অবশেষে একদিন ফিরে

রিমি রুম্মান ৮ এপ্রিল ২০১৬, শুক্রবার, ০৯:২৯:৩৬অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২০ মন্তব্য

রোকেয়াকে প্রথম যেদিন দেখি__

চুলগুলো লালচে, জট পাকানো, গায়ের রং রোদ পোড়া তামাটে, চোখজোড়া ফ্যাকাসে প্রাণহীন। ফ্রক পরিহিতা ছোট্ট একটি মেয়ে। যদিও আমিও তখন ছোটই, তবে ওঁর চেয়ে খানিক বড়। মা’কে টুকিটাকি সংসারের কাজে সাহায্য করবার জন্যে ওঁকে আনা হয়েছে গ্রাম থেকে। আগেকার অন্যসব ক্ষুদে সাহায্যকারীদের মতোই রোকেয়াকেও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হল। প্রতি ভোরে বাসার পাশের মসজিদে আমাদের সাথেই একযোগে আরবী পড়তে পাঠানো হল। আরবী পড়া শেষে টুকটাক থালা বাটি ধুইয়ে, খেয়ে, রেডি হয়ে মায়ের সাথে রিক্সায় চেপে বসতো স্কুলের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে ওঁকে স্কুলে নামিয়ে মা ছুটতেন অফিসে। আবার স্কুল ছুটি শেষে ওকে নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরতেন।

 

মাস খানেক বাদে রোকেয়ার গায়ের রং হয়ে উঠলো কাঁচা হলুদের মতন। চুলগুলো ঘন অন্ধকারের ন্যায়, কালো ঝরঝরে। ফ্যাঁকাসে চোখজোড়া নীলাভ, উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যদিও সেই সময়ে নীল্‌নয়নাকে বলা হতো বিলাই চোখ, অশুভ কিংবা অলক্ষ্মী ! তবে এটা ঠিক যে, অনটনের সংসারে অযত্ন, অবহেলায় রোকেয়ার সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সৌন্দর্য চাপা পড়ে ছিল এতদিন। একটু যত্ন, নিয়ম মেনে চলা, পেট পূরে খেতে পাওয়া __ এসবের ছোঁয়ায় তাঁর ভেতরের সৌন্দর্যটুকু বেরিয়ে এসেছিলো কেবল। বাড়িতে অতিথি এলে, রোকেয়া খাবারের ট্রে হাতে সামনে গেলে অনেকেই আমাদের বোন বলে ভেবে নিত।

 

রোজ দুপুরের সুনসান নিরব সময়টাতে আমরা তিন ভাইবোন বাবা-মা’র আদর, ভালোবাসার ছায়ায়, মায়ায় যখন হাল্কা ঘুম কিংবা বিশ্রাম নিতাম, সেই সময় রোকেয়া একাকি রান্না ঘরের মেঝেতে বসে করুন এক সুরে, কান্নার স্বরে গান গাইতো। অনেকখানি দুর্বোধ্য হলেও এতটুকু অন্তত বুঝা যেত, বাবা-মা, ভাইবোনের কথা মনে করে বুকের গহিন থেকে উঠে আসা এক হাহাকার ছিল সেই সুর।

 

অবসরে রোকেয়া তাঁর ফেলে আসা গাঁয়ের গল্প বলতো। মাছ ধরা, গাছে উঠা, সাঁতরে পুকুরের এপাড় থেকে ওপাড়ে যাওয়া, কিংবা বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবার গল্প। সেইসব গল্প শুনে শুনে ছোট্ট আমি আমার শহুরে বন্দী এক যাপিত জীবনে বসে কল্পনায় স্বাধীন হয়ে ঘুরে বেড়াতাম।বলতাম, “রোকেয়া, তুই আমায় নিয়ে যাবি তোর গাঁয়ে ? আমিও এমন করে বঁড়শী দিয়ে মাছ ধরবো, পুকুরের জলে ভেসে বেড়াবো, গাছের মগডালে বসে পাখির বাসা দেখবো, ছানাদের কিচির মিচির শুনবো।” রোকেয়া বলতো, ” আফা, আফনে আর ইট্‌টু বড় হন, তখন খালাম্মা যাইতে দিবো। ” আমি রোকেয়ার সবকথাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। আর ইট্‌টু বড় হবার স্বপ্ন দেখি।

একদিন ওঁর বাবা এসে ওঁকে গ্রামে নিয়ে যেতে চায়।অনেকদিন ভাইবোনগুলারে দেখে না, মায়েরে দেখে না। রোকেয়ার চোখজোড়া খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠে। ব্যাগ গুছায়। আম্মা ব্যাগে এটা সেটা কিনে দেয় ওঁর মা, ছোট ভাইবোনগুলোর জন্যে। খাবার, কাপড়-চোপড়, তেল, সাবান আরও কত কি ! একদিকে তীব্র উচ্ছ্বাসে রোকেয়া ওঁর বাবার হাত ধরে গাঁয়ে ফিরে, অন্যদিকে আমার ভেতরটায় সকলের অগোচরে মনখারাপের ঝড় বইতে থাকে। বুক চিরে কান্না পায়।

 

কথা ছিল এক মাস বাদে সে ফিরে আসবে। কিন্তু ফিরে না। এক মাস, দুই মাস, তিন মাস…। অবশেষে একদিন ফিরে। এ ফেরা আগের সেই ফেরা নয়। অন্য এক ফেরা। এক লাজুক লাজুক বালিকা বঁধুর স্বামীর হাত ধরে ফিরা ! বেড়াতে আসা। রোকেয়া ডাঙ্গর হয়েছে। ভাল পাত্র পেয়ে ওঁর বাবা-মা আর হাতছাড়া করেনি ! আম্মা নতুন জামাইকে জামাই আদরে আপ্যায়ন করে। তিনতলার চিলেকোঠার পড়ার রুমটিতে ওদের থাকতে দেয়া হয়। বাড়িতে ক’দিন নতুন জামাইয়ের সন্মানে ভাল ভাল রান্না হয়, উপহার কেনা হয়। শেষে চলে যাবার দিন কন্যা বিদায়ের মতন বেদনাবিধুর পরিবেশে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেন আম্মা। সারাটি দিন আমাদের ভেতরটা আর্দ্র হয়ে থাকে।

 

এরপর রোকেয়াকে আর দেখিনি। সময়ের স্রোতে ভেসে ভেসে আমরা আজ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে। ক’দিন রোকেয়াকে ভীষণ মনে পড়ছে। রোকেয়া’রা অনটনের সংসারে দু’বেলা পেট পুরে খেতে পায়না বলে সব ছেড়ে ছুঁড়ে শহরে আসে। দূর সম্পর্কের চেনা সচ্ছল কারো বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কেবলই দু’বেলা খাবারের আশায় ! অতঃপর একদিন লাশ হয়ে ফেরে। গরীবের লাশ হয়ে ফেরা কতো সহজ, তাই না ?

রিমি রুম্মান

৮ইএপ্রিল

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

 

৪২১জন ৪২১জন
0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