এতো অনেক পুণ্যের কাজ,
একটু জ্বালা সহ্য করতে পারলেই অনন্ত স্বর্গ অদেখা স্বর্গের কল্পনা করার চেষ্টা করতে গিয়েই মনে পড়লো কিশোরী বেলায় স্বচক্ষে দেখা নিজের পিসির সতী হবার দৃশ্য।
স্বামীর মৃত্যুর পর শোকে বাকরুদ্ধ পিসি ঘোষণা দিলেন তিনি সতী হবেন অনেকে তাকে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বলেছিলো কিন্তু তিনি কারো কথা শোনেন নি চিতায় সহমরণে আত্মহুতি দেবেই দেবে।
ব্রাহ্মণকে সাক্ষী রেখে তিনি সংকল্প করেই ফেলে একবার সংকল্প করলে তার আর ফেরার পথ থাকে না শেষ মুহূর্তে ভয়ে বা আগুনের তেজ সহ্য করতে না পেরে কেউ যদি এই সংকল্প ভঙ্গ করে তাকে বলা হয় চিতাভ্রষ্ট।
এমন নারীকে সমাজে ঘৃণার চোখে দেখা হয় সে নারী হয় তার পরিবারের জন্য কলঙ্ক এবং অপমানের বোঝা লোকে বিশ্বাস করে সেই নারী একজন প্রেতযোনি প্রাপ্ত ডাকিনী।
সহমরণের সংকল্প করা নারীকে বিধবা বলা হয় না। পিসি নতুন বউয়ের মতো সেজেগুজে কপালে গাঢ় করে সিঁদুর দিয়ে, ঢাকঢোল সহযোগে আত্মীয়স্বজন নিয়ে বাড়ি থেকে আধাক্রোশ দূরের শশানের দিকে হেটে রওনা হলো। খাটিয়াতে মৃত স্বামী আর তার পিছে হাটছে পিসি
পিসির আঁচল ধরে পাশে পাশে হাঁটছে পিসির আদরের পূর্বাদেবী। দুই পাশে আদিগন্ত সবুজ ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে পথ চলে গেছে শশানের দিকে।
কানফাটানো ঢাকঢোল কাশি শঙ্খের সাথে সাথে উলুধ্বনি আর দশ দিক কাঁপিয়ে সমবেত শশান যাত্রীদের ‘হরিবোল’ আর ‘জয় সীতা মাই কি জয়’,জয়োধ্বনি এখনো পূর্বদেবীর কানে বাজে।
হেমন্তের শান্ত-স্থির নদী তীরের শশান ঘাটে দশ গ্রামের মানুষ হামলে পড়েছে সতীদাহের মতো এমন পূণ্যযজ্ঞের সাক্ষী হতে।
কাঠখড়ির স্তূপের ওপর মৃতকে শোয়ানোর পর, ব্রাহ্মণ পুরোহিত ‘ওম তৎসৎ ওম তৎস তৎসৎ’ মন্ত্র উচ্চারণ করলেন।
চিতায় আগুন জ্বলে উঠলো। থেমে গেলো ঢাকের আওয়াজ। শশানজুড়ে শশানের নীরবতা। পূর্বাদেবীর হৃদপিন্ডটা এমন ভাবে ঢিবঢিব করছে যেন যে কোন মুহূর্তে ফেটে যাবে।
হেমন্তের একটা শিরশিরে বাতাস খুব মৃদু করে নড়িয়ে দিয়ে গেল সদ্য জ্বলে ওঠা চিতার আগুন।
মাঠ ভর্তি পাকা ধানের ওপর দিয়ে সে বাতাস বয়ে যাওয়ার সময়, পাকা ধানে ধানে বাড়ি খেয়ে গম্ভীর শব্দে বেজে ওঠা ঝমঝম শব্দটা পূর্বাদেবী শুনতে পেল এই হঠাৎ নেমে আসা নিস্তব্ধতার ভেতরে।
পিসি শুরু করলেন তার শেষ প্রার্থনা। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেবতাগণকে সাক্ষী রেখে তিনি বেশ জোরে জোরে উচ্চারণ করলেন মন্ত্র-
