ভবতোষ ও ঊর্মিলা স্বামী স্ত্রী। স্বামী স্ত্রী দুজনের সংসার।
বিয়ের এক বছর যেতে না যেতে ঊর্মিলার ক্যান্সার ধরা পড়ল। ফুড পাইপে ক্যান্সার ছিল। এত কম বয়সে সাধারণত এ ধরনের ক্যান্সার হয় না। তবু হয়েছে এ কথাটাই সত্য। কিছু দিন থেকে ঊর্মিলার খাবার খেতে অসুবিধা হচ্ছিল। এমন কি জল গিলতেও বেশ বাধ বাধ ঠেকত–বুকে সব সময় চাপ চাপ অনুভব করত।
শেষে রোগ ধরা পড়ল–প্রায় লাস্ট স্টেজে। কিছু দিন খাদ্য পানীয় আলাদা পাইপ লাগিয়ে গলার নলীর ভেতর দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। এর মাস তিন পরে অপারেশনের সময় মৃত্যু হল ঊর্মিলার।
ঊর্মিলা খুব ভালবাসত ভবতোষকে। এক মধুময় রাতে ঊর্মিলা ভবতোষ যখন বড় কাছাকাছি ছিল,ভবতোষের কোলে শুয়ে দাম্পত্য জীবনের সুখে আপ্লুত হতে হতে বলে ছিল,তুমি আমায় ভালবাস তো ভব?
–খুব,খুব,খুব ভবতোষ আল্হাদিত হয়ে বলেছিল। আর ঊর্মিলা ভবতোষের ঠোঁটে বারবার চুম্বন এঁকে দিতে দিতে বলে ছিল,আমি তোমায় ভীষণ,ভীষণ ভালবাসি–আমি তোমায় জন্ম জন্মান্তরের জন্যে ভালবাসি গো!
এ ঘটনার পর একটা বছরও পার হতে পারল না–ঊর্মিলার অতৃপ্ত জীবন সাঙ্গ হল–যেন বান ডাকা সুখের মাঝখানেই তার মৃত্যু ঘটল।
ঊর্মিলার মৃত্যুর পর বড় অসহায় হয়ে পড়ে ছিল ভবতোষ। কিছু তার ভাল লাগছিল না–অফিসেরও ছুটি চলছিল তার। সময় কাটতে চাইছিল না। নিঃসঙ্গ বিরহ জীবন চলছিল। দিন ভর মন মরা হয়ে স্তব্ধতার ভিতর একলাটি ঘরে বসে থাকে।
স্ত্রীর মৃত্যুর রাত ছিল তার কাছে ভীষণ ভয়াবহ ! একলাটি স্ত্রীর মড় দেহ পাহারা দেওয়া—সে যে কি অসহায়তা তা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। পর দিন দাদা,বৌদি এসে ছিলেন। আর অফিস থেকে ক’জন স্টাফ এসে ছিল।
এখন খালি তিন তলার ভবর ফ্ল্যাট নিশ্চুপ নিঃসাড় পড়ে আছে। স্ত্রীর মারা যাবার পর তিন দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। দাদা বৌদিরা আজই নিজেরদের ঘরে বেরিয়ে গেলেন। ভবতোষ ঘরে আজ সম্পূর্ণ একলা।
ঘুম আসছিল না ভবতোষের। নিঃসঙ্গ অসহায় জীবনের স্মৃতি কথা ভেবে ভেবে সবে মাত্র তার চোখটা লেগে এসেছিল,হঠাৎ খুট করে একটা আওয়াজে তন্দ্রা ছুটে গেল তার। অন্ধকার ঘর। ভব রাতে সবার আগে ব্যালকনির দিকের জানলার ছিটকিনি এঁটে দিয়ে ছিল। ঘরের পাখা মিডিয়ম স্পীডে ঘুরছিল।
কিসের শব্দ হল–একেবারে হালকা শব্দ ছিল না। ঘুম ভেঙে যাবার মত শব্দ–পাখার শব্দকে ছাপিয়ে যাওয়া শব্দ। জানালার দিকে চোখ পড়ল ভবর। আরে জানলা তো বন্ধ ছিল,খুলে গেল কি করে !
জানলার বাইরের আকাশে তখন ফালি কাটা চাঁদ উঁকি মারছিল। তেজহীন মরা জ্যোৎস্নার আলোর বিষণ্ণ ছায়া ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে ছিল। জানলা থেকে চোখ ফিরিয়ে যেই দু চোখের পাতা বুজেছে ওর অমনি আবার আওয়াজ হল। মনে হল জানলার পাট কেউ কিছু দিয়ে ঠুকছে। চমকাল ভবতোষ। জানলার বাইরে কিছুর ছায়া পড়েছে মনে হচ্ছে না? সে ছায়া ঈষৎ কেঁপে কেঁপে উঠছিল। এ ছায়া নিশ্চয় কোন মানুষের হবে–চোর,এ তিনতলায় ব্যালকনিতে কি তা হলে চোর উঠে এসেছে ! অসম্ভব কিছু না।
ভব,কে ? বলে চীৎকার করল–ভাবটা তার এমন ছিল যে চোর হলে মানে মানে কেটে পরো বাবা,সামনা সামনির মোকাবিলার আমার হিম্মত নেই।
ছায়া সরে গেল–জানলা তেমনি খোলা। ভবর সাহস হল না উঠে গিয়ে জানলা বন্ধ করার। পাঁচ মিনিটও পার হল না,আবার সেই ছায়া–এবার জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে !
ভব স্পষ্ট চোখ নিয়ে তাকাল–একটা মেয়ের ছায়া না ! আলুথালু চুল তার মাথার দুপাশ ছড়িয়ে ঝুলছে !
–কে,কে ওখানে? নিজের ভয় ভাঙ্গার জন্যে ভবতোষ জোরেই চীৎকার করে উঠে ছিল।
–আমি,মিষ্টি মেয়েলি চাপা কণ্ঠ–বাতাসে ভেসে আসার মত।
আমি,শব্দে ভব ভীষণ চমকে উঠলো। পরিচিত কণ্ঠ–তবে কি উর্মির কণ্ঠ ! ঊর্মির প্রেতাত্মা !
–কে,কে কথা বলছে? ভয় নিয়ে আবারও প্রশ্ন করে উঠলো ভব। কালো ছায়া ক্রমশ তার রূপ পালটাচ্ছিল। ভব স্পষ্ট দেখতে পেল–ছায়া কেমন ঘূর্ণির মত ঘুরছিল—আর অতি ধীরে ধীরে ঠিক যেন মানুষের মুখের আকৃতি নিচ্ছিল!
ভয় ও বিস্ময়ে ভব দেখতে থাকলো–একটা হালকা আলোর আবরণে এক নারীর মুখমূর্তি তৈরি হতে লাগলো। তত স্পষ্ট নয়–গোধূলির ম্লান আলোর মত–যেমন আগুন আলো হয়–হালকা দীপ শিখার মত ক্রমে ক্রমে তাতে ঊর্মির মুখ ভেসে উঠতে লাগলো।
–ঊর্মি ! হতভম্ব ভবর গলা চিরে বেরিয়ে এলো।
হাসছে ঊর্মি—জানলার শিকের বাইরে অবিকল সেই রূপ,সেই উর্মির মুখমণ্ডল–যেমত ছিল জীবিত ঊর্মির হাসি উজ্জল মুখটা !
–কি ভয় পাচ্ছ? ঊর্মির গলা। ধীরে হলেও সে আওয়াজ ঘরের মধ্যে গমগম প্রতিধ্বনিত এক মিষ্টি আওয়াজ হয়ে এলো।
–তুমি ! ভীত সন্ত্রস্ত ভব বলে উঠল।
একান্ত আপন ভাব নিয়ে ঊর্মি বলে উঠলো–হ্যাঁ,তোমার একাকিত্ব আর দেখতে পারছি না গো !
ভবর ভয় আস্তে আস্তে কি কমে যেতে লাগলো ? ওর ভেতরে কেমন আবেশ আবেশ ভাব জড়িয়ে যেতে থাকলো। ওর শরীরের অনুভূতি অনেক কম হয়ে যাচ্ছিল। মনে হল কোন তন্দ্রায়িত দেশে সে পাড়ি জমাচ্ছে। নাকি এর পুরোটাই স্বপ্ন–ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভব স্বপ্ন দেখছে না তো ! ও চেষ্টা করল নিজেকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখে নিতে কিন্তু না কিছুতেই তা সম্ভব হচ্ছে না।
এবার ভব চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে,ব্যালকনির দরজা না খুলেই ঊর্মির দেহ ক্রমশ ঘরের মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ,এবার ঊর্মিকে পরিপূর্ণ দেহের ঊর্মি মনে হচ্ছে এক আস্ত ঊর্মি? নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ভবতোষ তার প্রিয়তমার দিকে। ঊর্মির মৃদু হাসি হাসি মুখ।
এক পা এক পা এগিয়ে আসছে ঊর্মি। আর মাত্র দু হাত দুরে ও দাঁড়িয়ে আছে। যেমনটা হাসে সমস্ত শরীর দুলিয়ে ঠিক তেমন করে এবার ঊর্মি হেসে উঠলো–খিলখিল করে হেসে উঠলো। ভব নির্বাক দেখে যাচ্ছে। মুখ খুলে কিছু বলতে তার ইচ্ছে হচ্ছিল না।
–আমি আছি…জেনো তুমি…যেমনটা ছিলাম আগে…আবার গা নাচিয়ে খিল খিল হেসে উঠলো ঊর্মি।
ভব এবার নড়ে উঠলো–কলের পুতুলের মত। মনের গহনে তার ইচ্ছের উদয় হতে লাগলো। ভালবাসার ইচ্ছে–প্রেমিক প্রেমিকার ছুঁয়ে থাকার ইচ্ছে।
–আমায় শুতে দাও ভব ! ধীরে ধীরে ঊর্মি ঠিক তেমনি ভাবে এসে শয্যায় শুয়ে পড়ল–যেমনটি রোজ সে ভবর পাশটাতে শোয়।
–এস না ভব…কাছে আসো…
ভবর মনে সব কিছু গুলিয়ে আছে–ও হাত বাড়িয়ে দিল। ঊর্মিকে স্পর্শ করতে–আর ঊর্মিকে স্পর্শ করা মাত্র ভব চমকে উঠলো। বরফ ঠাণ্ডা এক ছোঁয়ায় ও যেন নিজেকে দেখতে পেল,কে ! কে তুমি ? বলে ভব গলা ফাটা চীৎকার করে উঠলো।
পর মুহূর্তে নেই,কিচ্ছু নেই–সমস্ত কিছু যেন ভেনিস হয়ে গেছে। ঊর্মি নেই,আগুন আলো নেই,প্রদীপ শিখা নেই,এমন কি জানলাটাও খোলা নেই !
