মাঝে মাঝে হারিয়ে যাবার প্রচণ্ড তৃষ্ণা পায় আমার। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে পরিচিত এই ভুবন ছেড়ে। কিন্তু এটা নিছকই এক ছেলেমানুষি ইচ্ছা। যেখানে ভুবন বলতে আমার জানা শোনা রয়েছেই কেবল এই একটাই, সেখানে আর কোথায় গিয়ে হারাবো?
কিন্তু তবুও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। সমাজবদ্ধ হয়ে ভদ্র মুখোশের ভিড়ে আমি যেন দিনকে দিন কেবল হাঁপিয়ে উঠছি। দৈনন্দিন জীবনে এখানে কারও বেঁচে থাকার ছোঁয়া দেখি না আর আমি। আমি শুধু দেখি একদল মানুষ কেবলই একটা ঘোরে পড়ে ছুটছে। মানুষের চামড়ার আড়ালে এরা যেন এক একটা চলমান যন্ত্র-মানব। যেন কলকব্জা গুলোর উপরে স্তর স্তরে চামড়া জুড়ে দিয়ে মানুষের রূপে নিজেকে টিকিয়ে রাখছে। এদের ছুটোছুটি দেখলে মনে হয় নিশ্বাসটাও যেন এরা নিজের জন্যে নেয় না। কেবল পচে গলে পিছু পড়ে যাবে বলেই ভয়ে ভয়ে নিশ্বাস টেনে চলেছে নিয়ম করে।
এদের খাবার আছে, সেই খাবারও নিয়ম করে গ্রোগ্রাসে গিলছে, কিন্তু এদের খিদে নেই। খাবারের স্বাদ এদের জিহ্বাকে স্পর্শ করে না। এদের মনে স্বাদকে উপভোগের সখ জাগে না, আহ্লাদ করে এরা দু’টুকরো রুটিও চিবায় না। এরা কেবল নিয়ম করে তিন বেলা খাবার গিলতে পারে। কেবল পরে সকাল, সন্ধ্যা আর রাতে মেকি আয়োজনে নিজের ভাগের খাবার সাবাড় করতে। আর পারে খাওয়া শেষে ফের নিজেকে ঘোরে টেনে নিয়ে ছুটতে।
তবে এদের জন্যে আমার আফসোস হয় না, দুঃখও হয় না। কেবল নিজের মনে বিষাদ জাগে। জীবনকে এরা কখনোই জীবনের মত করে দেখতে পারে না বলেই এই বিষাদ জাগে। সুশৃঙ্খল হতে গিয়ে এরা বিশৃঙ্খলার আনন্দ নিতে ভুলে গেছে বলে বিষাদ জাগে। ছন্দে চলার লোভে পড়ে ছন্দ পতনের বিরক্তি বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছে বলে আমার বিষাদ জাগে। আমার বিষাদ লাগে, কারণ এরা উড়তে চায়, কিন্তু বাসাতকে স্পর্শ করতে চায় না বলে। বিষাদ লাগে, কারণ এরা সাতরে যায়, কিন্তু নিজেকে পানিতে ছোঁয়ায় না বলে। প্রকৃতির মাঝে কৃত্রিমতা যেন এদের গ্রাস করে নিয়েছে।
কোন একদিন হুট করে যদি এদের মোহের অবসান ঘটে, তবে আমি নিশ্চিত এরা নিজ নিজ বিছানা ছাড়বার আগেই আত্মহত্যার পথ খুঁজবে। মায়ামরা এই প্রকৃতি দেখে নিজেরাই ডুকরে কাঁদবে। সু-শৃঙ্খল জীবনে বাঁচতে গিয়ে এরা যে শৃঙ্খলে বন্দী দাশ ছিল তা অনুধাবন করে এরা নিজেদের আফসোসের আগুনে পুড়িয়ে মারবে।