‘হে অষ্টলোকপাল, আদিত্য, চন্দ্র, বায়ু , অগ্নি, আকাশ, ভূমি, জল, অন্তরজামী, নারায়ণ, যম, দিন, রাত্রি, সন্ধ্যা, ধর্ম, তোমরা সাক্ষী হও আমি জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করে আমি পতির শরীরে প্রবেশ করছি”
জীবিতকালে সাত পাকে তৈরী হয়েছিল যে বিবাহবন্ধন সেটা এখন সম্পন্ন হবে তিন পাকে।
প্রজ্বলিত চিতায় শুয়ে থাকা স্বামীকে কেন্দ্র করে ধীরস্থির ভাবে প্রদক্ষিণ করা শুরু করলেন পিসি। প্রথম পাক ঘুরতে বেশ সময় লেগে যায় বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে প্রদক্ষেপ।
শশানে আসার আগে এক ঘটি ভ্যাং আর আফিম মেশানো এক ঘটি দুধ খাইয়ে দিয়া হয়েছিল। এতক্ষনে সেটার নেশা চরে এসেছে। চিতার আগুন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটা লক্ষ করে ব্রাহ্মণ পুরোহিত তাড়া দিয়ে বললেন
মা সত্বর করো মা ,
আগুনে পাটকাঠি আর মচমচে শুকনো কাঠগুলো পুড়ে পট পট শব্দ তুলছে সেই সাথে বের হচ্ছে সাদা ঘন ধোঁয়া।
ভিড়ের চাপে যে সমস্ত নারীরা কাছে আসতে পারেনি, তারা দূর থেকে সেই ধোঁয়া দেখে উলুধ্বনি দেওয়া শুরু করেছে।
সেই উলুধ্বনি খোলা প্রান্তর অতিক্রম করে পৌঁছে যায় মাঠের শেষ প্রান্তের গ্রামে। গ্রামের মহিলারা শশানমুখী হয়ে সতীকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রণাম ঠুকে ঠুকে একই উলুধ্বনিতে সুর তোলে।বিরহী উলুধনিতে ভরে গেছে বিশ্বচরাচর।
আগুন পুরো চিতাকে গ্রাস করার পূর্বেই শেষ করতে হবে বাকি দুই পাক। তাই পিসির দুই জ্ঞাতি ভাই দৌড়ে এসে দুই দিক থেকে ধরে দ্রুত শেষ করলো পাকচক্র।
ব্রাহ্মণ পুরোহিত এবার উত্তেজিত কণ্ঠে আওড়ালেন মন্ত্র-
অবিধবা পাপশূন্য অলংকৃতা অশ্রুরহিতা সাদ্ধি এই নারী জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করুক।
সঙ্গে সঙ্গে একজন একটি ছোট মই এনে চিতার কাঠের স্তূপের সাথে লাগিয়ে দিলো।
ব্রাহ্মণ চিৎকার করে আদেশ দিলেন
-মঃ নমঃ বলে উঠে পড়ো মা
এই আদেশের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ভূমি প্রকম্পিত করে বেজে ওঠে ঢাকঢোল কাশি আর শঙ্খর গগনবিদারী শব্দ।
চিতার তলদেশ থেকে কাঠের ভিতর দিয়ে ফাঁকফোকর খুঁজে খুঁজে সাপের মতো ফসফস করতে করতে আগুন উপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করছে। সেদিকে তাকিয়ে পিসি স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
আর বেশি দেরি করা যায়না। জ্ঞাতি ভাই দুইজন পিসিকে এক ঝটকায় টেনে নিয়ে গেল মইয়ের সামনে। ঠিক তখন শেষবারের মতো পিসি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পূর্বাদেবীর দিকে। সেই দৃষ্টিতে এত তীব্র ভয় ছিল যে পূর্বা দেবী সহ্য করতে না পেরে কেঁদে উঠেছিল।
