা হতো বিলাই চোখ, অশুভ কিংবা অলক্ষ্মী ! তবে এটা ঠিক যে, অনটনের সংসারে অযত্ন, অবহেলায় রোকেয়ার সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সৌন্দর্য চাপা পড়ে ছিল এতদিন। একটু যত্ন, নিয়ম মেনে চলা, পেট পূরে খেতে পাওয়া __ এসবের ছোঁয়ায় তাঁর ভেতরের সৌন্দর্যটুকু বেরিয়ে এসেছিলো কেবল। বাড়িতে অতিথি এলে, রোকেয়া খাবারের ট্রে হাতে সামনে গেলে অনেকেই আমাদের বোন বলে ভেবে নিত।
রোজ দুপুরের সুনসান নিরব সময়টাতে আমরা তিন ভাইবোন বাবা-মা’র আদর, ভালোবাসার ছায়ায়, মায়ায় যখন হাল্কা ঘুম কিংবা বিশ্রাম নিতাম, সেই সময় রোকেয়া একাকি রান্না ঘরের মেঝেতে বসে করুন এক সুরে, কান্নার স্বরে গান গাইতো। অনেকখানি দুর্বোধ্য হলেও এতটুকু অন্তত বুঝা যেত, বাবা-মা, ভাইবোনের কথা মনে করে বুকের গহিন থেকে উঠে আসা এক হাহাকার ছিল সেই সুর।
অবসরে রোকেয়া তাঁর ফেলে আসা গাঁয়ের গল্প বলতো। মাছ ধরা, গাছে উঠা, সাঁতরে পুকুরের এপাড় থেকে ওপাড়ে যাওয়া, কিংবা বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবার গল্প। সেইসব গল্প শুনে শুনে ছোট্ট আমি আমার শহুরে বন্দী এক যাপিত জীবনে বসে কল্পনায় স্বাধীন হয়ে ঘুরে বেড়াতাম।বলতাম, “রোকেয়া, তুই আমায় নিয়ে যাবি তোর গাঁয়ে ? আমিও এমন করে বঁড়শী দিয়ে মাছ ধরবো, পুকুরের জলে ভেসে বেড়াবো, গাছের মগডালে বসে পাখির বাসা দেখবো, ছানাদের কিচির মিচির শুনবো।” রোকেয়া বলতো, ” আফা, আফনে আর ইট্টু বড় হন, তখন খালাম্মা যাইতে দিবো। ” আমি রোকেয়ার সবকথাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। আর ইট্টু বড় হবার স্বপ্ন দেখি।
একদিন ওঁর বাবা এসে ওঁকে গ্রামে নিয়ে যেতে চায়।অনেকদিন ভাইবোনগুলারে দেখে না, মায়েরে দেখে না। রোকেয়ার চোখজোড়া খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠে। ব্যাগ গুছায়। আম্মা ব্যাগে এটা সেটা কিনে দেয় ওঁর মা, ছোট ভাইবোনগুলোর জন্যে। খাবার, কাপড়-চোপড়, তেল, সাবান আরও কত কি ! একদিকে তীব্র উচ্ছ্বাসে রোকেয়া ওঁর বাবার হাত ধরে গাঁয়ে ফিরে, অন্যদিকে আমার ভেতরটায় সকলের অগোচরে মনখারাপের ঝড় বইতে থাকে। বুক চিরে কান্না পায়।
কথা ছিল এক মাস বাদে সে ফিরে আসবে। কিন্তু ফিরে না। এক মাস, দুই মাস, তিন মাস…। অবশেষে একদিন ফিরে। এ ফেরা আগের সেই ফেরা নয়। অন্য এক ফেরা। এক লাজুক লাজুক বালিকা বঁধুর স্বামীর হাত ধরে ফিরা ! বেড়াতে আসা। রোকেয়া ডাঙ্গর হয়েছে। ভাল পাত্র পেয়ে ওঁর বাবা-মা আর হাতছাড়া করেনি ! আম্মা নতুন জামাইকে জামাই আদরে আপ্যায়ন করে। তিনতলার চিলেকোঠার পড়ার রুমটিতে ওদের থাকতে দেয়া হয়। বাড়িতে ক’দিন নতুন জামাইয়ের সন্মানে ভাল ভাল রান্না হয়, উপহার কেনা হয়। শেষে চলে যাবার দিন কন্যা বিদায়ের মতন বেদনাবিধুর পরিবেশে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেন আম্মা। সারাটি দিন আমাদের ভেতরটা আর্দ্র হয়ে থাকে।
এরপর রোকেয়াকে আর দেখিনি। সময়ের স্রোতে ভেসে ভেসে আমরা আজ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে। ক’দিন রোকেয়াকে ভীষণ মনে পড়ছে। রোকেয়া’রা অনটনের সংসারে দু’বেলা পেট পুরে খেতে পায়না বলে সব ছেড়ে ছুঁড়ে শহরে আসে। দূর সম্পর্কের চেনা সচ্ছল কারো বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কেবলই দু’বেলা খাবারের আশায় ! অতঃপর একদিন লাশ হয়ে ফেরে। গরীবের লাশ হয়ে ফেরা কতো সহজ, তাই না ?
