
কবি নজরুলের সাহিত্যের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : দ্রোহ, আশাবাদ, দেশপ্রেম, শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা করা, সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা চেতনার তীব্র বিরোধিতা করা, জনমানুষের ওপর, সমাজের উপরতলার মানুষের পরিচালিত সব অন্যায় থেকে মুক্তি কামনা।
আমি তাঁর মানবতাবাদ, সাম্যবাদ এবং অসাম্প্রদায়িক এই তিন বিষয় তাঁর কবিতা দিয়ে লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
পৃথিবীতে লোভী, সুযোগ সন্ধানী মানুষের সৃষ্টির কারণেই মানবতা আজ সংকটের মুখে। বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ শুরু হলেই দেখা যায় রাষ্ট্র আর ক্ষমতাবানদের চরম অবহেলা সাধারণ মানুষের প্রতি। যা অবর্ণনীয়। এবং তারাই ক্ষতিগ্রস্থ হয় বেশি। রবীন্দ্রনাথ এর ভাষায়, ” বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।”
আর নজরুল বলেছেন,
” চলতে কি তুই পারবি আপন প্রাণ বাঁচিয়ে
পারবি যেতে ভেদ করে এই বক্রপথের চক্রবুহ্য।” ( পথের দিশা, ফণীমনসা )
সাধারণ মানুষ ধর্মের অজুহাতে, সামাজিক নিয়মের বেড়াজালের কারণে সমাজের উপর তালার মানুষের দ্বারাই নিগৃহীত।
ধর্মের বাড়াবাড়ি এমন অবস্থায় পৌঁছিয়েছে যে, ধর্মের চর্চাও যেনো সাধারণের কাম্য নয়। ধর্মের ছদ্মবেশীর হাতেই ধর্ম কুক্ষিগত। নজরুল ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেছেন,
” শিহরি উঠো না, শাস্ত্রবিদদের করো না ক বীর ভয়
তাহারা খোদার খোদ প্রাইভেট সেক্রেটারী তো নয়।” ( ঈশ্বর, সব্যসাচী )
নজরুল মানবতাবাদকে উর্দ্ধে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি ধর্মীয় সাম্য বজায় রেখে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন অসাধারণ পঙক্তিমালায়। বলেছেন,
” গাহি সাম্যের গান
যেখানে এসে এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রিস্টান।”
ধর্মের বিশ্বাসের জন্ম মনের অভ্যন্তরে। মনের গহীনে জন্ম নেয়া সেই বিশ্বাস প্রকাশ্যে কোন বিরোধ বা দ্বন্দ্বের সৃষ্টির করুক কবি তা চাননি। এই উপমহাদেশের বৃহত্তম যে দুই জনগোষ্ঠী যে দুটি ধর্মের অনুসারী, তাদের তিনি একই বৃন্তে দুটি ফুলের সাথে তুলনা করেছেন।
” মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান। ”
তাঁর লেখালেখির শুরুটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যাহতির পর ; যখন গোটা বিশ্ব টালমাটাল, মানুষ যখন মানবতার চরম বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। যুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি ভেবেছিলেন কিছু করবেন মানুষের জন্য। যুদ্ধ থেকে ফিরে নিজের জ্ঞান, দর্শন, অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে বাজালেন অগ্নিবীণা। হলেন আজন্ম বিদ্রোহী। বললেন,
” ধ্বংস দেখে ভয় কেনো তোর ?
প্রলয় নূতন সৃজন বেদন
আসছে নবীন জীবন হারা
অসুন্দরে করতে ছেদন। “( প্রলয়োল্লাস, অগ্নিবীণা )
চোখের সামনে যা দেখেছেন এবং অন্যায় বলে প্রতীয়মান হয়েছে তার প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিকার চেয়েছেন।
” আমি সেইদিন হবো শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।” ( বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা )
আবার পুরুষশাসিত সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন মেয়েদের আমরা অবমূল্যায়ন করি, সম যোগ্যতা থাকলেও সমভাবে দেখি না।
” বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” ( নারী, সাম্যবাদী )
সূর্যের আলো তার অপার শক্তি থেকে মানুষকে বঞ্চিত করেনা। তেমনি চাঁদও তার সৌন্দর্য বিলায়, ফুলও বিনিময় ছাড়া সুগন্ধ ছড়ায়। একজন মাও তেমনি। সব সন্তানই তাঁর কাছে সমান। তাই হয়তো পৃথিবীর কোন অপশক্তিও পারে না ; তার কোলে জন্ম নেয়া কোন সন্তানকে পৃথক করতে। নজরুল গভীরভাবে তা উপলব্ধি করেই ছন্দে ছন্দে বলেছেন,
” নানান বরণ গাভীতে ভাই একই বরণ দুধ
জগত ভ্রমিয়া দেখি সবই একই মায়ের পুত। ”
আজ তাঁর মৃত্যু বার্ষিকী। একজন কবি কি মরে যেতে পারেন ? না, এটা তাঁর দৈহিক অবসান। তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন তাঁর কাব্যের অমর সৃষ্টিমালায়।
২৩টি মন্তব্য
রেজওয়ানা কবির
এমন একজন কবি কাজী নজরুল ইসলাম যার মত আর কেউ আসবে না কখনো। তার তুলনা তিনি নিজেই। তার লেখা যখন পড়ি বা আবৃত্তি করি তখন শরীর কাটা দিয়ে ওঠে। এত সুন্দর গুছিয়ে মানুষের ভিতরের কথা বলা যায় তার লেখা না পড়লে বোঝার উপায় নেই। তিনি এভাবেই লেখার মাঝেই জনম জনম সব প্রজন্মের মাঝেই বেঁচে থাকবে।