এরা কখনো সূর্যোদয় দেখে না, এরা শুধু দিনের শুরু হতে দেখে। এরা কখনো সূর্যাস্তের কোমলতাও অনুভব করে না, এরা কেবলই দিনের সমাপ্তি দেখে। এরা সন্ধ্যার মায়ায় নিজেকে নিমজ্জিত করতে জানে না, রাতের নিস্তব্ধতার ছন্দ শুনতে পারে না। এরা জাগে না, এরা ঘুমায় না। এরা কেবলই ছোটে, শুধু ছুটেই চলে।
আর এসব দেখেই আমার হারিয়ে যাবার তৃষ্ণা বাড়ে। বাড়তে বাড়তে একদম অতিষ্ঠ করে তোলে। ছটফট করে, চিৎকার করে, ভাংচুর করে সেই তৃষ্ণা মেটাতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ইকারাসের মত ডানা ছড়িয়ে দিগন্তের এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়াতে।
কিন্তু এসবের কিছুই আমার করা হয় না। আফসোসকে আবারও চেপে রেখে আমি সামনে এগিয়ে যাই। চুপিসারে আমিও আমার মিথ্যে মুখোশটা পড়ে নেই। সেই মুখোশের চোখ দিয়ে আমিও এক অদৃশ্য মোহের দেখা পাই। এটাই সেই মোহ, যা সবাইকে এই একঘেয়ে যান্ত্রিক গতিতে চালিয়ে নিচ্ছে। আর এভাবেই আমার আর হারিয়ে যাবার তৃষ্ণাটা মেটানো হয় না। অতৃপ্ত তৃষ্ণাকে মিথ্যে মুখোশে মুড়িয়ে আমিও বাকি সবার মত ছুটে চলি। ছুটে চলি এক মিথ্যে আশ্বাসের গন্তব্যে…
১৬টি মন্তব্য
মায়াবতী
মানুষ আর মুখোশ এই দুই সত্তা যেন যুগ যুগ ধরে আমাদের পিছু টানের মতো শুধু টানছে , এক মানুষের মাঝে হাজার ও মানুষের বসবাস, একেক সময় একেক রুপে এরা মঞ্চায়ন করে… বাস্তব জীবনের এই প্রতিনিয়ত অভিনয় দেখে দেখে আজকাল আমার কেন জানি না মজা ই লাগে, মনে মনে প্রতিটি দিন আমি অপেক্ষা করি আজকের কাহিনি টা না জানি কতো বিনোদন মুলক হবে…. আপনার লেখা টা পড়ে মনে হল একদম আমার মনের গভিরের কথা গুলো আপনি লিখেছেন… কিন্তু এখন আর আমি দূরে হারাইতে চাই না বাস্তবের এই আয়নাবাজি উপভোগ করতে চাই….
অলিভার
আপনার অনুধাবনটাও চমৎকার
মনে মনে আমরা, কিংবা আরও ভালো করে বললে হয়তো আমি হারাতে চাই, কিন্তু বাস্তবে তো আর সেটা সম্ভব হয় না। তাই শেষমেশ আমাকেও এমন আয়নাবাজি উপভোগই করতে হয়।
মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ 🙂
নীহারিকা
সবাই আমরা মুখোশ পরে থাকি। কারোটা ধরা পড়ে, কারোটা পড়ে না।
অলিভার
একদম..