রিমি রুম্মান
৮ইএপ্রিল
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
২০টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
রোকেয়াকে যেভাবে আপনাদের বাসায় রেখেছেন তা জেনে মন আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠেছিল,
এভাবেই তো সব রোকেয়াদের সাথে ব্যবহার করা উচিৎ আমাদের, কিন্তু করিনা,
” “রোকেয়া, তুই আমায় নিয়ে যাবি তোর গাঁয়ে ? আমিও এমন করে বঁড়শী দিয়ে মাছ ধরবো, পুকুরের জলে ভেসে বেড়াবো, গাছের মগডালে বসে পাখির বাসা দেখবো, ছানাদের কিচির মিচির শুনবো।” ” — ছোট বয়সে অনেক সরল বিশ্বাসের সাথে উচ্চারিত প্রশ্ন।
শেষ অংশটুকু পড়ে মনে খারাপ হয়ে গেলো
গরীবের লাশ হয়ে ফেরা কতো সহজ,
রিমি রুম্মান
ক’দিন আগে জান্নাত নামের যে মেয়েটি লাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিল গ্রামে, সেটি ভীষণ নাড়া দিয়ে গেল মনে। খুব রোকেয়াকে মনে পড়ছিল। এমন জান্নাত তো আমাদের বাসায়ও ছিল। আমাদের আরেকটি বোন হয়ে ছিল।
জিসান শা ইকরাম
জান্নাত নামের যে মেয়েটির লাশ হয়ে ফেরার ঘটনাটি আসলেই নাড়া দেয়ার মত।
বাসায় কাজ করে এমন মেয়েদের এত আপন ভাবা আমি খুব কম দেখেছি।
আপনার জন্য শুভকামনা।
ছাইরাছ হেলাল
সব রোকেয়ারা এমন ভাগ্য নিয়ে আসে না।
রিমি রুম্মান
আমার মায়ের মতন এমন আরও অনেককেই দেখেছি চেনা জানাদের মাঝে, যারা রোকেয়াদের নিজেদের পরিবারের আরেকজন সদস্য হিসেবে দেখত।
তবে হ্যাঁ, সব রোকেয়ারা এমন ভাগ্য নিয়ে আসে না।
মৌনতা রিতু
রোকেয়ারা রোকেয়াদের দোষেই অনেকটা পথহারা হয়। এই অল্প বয়সে বিয়ে, অতঃপর স্বামীর হাতে নির্মম অত্যাচার !
রোকেয়া একটা ভালো পরিবেশ পেয়েছিলো, সেই পরিবেশ ওরাই নস্ট করেছে।
আমার বাসায় আমার এক সাহায্যকারি ছিলো। সইদা এখনো বিয়ে করেনি। মেয়েটাকে আমি বেশ সেলাই শিখাইছিলাম। স্কুলেও যেতো। এইট পর্যন্ত পড়াইছিলাম।এখন সে ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। প্রায়ই আমার সাথে কথা হয়। ওর কথা হয়। ওকে আমি কখনোই প্রতিমাসে টাকা দিতাম না। বছরে একবার টাকা নিতো। সেই টাকায় গরু কিনে রাখতো। এখন ওর বেশ কিছু গরু হইছে, ওর কথা আগে নিজের পায়ে দাড়াই। তারপর বিয়ে।
রিমি রুম্মান
রোকেয়ার বাবার মতন অনেক বাবা মা-ই কন্যাদের নিয়ে চিন্তিত থাকে। আর গরীব হলে তো কথাই নেই। আমরা ওদের অনেকদূর নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখলেও, ওরা নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেয়ে বিয়ে করে সংসারী হওয়াকেই নিশ্চিন্ত জীবন মনে করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।
ভাল থাকুন। শুভকামনা।
মৌনতা রিতু
এই রোকেয়া ঠিক এই কাজটিই করত যদি সে বেঁচে থাকত। সেও ঠিক তার মেয়েকে অজানা ভয়ে বিয়ে দিয়ে দিত। আপু আপনি অবাক হবেন, এই কুড়িগ্রাম একটা চর এলাকা আছে, ওখানে কোনো মেয়েই তেরো বছরের উপরে কুমারি নেই। তাদের নিয়মই দশ বছরের ভিতর মেয়ে বিয়ে দেওয়া। তার উপরে হলে ঐ মেয়ের আর বিয়ে হয় না। অবাক না ?
