১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক যখন ভারতবর্ষব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছিলো ঠিক সেই সময় জাতীয়তাবোধে সিক্ত, বিপ্লবী চেতনায় বিশ্বাসী সুভাষ বসুর মন চলে গেলো ভারতের রাজনীতির মাঠে। সুভাষ আইসিএস-এর লোভনীয় চাকুরি ও বিলাসবহুল জীবন পরিত্যাগ করে বিপ্লবের টানে ও মুক্তির তাড়নায় স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য মনস্থির করলেন।
১৯২১ সালের ২২ এপ্রিল সুভাষ আইসিএস থেকে পদত্যাগ করে ভারতে ফিরে আসেন। ১৩ জুলাই বোম্বে পৌঁছে তিনি সোজা মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে যান। গান্ধী তাঁকে উৎসাহ দিয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে দেখা করতে বলেন। কোলকাতায় ফিরে সুভাষ দেখা করলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে; সুভাষ দেশবন্ধুর সাথে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন। এই সময় থেকেই দেশবন্ধু তাঁকে রাজনৈতিক শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন।
১৯২১ সালের আগস্ট মাসে সুভাষ বসু অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। চৌরিচেরার সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে গান্ধী সেইবারের মতো আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে সুভাষও গান্ধীর এমন কর্মকাণ্ডে তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন। ওই বছরেই সুভাষ ব্রিটেনের যুবরাজের ভারত ভ্রমণ বয়কট আন্দোলনে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। ওই বয়কট আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে সুভাষকে গ্রেফতার করা হয়।
বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সুভাষ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। সুভাষ দেশবন্ধুর আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে কোলকাতা কংগ্রেস-এর কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে নেন। সুভাষকে জাতীয় কলেজের অধ্যক্ষ, প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির পাবলিসিটি বোর্ডের ও স্বরাজ পত্রিকা এবং জাতীয় ভলান্টিয়ার গ্রুপের দায়িত্ব দেওয়া হলো। একজন অনভিজ্ঞ লোকের হাতে এতো দায়িত্ব দেয়ার জন্য অনেকের ঈর্ষার কারণ ও সমালোচিত হয়েছিলেন দেশবন্ধু। কিন্তু সুভাষ বসু একজন অভিজ্ঞ লোকের মতো তাঁর সমস্ত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে তাঁর রাজনৈতিক গুরুকে সঠিক প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সম্পাদিত কোলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা তাঁর উদ্যম আর কর্মক্ষমতার প্রশংসা করে বলেছিলো, ‘যখন কংগ্রেস একজন সামর্থ লোক পেলো, তখন সরকার হারালো তার একজন সুদক্ষ কর্মকর্তা।’[১]
১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে উত্তরবঙ্গে যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিলো সেখানে বন্যাপীড়িতদের সেবা করে মানবতার যে স্বাক্ষর রেখেছিলেন সুভাষ, তা তাঁর ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য সহায়ক হয়েছিলো।
সুুভাষ বসু বিশ্বাস করতেন যে, আবেদন-নিবেদন ও তোষামোদ করে স্বাধীনতা আদায় করা সম্ভব না,স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয় সংগ্রাম করে, যুদ্ধ করে, রক্তের বিনিময়ে। তাই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম থেকেই কংগ্রেসের পাশাপাশি বাঙলার সশস্ত্র বিপ্লবীদের সংগঠিত করতে থাকেন। এই সময় থেকেই তিনি একদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে অপরদিকে বাঙলার বিপ্লবী সংগঠনগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। বিপ্লবীগণও তাঁকে নিজেদের নেতারূপে কংগ্রেসের রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। ১৯২১ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সুভাষ কোলকাতা ও ঢাকাসহ বাঙলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিপ্লবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্কের স্থাপন করেন।