আল্লাহর কাছে দোয়া করি আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করুক। আমিন।
আরজু মুক্তা
আমিন।
তাঁর কবিতাগুলো পড়লে শিহরণ জাগে। আর বিদ্রোহী কবিতা পড়লে লোম শিউরে ওঠে। আপনারা এতো সুন্দর করে কমেন্ট করেন বলোই গুছিয়ে লিখতে পারি।
শুভ কামনা
ছাইরাছ হেলাল
তিনটি বিষয় এত অল্প কথায় কীভাবে লিখলেন সুন্দর করে তাই ভাবছি।
পরিসর তো অনেক অন এক বড়। তাও পড়লে অনেক জানার হয়।
অনেক খাটুনি গেছে, দেখতে পাচ্ছি।
আরজু মুক্তা
লেখাটা আমি দেড় মাস আগে রেডি করেছি। যদিও ঘষামাজা চলছিল। আপনাদের কিছুটা জানাতে পেরে ভালো লাগছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। হেড অভ দা ডিপার্টমেন্ট বলতো, নোট শর্ট করতে চাও, আরজুর কাছে যাও। ফাঁস করে দিলাম। কাউকে বলিয়েন না।
দোয়া করবেন।
হালিমা আক্তার
কবি নজরুল ইসলাম একজনই। তাঁর মতো আর কোনো কবির আগমন ঘটবে কি না জানি না। কবি নজরুল ইসলাম এর বিদ্রোহী কবিতা এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। তিনি নারীদের যে সম্মান দিয়েছেন তা অতুলনীয়। কবি নজরুল ইসলাম সম্পর্কে অল্প পরিসরে অনেক সমৃদ্ধ তথ্য তুলে ধরেছেন। আল্লাহ কবি কে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।
আরজু মুক্তা
একদম। ওনার মতো নারীদের কেউ তুলে ধরেনি।
ভালো থাকুক কবি ওপারে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
তাঁর ধারাগুলো কে সুন্দর করে উপস্থাপন করলেন। তাঁর দ্রোহ, মানবতাবাদ, সাম্যবাদ এবং অসাম্প্রদায়িকতা কবিতায়, গল্পে, গানে সবখানেই প্রস্ফুটিত। তাঁর মৃত্যু দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো
আরজু মুক্তা
তিনি সব শাখায় সাবলীল।
ভালো থাকুক কবি ওপারে।
তৌহিদুল ইসলাম
নজরুল আমার চোখে একজন আধুনিক কবি/ সাহিত্যিক যাই বলেন। তাঁর দূরদৃষ্টির কাছে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র মনে হয়। তিনি যেন দিব্যদৃষ্টিতে অনেক কিছু দেখতে পেতেন যা ফুটে উঠেছে তার লেখায়। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এই মহান কবির প্রতি। আপনিও ভালো থাকুন আপু।
আরজু মুক্তা
ওনার বেশকিছু কবিতার সাথে হুইটম্যান মিলে যায়। কেমনে কি? আমিও ভাবি। সেই সময় এই বই পাওয়া। বা পড়া। আমার কাছে রীতিমত বিস্ময় তিনি।
নার্গিস রশিদ
সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন নজরুলের কিছু কবিতার ধারা গুল। ভাল লাগলো । ভালো থাকবেন ।
আরজু মুক্তা
পাঠক, লেখকের প্রাণ। কমেন্ট ভালো লাগলো।
শুভ কামনা সবসময়
আলমগীর সরকার লিটন
কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপা আপনি নজরুলের পুরো স্বত্বা সুন্দরভাবে বলেছেন –“কবি নজরুলের সাহিত্যের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : দ্রোহ, আশাবাদ, দেশপ্রেম, শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা করা, সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা চেতনার তীব্র বিরোধিতা করা, জনমানুষের ওপর, সমাজের উপরতলার মানুষের পরিচালিত সব অন্যায় থেকে মুক্তি কামনা’ । আসলেই অনন্য অসাধারণ এবং স্বতন্ত্র। কবির প্রতি গভীর এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।
শুভ কামনা রইল।
আরজু মুক্তা
তাঁর তুলনা তিনিই।
শুভ কামনা ভাই।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
হ্যাঁ আপা — তাঁর তুলনা তিনিই।
ধন্যবাদ আপা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক। আমিন।
আরজু মুক্তা
আমিন। ভালো থাকুক কবি ওপারে।
মনির হোসেন মমি
প্রেমের কবি দ্রোহের কবি মানবতা দেশপ্রেমের কবি। তার লেখা পড়ে আমরা বড় হয়েছি।সাম্যবাদীর বিরুদ্ধে সোচ্চার কবির প্রতি রইল বিনম্ভ্র শ্রদ্ধাঞ্জলী।
আরজু মুক্তা
বিনম্র শ্রদ্ধা।
সাবিনা ইয়াসমিন
দ্রোহ, সাম্য, মানবাধিকার, সৃষ্টিভক্তি, প্রেম, ত্যাগ, আশাবাদ সবকিছুতে তিনি নিজেকে অনুস্বরণীয় করে রেখেছেন ব্যক্তি/দেশ/ধর্ম/কালের উর্ধ্বে থেকে। তিনি ছিলেন আমাদের দুখু মিয়া, তিনি বিদ্রোহী কবি, আবার তিনিই প্রচন্ডভাবে স্রষ্টায় বিশ্বাসী একজন ধর্মপ্রাণ ব্যাক্তিত্ব। বাংলা সাহিত্যের প্রানপুরুষ কাজী নজরুল ইসলামের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার বিদেহী আত্মার প্রতি সালাম ও দোয়া পেশ করছি। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাত নসিব করুন। আমিন।
শুভ কামনা 🌹🌹
আরজু মুক্তা
আমিন। ভালো থাকুক ওপারে।