
#চিঠি পর্ব ১
রিতু জাহান
পরম প্রিয় সাত ঋষি,
কেমন আছো আমাকে অভিশাপ দিয়ে? আমার ডায়রির প্রতিটা খসড়াপাতা দিয়ে যাব পোষ্টমাস্টারের ঠিকানায়। বলে দিব পৌছে দিতে তোমাদের ঠিকানায়। আমার মুখ দেখা যে তোমাদেরর হবে না তাই। তোমাদের অভিশাপে এক মোহকালের ভারি বস্তু যেনো আমি।
এতো সুগন্ধ নিয়ে জন্মেও অযত্ন অবহেলায় পড়ে থেকে থেকে আজকাল আমি হাঁপিয়ে যাই বার বার দু’দন্ডকাল পার হতেই।
ভালবাসা, আবেগের সব শব্দমালা তৃণখণ্ডের মতো মোহোকাল ভেঙ্গে মুড়মুড় শব্দে উঠে আসে বার বার। সেচ্ছায় অলিখিত মৃত্যুর স্বাদ আমি নিয়েছি বার বার লিখিত মৃত্যুর অপেক্ষা তুলে রেখোছো তোমরা। লিখিত মৃত্যুর অভিবাদন আছে সেখানে অদেখা হা হুতাশ আছে। অলিখিত মৃত্যুর খাতায় অকারণ অভিবাদন পৌছায় না।
কবে হবে আমার অভিশাপের মুক্তি? মার্চ এপ্রিল মাসে আশীর্বাদের হাত নিয়ে আকাশের ঠিক মাঝ বরাবর বসে থাকো। স্পষ্ট ফুটে ওঠো। তোমাদের খুঁজে নিতে অসুবিধা হয় না এতোটুকু। ধ্রুবতারাকে খুঁজতে গেলেই তোমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না। তোমরা সাতটি তারা, সাত সপ্তর্ষি-বশিষ্ঠ, মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলহ, পুলস্ত্য আর ক্রতু। কতো কতো অভিযোগের প্রশ্ন জমা রেখেছো ও বুকে তা শুধু তোমরাই জানো। তাই কি প্রশ্নবোধক আকৃতি করে রেখেছো নিজেদের?
এই আমি বনকেয়া,আমারই তো কতো কতো অভিযোগ, অনুযোগ! সামান্য লঘুপাপে গুরুদন্ড দিয়েছো। সে গুরুদন্ডের ভার বইছি আমি অনন্তকাল অবধি। কিন্তু বশিষ্ঠ তোমার পাশে অরুন্ধতী দেখো ভালবাসায় পরম যত্নে সগৌরবে বসে আছে। অস্পষ্ট হলেও তার অবয়ব তবু খেয়াল করে আমি কিন্তু ঠিকই দেখে নিতে পারি। অরুন্ধতী, বশিষ্ঠ ঋষি তোমার স্ত্রী, তোমার প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী। আকাশেও তোমার বুকের বাম পাশেই আছেন। অথচ এই আমি কেয়া সাদা বা সোনালী রূপে কেতকী, স্বর্ণপুষ্পী, পাংশুলা যে নামেই ডাকো আমি তোমাদের অভিশাপে আজও পড়ে আছি গভীর অরণ্যে। অনেক তো হলো, এবার তবে আশীর্বাদের হাতটি বাড়াও। মুখ তোলো। তোমাদের বিলাসী ও বাগানে কেয়া ফোটাও যতনে। গভীর এ বনজ্যোৎস্নায় সবুজ বনে, একা একেবারে একা আমি যেখানে শ্রবণ,স্পর্শ,দর্শণ একেবারে অপ্রত্যাশিত। সেখানে,মধুগন্ধভরা ভীতসন্ত্রস্ত মনে লুকিয়ে থাকি আমি।একাই ফুটি একাই ঝরে পড়ি
সুন্দরতর সোনালী কেতকী। আমি না হয় সোনালী কেতকীই বলি নিজেকে। তোমাদের অভিশাপে দেবতার পৌরাণিক ভালবাসায় আমি যেখানে নিষিদ্ধ সেখানে মানবের সখের বাগান বিলাসে ঠায় পাওয়া, বা প্রিয় নিজস্ব সে অবয়ব তার জন্য আমার, আমার জন্য তার বিলাসী কাজল প্রেম বড্ড বেমানান। ঠান্ডা বরফ হীমশীতলে আড়াই হাজার বছর আগে হিমালয়ের উঁচু স্থানে আমার বাস ছিলো
আমি ফুটেছিলাম প্রচন্ড ভালবাসায়, শিবের আরাধনায়। কিন্তু দেবতাদের পারষ্পারিক রেশারেশির ফলে আমি বার বার অভিশপ্ত হলাম, কখনো সীতার কখনো সাত ঋষি তোমাদের। অভিযোগ উঠলো আমি শিবের প্রেমে মিথ্যে বলেছি। বা কখনো রামের গৌরব রাখতে চুপ থেকেছি। মিথ্যা বলার সে অপরাধে অভিশাপ দিয়ে দিলে আমায়। সুগন্ধি কেতকী হয়েও আমি শিবপূজায় নিষিদ্ধ হোলাম।