মই হাতের নাগালে পেয়েই পিসি সাহসী হয়ে উঠলেন। বধূর সাজসজ্জা নিয়ে মই বাইতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল, তবুও ঠিকঠাক উঠে গিয়ে মৃতপতির মাথা কোলে নিয়ে বসলেন। উলুধ্বনি হরিনাম আর সতী বন্দনা করে লোকজন উল্লাস করছে।
‘জয় সতী মাইকী জয়, রাম রাম সতী রাম রাম সতী’
সঙ্গে সঙ্গে মই সরিয়ে ফেলা হলো, আর আগুনের তেজ বৃদ্ধি করার জন্য চিতার চারিপাশে গাদা গাদা পাটকাঠি দেওয়া শুরু হল।
সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে গেলো পুরো চিতা। যেন হেমন্তের এই পড়ন্ত বেলায় মাঠের ওপর নেমে এসেছে একটুকরো ঘন কুয়াশা।
কোন দিক থেকেই এখন আর পিসিকে দেখা যাচ্ছেনা। মূলত সতীর মূল পরীক্ষা শুরু হবে এখন।
যে নারীর সহ্য ক্ষমতা যত বেশি সে সতীর মর্যাদা তত বেশি তাকে নিয়ে গুণকীর্তন চলতে থাকবে দীর্ঘদিন। সেই ‘সতী’ হবে তার বংশের জন্য গৌরবের কারণ। তার নাম হবে সতীমাতা তার মূর্তি তৈরী করে পূজা করা হবে। লোকেরা তেমন সতীর চিতার ছাইভস্ম সংগ্রহ করে রাখবে কল্যাণের আশায়।
অনেকে আজ বাড়ি থেকে মাটির পাতিল ঘড়া নিয়ে এসেছে ছাইভস্ম দেহঅবশেষ নেওয়ার জন্য। সতীর অন্তিম পরীক্ষা নেবার জন্য তীব্র দৃস্টি দিয়ে লোকেরা তাকিয়ে আছে। বাদ্যযন্ত্রীরাও বাজনা থামিয়ে উৎসুক দৃস্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
সাদা ধোঁয়ায় ঢাকা চিতার দিকে প্রতিটি ধোঁয়ার আড়ালে খুব গোপনে আগুন নিজেকে তৈরী করতে থাকে তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।
হঠাৎ সাদা ধোয়ার ভিতরে দেখা গেলো কমলা ঝলকানি।
পিসির সুতির শাড়িটা আগুনের স্পর্শ পেয়েই দপ করে জ্বলে উঠেছে।
হালকা বাতাসে ধোয়া সরে যাচ্ছে। তাতে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে আগুনের কমলা রঙ পিসির লাল শাড়িটার রঙকে কিভাবে বদলে দিচ্ছি।
আগুনে ঝলসানো চামড়ার তীব্র যন্ত্রনা থেকে বাঁচার জন্য প্রানপন হাত পা ছুড়ছে পিসি, সে সাথে আকাশ বিদীর্ণ করা চিৎকার মা গো বাবা গো।
সেই চিৎকার ঢেকে দিতে ঢাকঢোলের বাজনাদাররা আরো জোরে পেটাতে থাকে, আর উপস্থিত লোকেরা চিৎকার করে বলতে থাকে
“রাম রাম সতী, রাম রাম সতী,
সারা গায়ে আগুন নিয়ে পিসি চিতার উপর উঠে দাঁড়ায়। মুহূর্তের মধ্যে মাথার চুল গুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
বাঁচার শেষ চেষ্টা হিসেবে এবার পিসি লাফিয়ে পড়লো চিতা থেকে। পড়েই ছুটতে থাকে নদীর দিকে।