আমি যাব ঐ গ্রামে। সচোখে দেখব।
ব্লগার সজীব
আপু মন খারাপ হয়ে গিয়েছে শেষ পরিণতি দেখে। সেদিন পড়লাম গায়িকা কৃষ্ণকলির বাসায় খুন হয়েছে গৃহকর্মী। কত স্বপ্ন নিয়ে আসে এক একজন গরীব শিশু, আর আমরা তাদেরকে মেরে ফেলি।
রিমি রুম্মান
আমাদের রোকেয়ার কিছু হয়নি। সে বেঁচে আছে। গৃহ্যকর্মী জান্নাত এর লাশ হয়ে ফেরার গল্প পত্রিকাগুলোয় পড়তে পড়তে রোকেয়াকে খুব মনে পড়ছিল কয়দিন। তাই ওকে নিয়ে লেখা।
ব্লগার সজীব
আমার বুঝতে ভুল হয়েছিল আপু। রোকেয়া নয়, রোকেয়ারা বলেছেন। স্যরি আপু 🙁
খসড়া
আপনার রোকেয়ার মত আমারও একজন ছিল তার নাম আলেকজান। বড় মনে পরে ওকে কেমন আছে সে।
রিমি রুম্মান
রোকেয়া আমাদের পরিবারের একজন হয়ে বেড়ে উঠছিল। ক’দিন ওকে খুব মনে পরছে। কেমন আছে জানিনা।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
প্রথমে যাই শুনলাম রোকেয়া আপনাদের বাড়ীতে তখন ভেবেছিলাম এ ভাগ্যবতী রোকেয়া লেখার শেষ অংশে বুঝতে পারলা পোড়া কপাল কখনো জোড়া লাগে না।পরপারে অন্তত সে শান্তিতে থাকবে সেই কামনাই করছি। -{@
রিমি রুম্মান
হয়তো রোকেয়া ভাল আছে, হয়তো নেই। তবে ভাল থাকা রোকেয়াদের সংখ্যা খুব নগণ্য আমাদের এই সমাজে।
ভাল থাকবেন, নিরাপদ থাকবেন। শুভকামনা।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু তোমার লেখাটা পড়ে আমার অনেক পুরোনো লেখায় চলে গিয়েছিলাম। ২০১০ সালে লেখাটা শুরু করেছিলাম। তারপর ল্যাপটপের মাথা খারাপ হলো, লেখাটা চলে গেলো সব। আবারও লিখতে বসলাম তাদের নিয়ে, আমাদের বাসায় যারা কাজ করতো। কিন্তু তাদেরকে কাজের লোক বলতে দেয়নি কোনোদিন মামনি। কয়েকজন এ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু আমাদের পরিবারের সদস্য হিসেবে এখনও ওরা আছে।
তোমার মতো করে লিখতে পারবো না। তবে সেই লেখাটাকে খুঁজতে হবে। কোথায় আছে জানিনা।
রিমি রুম্মান
সেই লেখাটি যদি খুঁজে না ও পাও, নতুন করে লিখো নীলাদি। শুরুটা করলেই দেখবে চোখের সামনে সেইসব দিনগুলো ভেসে উঠবে। অপেক্ষায় থাকলাম কিন্তু…
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু লিখবো। অনেক গল্প এ জীবনের সব তো শেষ করে যেতে পারবোনা। তবু লিখবো। -{@
মুহাম্মদ আরিফ হোসেইন
আপনার বাল্যকথন ভালো লাগলো।
গ্রামীন জীবনের গল্প শুনে গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছা শহুরেদের হয় যেমনি তেমনি শহরের গল্প শুনে গ্রামের বালকদের শহরে আসার সাধ জাগে।
তবে এটা অবশ্যই গভীর বেদনাবিদুর যে মনের ইচ্ছায় নয়, দুইবেলা দু মুঠো খাবারের জন্য যখন চলে আসতে হয় গ্রাম থেকে কোমলমতী শিশুদের। 🙁
রিমি রুম্মান
বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন একটি শিশু __ এমনটি ভাবতেই পারিনা। আমার নিজের দুটি সন্তান আছে, তাই হয়তো এমন অনুভুতি। কিন্তু যেখানে দু’বেলা আহার জুটে না, সেখানে ওরা অসহায়। পিতৃস্নেহ কিংবা মাতৃস্নেহ এর চেয়েও পেটের দায়টাই যে বড় !!
ভাল থাকুন সবসময়।
শুভকামনা।