তাঁর রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন হিন্দু-মুসলিম মিলনের নিবেদিতপ্রাণ সমন্বয়কারী। দেশবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন বাঙলাকে অখণ্ড রেখে শান্তিপূর্ণভাবে জীবন-যাপন করতে হলে হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতার প্রয়োজন, প্রয়োজন একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের। তাই ১৯২৩ সালে সিরাজগঞ্জে প্রাদেশিক সম্মেলনে দেশবন্ধু তাঁর বিখ্যাত হিন্দু-মুসলিম চুক্তি (বেঙ্গল প্যাক্ট) সম্পাদন করেন। এই চুক্তিতে সবার অধিকার প্রতিষ্ঠার শর্ত নিবদ্ধ ছিলো। এই চুক্তিতে ছিলো আইনসভাগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ এবং চাকুরির সংখ্যানুপাতিক বিন্যাস, এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের শতকরা ৫৫ ভাগ এবং হিন্দুদের শতকরা ৪৫ ভাগ নির্ধারণ হয়। এই চুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়, মসজিদের সামনে বাজনা বাজিয়ে শোভাযাত্রা করা চলবে না এবং মুসলমানদের ধর্মীয় অনুশাসনের জন্য গো-হত্যা হলে তাতে বাঁধা দেয়া চলবে না। হিন্দুদের মনে আঘাত লাগে এমন স্থানে গো-হত্যা করা চলবে না।[২]
এই চুক্তিটি তৈরি করেন সুভাষ বসু। এরই মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মতিলাল নেহেরুর সাথে ‘স্বরাজ্য দল’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, সুভাষ বসুর সাংগঠনিক নেতৃত্বে যা ভারতবর্ষে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে অবস্থান লাভ করে।
তথ্যপঞ্জি :
১. দি স্টেটসম্যান, কোলকাতা; ২০ ডিসেম্বর ১৯২১
২. বেঙ্গল প্যাক্ট চুক্তির খসড়া, ১৯২৩
(…………………………………………………………………………..চলবে)
আগের পর্বের লিংক:
অনন্য সুভাষ (১) http://sonelablog.com/archives/24619
১৯টি মন্তব্য
বোকা মানুষ
মহান একজন বিপ্লবীকে নিয়ে তথ্যপূর্ণ লেখার জন্য ধন্যবাদ!
সাতকাহন
ধন্যবাদ, বোকা মানুষ।
শুন্য শুন্যালয়
এমন একজন বিপ্লবী সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ছে আপনার সহজ সাবলীল লেখায়। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
সাতকাহন
ধন্যবাদ শুন্য।
মামুন
আজন্ম একজন বিপ্লবী এই অনন্য মানূষটিকে সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা জানাই। আপনাকে ধন্যবাদ এমন একটি পোষ্টের জন্য।
শুভ সকাল।
সাতকাহন
ধন্যবাদ মামুন।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সুন্দর/ ইতিহাস জানলাম যদিও কিছুটা আগেই জানা ছিল তবে আপনার পোষ্টটিতে ছিল বিস্তারিত।
সাতকাহন
ধন্যবাদ মনির হোসেন।
খেয়ালী মেয়ে
এই পর্বটাও পড়লাম-বাকী পর্বগুলোও পড়া হবে, ইনশাল্লাহ্ 🙂
সাতকাহন
ধন্যবাদ খেয়ালী মেয়ে, সাথে থাকবেন।
আজিজুল ইসলাম
লিখুন, অনেক জানা হচ্ছে।
সাতকাহন
ধন্যবাদ, আজিজুল।
জিসান শা ইকরাম
খুব সহজ ভাবে ইতিহাস জানাচ্ছেন
এভাবেই লিখুন।
ধন্যবাদ 🙂
সাতকাহন
ধন্যবাদ জিসান ভাই।
আবির
অনেককিছু জানলাম তার সম্পর্কে।ধন্যবাদ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ আবির।
লীলাবতী
তিনি ‘ বিশ্বাস করতেন যে, আবেদন-নিবেদন ও তোষামোদ করে স্বাধীনতা আদায় করা সম্ভব না,স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয় সংগ্রাম করে, যুদ্ধ করে, রক্তের বিনিময়ে।’…… তার বিশ্বাস সঠিক বলেই মনে হয়। আবেদন নিবেদন করে আমাদের দেশে স্বাধীনতা আসতো না। এই মহান নেতা সম্পর্কে জানতে পারছি আপনার পোষ্টের মাধ্যমে। ধন্যবাদ আপনাকে।
সাতকাহন
ধন্যবাদ আপু।