শাড়ী পুড়ে লেপ্টে আছে চামড়ার সঙ্গে আর আগুন যেন মানুষের তেলচর্বির জ্বালানি পেয়ে তাকে ছাড়তে চাইছেনা।
একটা জ্বলন্ত মানুষ ছুটছে তার আপন আত্মীয় পরিজন লাঠি সোটা নিয়ে পিছু পিছু ছুটছে।
এ যে বংশের অপমান
পিসি ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীর জ্বলে নদীতে কোমরপানি জল। এক ডুব দিয়ে উঠেই পিসি বুকফাটা আর্তনাদ করে উঠে।
সবার মাঝে লাঠি হাতে নিজের দাদাকে দেখেই পিসি বলে উঠে
-দাদা গো আমাকে বাঁচাও দাদা।
দাদা মমতামাখানো কণ্ঠে বলল
আয় বোন আয় আমরা তোকে বাঁচাবো।
দাদার কথায় বিশ্বাস রেখে পিসি যেই না পাড়ে উঠে, এলো ওমনি সবাই মিলে পিসিকে জাপটে ধরে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলল।
এর পর চার হাত পায়ের ভেতর দিয়ে একটা বাশ ঢুকিয়ে সেই বাঁশ দুইজন শক্ত সামর্থ চণ্ডাল কাঁধে নিয়ে ঝুলিয়ে চললো চিতার দিকে।
চিতা তখন পরিপূর্ণভাবে জ্বলছে, ঘি চন্দন আর মানুষের মাংস পোড়া গন্ধে পরিবেশ ভারী হয়ে এসেছে। বাঁশে ঝুলন্ত পিসি বাঁচার জন্য ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে। লোকেরা হতাশ হয়েছে।
এই সতী পয়মন্ত না চিতার কাছে এনে চণ্ডালেরা তাকে চ্যাংদোলা করে তিনবার দোল দিয়ে ছুড়ে দিল আগুনের মধ্যে। দগদগে লাল আগুনের মধ্যে হাত পা বাধা পিসির কিছুই ছিলোনা।
* বিশেষ দ্রস্তব :পূর্বাদেবী হচ্ছে আমার ঠাম্মি এর ঠাম্মি তার পিসি ছিলেন কাহিনীতে উল্লেখিত মহিলা ঠাম্মি। ঠাম্মির লিখা ডাইরি থেকে ঘটনাটা জানতে পারি। ওখানে ঘটনাটা এটাই ছিল কিন্তু অগুছালো ভাবে লিখা। আমি গুছিয়ে লিখে দিলাম।
৭টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
হায়রে সতীদাহ প্রথা। কি বিভৎস! আপনার প্রতিটি লাইনে বারবার আৎকে উঠেছি। এখন সেই প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। ধন্যবাদ এমন সত্য ঘটনা আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য। ভালো থাকুন সবসময় শুভ কামনা রইলো
জিসান শা ইকরাম
সতীদাহ প্রথার উপরে লেখাটি ভালো লেগেছে খুব।
শুভ কামনা।
ফয়জুল মহী
সতীদাহ একটা অমাবিক কাজ। সীতা নিয়ে লিখবেন।
জানতে চাই।
সুরাইয়া পারভীন
কি বিভৎস এই মৃত্যু?
বিভৎস সব রীতিনীতি। যখন বাঁচতে চাইলো তখন পরিবারের মান সম্মান রক্ষার্থে বাঁচতে দেওয়া হলো না। কি নৃশংস ধর্ম। ভালো লিখেছেন
কামাল উদ্দিন
এতো বেশী ভয়ঙ্কর কাজগুলো তখনকার মানুষগুলো কিভাবে করতো। আমার সারা শরীর কাপছে
হালিম নজরুল
সবকিছুর মত সময় ও যুক্তিও আপেক্ষিক বটে। ভাল লিখেছেন।
মুন
Donnobad sobai ke