কোনো আরাধনায় আর আমার স্থান হলো না। হিমালয়ে তোমাদের অভিশাপ পেলামফল্গু নদীর তীরে পেলাম সীতার অভিশাপ।
সীতার অভিশাপে অভিশপ্ত হলাম চুপ থাকার অপরাধে। তখন রাম সীতার বনবাসের সময়। এরই মধ্যে রাজা দশরথের মৃত্যু সংবাদে পুত্র রাম পুত্রবধূ সীতা মৃত্যুশোকে বিহ্বল। পিতার পিণ্ডদানে ব্যাকুল রাজা রামচন্দ্র। ছুটলেন গ্রামে চাল ও ফলের আশায়। দেবতা হয়েও বুঝলেন না যেনো, সংসার ইহলোক ছেড়ে গেছে যে পরলোকে তার তরে পিণ্ডদান বৃথা। শোক আর অশৌচি নিয়ে সীতা একা জরাজীর্ণ দেহকে এলিয়ে দিলেন আমার ঝাড়ের পাশে। আমার সুগন্ধ দিয়ে তাকে ভরিয়ে রাখলাম। রামের অপেক্ষায় অপেক্ষায় সীতা অস্থির হলো পিণ্ডদানে কারণ পিণ্ডদানের সময় চলে যাচ্ছিলো। সীতা ঝুলিতে থাকা একমুঠো চাল দিয়ে পিণ্ডদানের প্রস্তুতি নিলেন।
পিণ্ডদানে সীতা সফলও হলেন। রাজা দশরথ পিণ্ডদানে তৃপ্ত হয়ে ফিরে গেলেন।পিণ্ডদানের সামগ্রী জোগাড় করে রাম ফিরে এসে প্রচন্ড তাড়া দিতে লাগলো সীতাকে। সীতা পিণ্ডদান করে ফেলেছেন শুনে রাম অবিশ্বাসের সাথে তাকালো সীতার পানে। সীতা সাক্ষী করলেন আমায় ও ফল্গু নদীকে। আমরা চুপ ছিলাম কিছুই দেখিনি এমন। শুনেছি কিছু না বলা চুপ থাকা বোবার নাকি শত্রু নেই। স্বামী স্ত্রীর মান অভিমান মিষ্টি ঝগড়ার মধ্যে ঢুকব না এই ভাবনায় চুপ থাকলাম। নির্বাক দৃষ্টিতে সব দেখতে লাগলাম। সীতাকে বিশ্বাস না করে পুনরায় পিণ্ডদানে ব্যস্ত রাম। সব তৈরি করে পিতাকে স্বরণ করতেই পিতা ধিক্কার দিলেন পুত্রকে। কারণ, পুত্রবধূর পিণ্ডদানে তৃপ্ত পিতা। তবে কেনো আবারো স্বরণ করা আবারো পিণ্ডদান! সত্য প্রমাণে সীতা তখন রাগে দুঃখে ক্ষোভে অপমানে আমায় অভিশাপ দিলেন। যে কেয়ার সুবাসে শিব মোহিত হতো সে ফুলের আর পূজো নিবে না শিব। এই ফুলে পূজো দিলে শিবই হবেন অর্ঘ্যদাতার সর্বনাশের কারণ। আমি নির্বাক সব মাথা পেতে নিলাম। আমি পড়ে রইলাম নোনাজলে অবহেলায়। হাজার বাক্যস্রোত আমার মন্থর হয়ে আসে। অভিশাপের পাত্রী যতো যদি তাদের তরে লিখিত মৃত্যুর দুয়ার খোলো তবে সবার আগে আমি কেতকী সে পথের প্রথম পথিক হব।
ইতি
কেতকী।
৩০.৬.২০
শুক্লপক্ষ
২১টি মন্তব্য
সুরাইয়া পারভীন
শুরু থেকে শেষ অব্দি পড়ে নিলাম
কিন্তু হায়! এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কিছুই প্রবেশ করলো না
পড়তে ভালো লেগেছে আবার পড়বো…
রিতু জাহান
আপু, পুরাণ কাহিনী। আমার খুব দুর্বলতা এই ভারতবর্ষের পুরাণ, গ্রিক মিথলজী, ইজিপ্সিয়ান মিথলজী।
আমি বুদ হয়ে থাকি। এবার আমার লাইব্রেরী রুমের জন্য বেশকিছু বই কিনেছি এটার উপর।
প্রাচীন আয়ূর্বেদ পড়তে কিনেছি পরুো বেদ।
সুরাইয়া পারভীন
পুরাণ কাহিনী ভেবেছিলাম। আমি কখনো এইসব পড়িনি। তাই বোধগম্য না হবারই কথা। কোনো একদিন হয়তো এইসবে আমিও মিশে যাবো, বুদ হয়ে থাকবো।
কৃতজ্ঞতা অশেষ আপু
রিতু জাহান
আমি পুরাণকে বলি বাঙলা সাহিত্যের আঁতুড়ঘর।
বৈষ্ণব পদাবলী, চর্যাপদ, মহাভারত।
আমি আসলে যখন পড়ি এটাকে সাহিত্য হিসেবেই পড়ি।
অনেকেই এমন সব বই পড়াকে অন্যভাবে নেয়।
মোঙ্গলকাব্য, ছড়ার পিছনের ইতিহাস যাস্ট আমার নেশা বলা যায়।