কেবল স্তব্ধ ঘর পড়ে আছে। মাথার ওপর পাখার ঘূর্ণায়মান শব্দ ভবর কানে ফিরে এলো।
পর দিন বিছানায় ধড়ফড় করে উঠে বসলো ভবতোষ। জানলার কাঁচ ফুঁড়ে ঝলমল রোদ এসে বিছানায় পড়েছে। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। ওরে বাবা,বেলা দশটা বেজে গেছে ! এবার পেট চোঁ চা করতে লাগলো–খুব খিদে পেয়েছে তার।
মনে পড়ল ভবর,গত কাল রাতে সে কি শুধু স্বপ্নই দেখেছিল? কিন্তু এত স্পষ্ট কি স্বপ্ন হতে পারে ?
না,হতে পারে না ।এ যে স্বপ্ন নয়–প্রতি রাতের বাস্তবতা।
–তোমায় খুব ভালবাসি,ঊর্মি ! ভবতোষ ঊর্মিকে জড়িয়ে আছে। আর ঊর্মি খিল খিল করে হেসে চলেছে। না,সেই বরফ ঠাণ্ডা ভাব ভব আর অনুভব করতে পারে না।
–আমি তোমাকে জন্মজন্মান্তর এ ভাবেই পেতে চাই,ভব,তোমার সঙ্গে মিশে যেতে চাই !
পরম সোহাগে ভব ও ঊর্মি একে অন্যকে নিবিড় জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।
নিশুতি রাত পেরিয়ে যাচ্ছে–প্রদোষের অন্ধকার ঘিরে ধরেছে পৃথিবীকে। ঘন আঁধার কেটে ভোরের আলো ফুটে উঠছে।
ভবতোষ দেখল,নেই,বিছানায় ঊর্মি নেই।
এমনটাই তো তাদের প্রতিদিনের খেলা চলছিল।
সমাপ্ত
১৪টি মন্তব্য
মা মাটি দেশ
খুব গোছানো গল্প।ভাল লাগল
তাপসকিরণ রায়
অনেক ধন্যবাদ।
ছাইরাছ হেলাল
এ দেখছি ভুতের গল্প !
আমার আবার ভুতের ভয় খুউব ।
ভাবছি রাতে আবার কেউ হানা না দেয় ।
তাপসকিরণ রায়
গল্পটা আপনাকে ভয় দিতে পেরেছে মনে হচ্ছে।
মিসু
কেমন এক ঘোর লাগা অনুভুতি তে আচ্ছন্ন হয়ে গল্পটি পড়লাম দাদা। কেন জানি মনে হচ্ছে এটি সত্যি। সত্যি ভাবতে ভালো লাগছে । সত্যির মত লিখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে এত সুন্দর একটি গল্প এখানে দিয়েছেন বলে।
তাপসকিরণ রায়
শোনা গল্প–কত দূর সত্যি বলতে পারি না।
নীলকন্ঠ জয়
ভয় পেয়েছি। সোনেলায় ভুত এসেছে। বাঁচাও… 😀
তাপসকিরণ রায়
আপনি বাঁচাবার ডাক দিয়েছেন। ভাল হয়েছে–আমরাও তা হলে বেঁচে যাবো–অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
খসড়া
ভুউউউউউউউউউউউউউত্ততত
তাপসকিরণ রায়
কোথায় ভূত–দিবালোকে সে তো নেই !
লীলাবতী
আমি কিন্তু কিছুটা ভয় পেয়েছি। আগামী কিছুদিন রাতে আর জানালায় তাকানো হবে না 🙁
তাপসকিরণ রায়
ভুতের গল্প দিয়ে যদি ভয় না পাওয়ান যায়,তবে লেখার সার্থকতা কোথায় ? ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
লেখকের লেখার গুনে , ঘটনাটি বাস্তব মনে হয়
খুবই ভালো লেগেছে দাদা।
তাপসকিরণ রায়
লেখা সার্থক বলতে হবে–আপনাদের ভাল লাগাই বড় কথা।ধন্যবাদ।