আবার কারও কারও মুখোশ এতই নিখুত যে তাকে দেখে কখনো মুখোশ পড়ে আছে মনেই হয় না
সঞ্জয় কুমার
মুখোশের আড়ালে আমরা সবাই অভিনেতা/অভিনেত্রী
অলিভার
হ্যা, আর এই অভিনয়টা একদম জীবনের শুরু থেকেই আমরা শিখে আসছি 🙂
জিসান শা ইকরাম
যান্ত্রিক মোহে আমরা এগিয়ে চলি মিথ্যে আশার দিকে।
আসলেই মুখোশ এ আবৃত করি নিজকে আমরা সবাই।
ভিন্ন স্বাদের লেখাটি ভাল লেগেছে,
শুভ কামনা।
অলিভার
কেউ কেউ হয়তো মোহ কাটিয়ে উঠতে পারে। তুবও দিন শেষে শৃঙ্খল সমাজে অশৃঙ্খল হয়ে থাকা যায় না।
ধন্যবাদ আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্যে।
আপনাদের এমন ভালোবাসার জন্যেই সব ছেড়েছেড়েও ছাড়া হয় না -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
আমাদের প্রত্যেকের নিজেদের মধ্যে দুজন “আমি” থাকে। একজন আরেকজনকে চেনেনা। যখন আমরা বলি সে আমাকে বুঝলো না, এ নিয়ে কষ্ট পাই। তখন যদি নিজের গভীরে যাই, কতো সাপ ফোঁসফোস করে, কতো বাঁশী সুর তোলে আর কতো শৈশব ঘুরে বেড়ায়। চিনিনা, বুঝিনা। মুখ এবং মুখোশ আমরা নিজেরাই নিজেদের কাছে।
খুবই সুন্দর একটা গল্প, এটাকে ঠিক গল্প বলা যায়না। বাস্তব, যেনো আমার নিজের এক আমি আমাকেই চেয়ে দেখছে।
অলিভার
আসলে কেবল দুটোই মুখোশ থাকে ব্যাপারটা মোটেই এমন নয়। একটা জাপানি প্রবাদ শুনেছিলাম। তারা বলে, একজন মানুষের অন্তত ৩টা মুখোশ থাকে। একটা মুখোশ সে শুধু অপরিচিতদের জন্যে ব্যবহার করে। অন্য আরেকটি মুখোশ ব্যবহার করে পরিবার-পরিজন আর বন্ধু-বান্ধবদের জন্যে। আর শেষ মুখোশটি হয় শুধু তার নিজের জন্যে; ঐ মুখোশটি সে আর দুনিয়ার কাউকে দেখায় না।
আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। এটাকে সম্ভবত কোনভাবেই গল্প ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না। তবে সঠিক ক্যাটাগরি যে কি হবে সেটিও বুঝে উঠতে পারি নি।
শুভ কামনা জানবেন 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
গল্প নয়, বাস্তবতা এটি। সেটাই বললাম।
প্রবাদটা আমাদের দিদিমা বলেছিলো। মনে করিয়ে দিলেন।
ধন্যবাদ!
ভালো থাকবেন। 🙂
ইঞ্জা
সব কিছুই আজ মুখোশের আড়ালে, দারুণ লিখেছেন।
অলিভার
হয়তো সবই মুখোশের আড়ালে নয়। কিন্তু মুখোশ বন্দী সমাজে বসবাস করতে করতে এখন সবই মুখোশ বলেই মনে হয়।
ধন্যবাদ আপনার প্রশংসার জন্যে -{@
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা
শুন্য শুন্যালয়
সুন্দর, খুবই সুন্দর একটি লেখা। সত্যি বলতে ইদানিং যেন এমনটা আমারো ইচ্ছে করছে। কিছুতেই কিছুর যেন অর্থ পাচ্ছিনা, কেমন যান্ত্রিকতা এই বেঁচে থাকা, সময়ে চলা। আবেগ অনুভূতি হীন পুতুল। তবে আমি নিয়ম মানিনা, মানতে ইচ্ছেও করেনা। মুখোশটাকে চাইলেও প্রশ্রয় না দিয়ে পারা যায় না যে..
অলিভার
সব কিছুরই কি পার্থিব অর্থ থাকা উচিৎ?
আর যেসব ব্যাপারের কোন অর্থ পাওয়া যায় না তাকে বাদ দিয়ে বরং নতুন কিছুর অর্থ খোঁজাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
আর অনিয়মের ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হবে, অনিয়মটাও কিন্তু একটা নিয়ম। প্রশ্রয় যাকেই দিন ঘুরে ফিরে সে কোন না কোন নিয়মেই পড়বে।
শুভ কামনা জানবেন 🙂