আপনিও ভালো থাকবেন।
ছাইরাছ হেলাল
চর্যাপদ পড়েছি বিচ্ছিন্ন ভাবে, মহাভারত ও তাই,
তাই ভাল বুঝতে পারছি না। তবে সাহিত্য হিসেবে মহা ভারত পড়তেই হয়, বেদ পুরাণ ভাল জানি না।
আপনি সহজ করে ছোট ছোট পর্ব লিখলে আমাদের পড়তে সুবিধে হবে।
রিতু জাহান
কিছু বই আমার বার বার পড়া হয় আসলে শব্দ ভান্ডারের জন্য।
মনে থাকে না বলে প্রতিশব্দগুলো বের করে দেখতে হয়।
লিখব ইনশাআল্লাহ
ইঞ্জা
আপু, লেখাটি খুবই ভালো হয়েছে, যদিও একে বিশ্লেষণ পুরাটা করতে পারবোনা কারণ সেই জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আমার আছে, তাই ভাইকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন প্লিজ।
আপু অনেকদিন আপনার ইতিহাস নিয়ে লেখা মিস করছি, লিখে ফেলুননা প্লিজ। 😊
রিতু জাহান
ইতিহাস লিখেছি কিছু।
নোটপ্যাডে আছে। দিব ইনশাআল্লাহ
ইঞ্জা
অপেক্ষায় থাকলাম আপু। 😊
সুপর্ণা ফাল্গুনী
মিথলজি নিয়ে যারা পড়াশোনা করে তাদেরকে আমার সত্যিই স্যালুট জানাতে মন চায়। আপনার লেখায় রামায়ণের খন্ড দৃশ্য দেখতে পেলাম। আশা করি এ নিয়ে আরো বিস্তারিত আপনার কাছ থেকে পাবো। ঈদের শুভেচ্ছা রইল
রিতু জাহান
আমার খুব পছন্দের আপু।
আমার বেশকিছু বই আছে এটার উপর।
ভালো থাকবেন আপু
আরজু মুক্তা
কেতকী রা শুধু বিসর্জন দিবে। তবে, সবখানেই কি গণ্ডগোল পাকায় পুরুষ?
শুভ কামনা।
রিতু জাহান
সবখানেই গন্ডগোল লাগায় পুরুষ,, আর সে গন্ডগোলে নারী চেতে গেলেই হয় মুশকিল,,,
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমি বুঝি কম। এসব পড়তে গেলেই মাথা আউলায় যায়। তবুও পড়লাম । আপনার জন্য শুভকামনা।
রিতু জাহান
বাঙলা সাহিত্যের আঁতুড়ঘর পুরাণ কাহিনি পড়া উচিৎ।
ধন্যবাদ ভালো থাকবেন সব সময়
সাবিনা ইয়াসমিন
আরো অনেকবার পড়া লাগবে 🙁
রিতু জাহান
আচ্ছা,,,,, পড়বেন না হয়💝
তৌহিদুল ইসলাম
হিন্দু পুরাণ কাহিনীগল্পে আমি খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যববোধ করিনা বলে পড়াও হয়নি খুব একটা। ইউনিভার্সিটি লাইফে আমার হোস্টেলের হিন্দু ধর্মাবলম্বী বন্ধুদের কাছে বই নিয়ে যতটুকু পড়েছি ততটুকুই। তবে গ্রীক, মিশরীয় মিথলজী বেশ কিছু পড়েছি।
চিঠিটি নিজেকে কেতকীরুপে লিখেছেন মনে হলো। পুরাণের অবহেলাপূর্ণ এক চরিত্র। যিনি নিজের আকুলিত আহ্বানে জানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন তার প্রতি হওয়া অন্যায় অবিচারের কথাগুলি।
বেশ শক্তপোক্ত শব্দে কিছু জায়গায় ক’বার করে পড়েও মনে হচ্ছে অনেক কিছু এখনো অজানা আমার। পাঠক হিসেবে আমার আরও উন্নতি করা প্রয়োজন।
শুভকামনা আপু।
রিতু জাহান
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই।
শুভকামনা রইলো,
জিসান শা ইকরাম
ভুল অভিশাপে জীবন অতিবাহিত করার অতৃপ্ত গল্প এটি,
নির্দোষ হয়েও শুধু শুধু ভুল বুঝে বা ভাগ্যের ফেরে অভিশপ্ত হবার কাহিনী অনেক আছে।
সব কিছুতে বঞ্চিত কেতকীর হাহাকার চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছো লেখায়,
খুবই সুন্দর হয়েছে।
শুভ কামনা।
রিতু জাহান
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া, কৃতজ্ঞতা সব সময়