“বল মাগী, বল, এই সন্তানের বাবা কেডায়? কথা কস না কেন? এ যাবদ কতজন পুরুষের লগে শুইছোস? বেশ্যা মাগী, বাইর হ এই গ্রাম থাইকা, শহর থিকা পাপের বোঝা লইয়া আইছোস আমগো নিষ্পাপ গ্রামে!”
কথাগুলো এখন আর অত খারাপ লাগছে না রাহেলার। এই ক’দিনে অনুভূতি মরে গেছে। তাছাড়া গাঁয়ে পৌঁছানোর সুখ আছে মনে। নিজের জন্মভূমিতেই তো মরতে চেয়েছিল সে। নিজের গ্রাম, নিজের পাড়া, চেনা আলো – বাতাস। আহ কি নির্মল! কোন বেইমানি নেই, কোন বিশ্বাসঘাতকতা নেই। একান্ত আপন, মায়াময় পরিবেশ। এখানে মরতেও অন্যরকম সুখ। আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। তারপর সব লীলা সাঙ্গ হবে। আর কেউ কথা শোনাতে পারবে না, আর কেউ গালি দিতে পারবে না, আর কেউ ধর্ম শেখাতে পারবে না, পরম বিশ্বাসে আঘাত হানতে পারবে না। দিনের আলোটা ফুরালেই চোখে নেমে আসবে গাঢ় অন্ধকার, চিরসুখের ঘুম।
পরম মমতায় বাচ্চাটাকে বুকের কাছে টেনে নেয় রাহেলা। শত আঘাতেও কোন কথা গায়ে মাখে না সে। মুখে, মাথায়, সমস্ত শরীরে আদর করে, চুমু খায়। তার চোখের জলে শীতল হয় নবজাতকের সমস্ত শরীর। কি এক অজানা সুখে আচ্ছন্ন হয় রাহেলা। সুখ? নাকি বেদনার চুড়ান্ত রূপ? সে কথা রাহেলা ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না।
গোধূলি শেষে সন্ধ্যার আবছা আলোয় চিকচিক করে ওঠে রাহেলার চোখ। তার চোখ থেকে বেরিয়ে আসে কিছু ঝকমকে উজ্জ্বল ছবি, কিছু মানুষের মুখ। ভেসে ওঠে আমাদের সমাজ আর ধর্মের কিছু অক্ষত চিত্র।
রাহেলার চোখ আরও একবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল এরকম। যেদিন সে গ্রাম ছেড়ে শহরের পথে বেরিয়েছিল। সেদিন এই বুকে গুঁজে নিয়েছিল কিছু বইপত্র আর পুরাণ কটা জামাকাপড়। চোখে একরাশ আলোকিত স্বপ্ন। একদিন অনেক বড় হবে, পরম সুখের দোলায় দুলবে সে। তার সেই স্বপ্নের স্রস্টা তারই গ্রামের এক বড় ভাই।
গ্রামের প্রিয়মুখ রমিজ মিয়া। মাদ্রাসার ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল সে। শহরের মাদ্রাসায় চাকরি নিয়েছে সে। নামকরা মাদ্রাসার নামিদামি শিক্ষক। ছোটখাটো সুখের সংসার তার। সম্প্রতি ছেলে হওয়ায় সংসারে কাজকর্ম বেড়েছে। নিজে সারাদিন ব্যস্ত থাকে মাদ্রাসা আর ওয়াজ মাহফিলের কাজে। তাই বউকে সঙ্গ দেবার মত একজন মানুষের প্রয়োজন। রাহেলার মতো মেয়ে হলে ভালোই হয়। শান্তশিষ্ট নিরীহ মেয়ে। লেখায় পড়া, কাজকর্মেও বেশ পারদর্শী। ওকে নিয়ে গেলে ঘরের কাজকর্মও সামলাতে পারবে, আবার ইচ্ছে করলে নিজের পড়াশুনাও চালিয়ে নিতে পারবে। রমিজ মিয়ার প্রস্তাবে রাজি হয় রাহেলার বাবা মা। অভাবের সংসার। সাংসারিক খরচ মিটিয়ে রাহেলার পড়াশোনার খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এমন সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। বাবা মায়ের মত রাহেলার চোখেও ভেসে ওঠে বড় হওয়ার স্বপ্ন, মানুষের মত মানুষ হবার প্রতিজ্ঞা।
দিন যায়, মাস যায়। স্কুলের পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট হয়। দিনে দিনে রাহেলার স্বপ্ন বড় হতে থাকে। তার এই স্বপ্নে পাখা লাগায় রমিজ মিয়া। তাকে কলেজে ভর্তি করে দেবে। অনেক বড় চাকরি হবে। এখন যতটা সুখে আছে তার চেয়ে সুখ বেড়ে যাবে অনেকগুণ। অন্য কোন খারাপ ছেলের হাতে তুলে দেবে না। প্রয়োজনে সে নিজেই বিয়ে করবে তাকে। তাছাড়া ধর্মে একাধিক বিয়ের অনুমোদন আছে। রাহেলাকে সে বোঝায় এখানে তো সে অনেক সুখেই আছে এবং আরও অনেক বেশি সুখী হবার সুযোগ আছে।
সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে রাহেলা। আবেগে হাবুডুবু খাবার বয়স তার। রমিজের প্ররোচনায় পা পড়ে তার। স্বপ্নের ঘোরে উড়তে থাকে সে। তার সবকিছু লুটে নেয় রমিজ। প্রেমাসক্ত রাহেলা সব বিলিয়ে দেয় রমিজকে। একদিন গর্ভবতী হয়ে পড়ে সে। রমিজ তার পেটের সন্তানকে নষ্ট করে ফেলতে বলে। কিন্তু রাহেলা তাকে বিয়ে করার তাগিদ দেয়। বিপদ বুঝতে পেরে সে নানান ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকে। গ্রামে রটিয়ে দেয় রাহেলা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। কলেজে ভর্তি হবার পর সে নানান পুরুষের সাথে অবাধে মেলামেশা করে। ইদানিং মাঝেমধ্যে সে কলেজে গিয়ে বাসায় ফেরে না, অন্য পুরুষদের সাথে রাত কাটায়। মানুষেরা নাকি বলে বেড়াচ্ছে রাহেলা এখন গর্ভবতী। তাই এমন নষ্টা মেয়েকে আর তার বাসায় রাখা সম্ভব নয়। এবার গিয়েই বাসা থেকে বের করে দেবে তাকে। বিশ্বস্ত রমিজকে সবাই বিশ্বাস করে। থুথু ফেলে রাহেলার দিকে।
শহরে ফিরে রাহেলাকে বাসা থেকে বের করে দেয় রমিজ। চোখের জল ছাড়া কেউ সঙ্গী হয় না তার। তবুও অধিকার পাবার শেষ চেষ্টা চালায় সে। অবশেষে তার উপর নেমে আসে হত্যার হুমকি। একদিকে ঘুণেধরা সমাজ, অন্যদিকে অন্ধ আঈন। একদিকে ধর্মান্ধ মানুষ, অন্যদিকে অন্তরীণ সভ্যতা। মাঝখানে খাবি খায় নিপীড়িত নারী, অসহায় রাহেলা। সামাজিক যাতাকলে পিষ্ট রাহেলা ভাবে এই নিষ্ঠুর পৃথিবী তার জন্য নয়। সে সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামে ফিরে যাবার, পৃথিবী থেকে ফিরে যাবার।
গ্রামে ফিরতেই তোপের মুখে পড়ে রাহেল। চারদিক থেকে অগ্নিগালিগুলো তাকে শেলের মতো বিঁধতে থাকে। “বল মাগী, বল, এই সন্তানের বাবা কেডায়? কথা কস না কেন? এ যাবদ কতজন পুরুষের লগে শুইছোস? বেশ্যা মাগী, বাইর হ এই গ্রাম থাইকা, শহর থিকা পাপের বোঝা লইয়া আইছোস আমগো নিষ্পাপ গ্রামে!”
কথাগুলো এখন আর অত খারাপ লাগছে না রাহেলার। এই ক’দিনে অনুভূতি মরে গেছে। তাছাড়া গ্রামে পৌঁছানোর সুখ আছে মনে। নিজের জন্মভূমিতেই তো মরতে চেয়েছিল সে। নিজের গ্রাম, নিজের পাড়া, চেনা আলো – বাতাস। আহ কি নির্মল! কোন বেইমানি নেই, কোন বিশ্বাসঘাতকতা নেই। একান্ত আপন, মায়াময় পরিবেশ। এখানে মরতেও অন্যরকম সুখ। আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। তারপর সব লীলা সাঙ্গ হবে। আর কেউ কথা শোনাতে পারবে না, আর কেউ গালি দিতে পারবে না, আর কেউ ধর্ম শেখাতে পারবে না, পরম বিশ্বাসে আঘাত হানতে পারবে না। দিনের আলোটা ফুরালেই চোখে নেমে আসবে গাঢ় অন্ধকার, চিরসুখের ঘুম।
কিছুক্ষণ পর অন্ধকার নেমে এল। রাহেলা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল রমিজের গ্রামের বাড়ির তালাবদ্ধ ঘরের সামনে। কোলের সন্তানকে বারান্দায় শুইয়ে দিল। অতঃপর চিৎকার করে বলে উঠল, “হে আল্লাহ, এই পৃথিবী বিশ্বাস ভালবাসে, আর তুমি সত্য ভালোবাসো। আমি সত্য রেখে গেলাম, তুমি তোমার সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করো।”
৬টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম, মাসনা,লুসাসা,রুবাবা চালু করতে চান নাকি!!
আসলে নারীদের অবহেলা অপমান আমাদের সমাজের শিকড়ে পৌঁছে গেছে।
সহসা উত্তরণের রাস্তা দেখছি না।
ইদ মুবারক, কবি।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
কেমন আছেন ভাইয়া? আপনার বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনেছি। আশা করি শোক কাটিয়ে উঠেছেন। চমৎকার গল্প। মেয়েরা চিরকাল এভাবেই নির্যাতিত, অবহেলিত। তাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। ঈদের শুভেচ্ছা রইল
নিতাই বাবু
অনেকদিন পর দাদার লেখা পড়লাম। ভালো লাগলো। কেমন আছেন? পবিত্র ঈদুল আজহা’র আগাম শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
আরজু মুক্তা
মেয়েদের উত্তরণ শুধু মেয়েরাই করবে, তা নয়! সহযোগিতা দরকার পুরুষের। আর মেয়েদের উচিত এই ভুলগুলো করার আগে সিদ্ধান্ত নেয়ার।
শুভ কামনা ভাই
সাবিনা ইয়াসমিন
দিন শেষে রমিজ মিয়ারাই সসম্মানে নিজের ঘরে শান্তির ঘুম দেয়। আর লোভী রাহেলারা (প্রলোভনের শিকার) ফিরে যায় আরও অন্ধকারে।
“হে আল্লাহ, এই পৃথিবী বিশ্বাস ভালবাসে, আর তুমি সত্য ভালোবাসো। আমি সত্য রেখে গেলাম, তুমি তোমার সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করো।”
হয়তো তিনি শোনেন, হয়তো তিনি সাজা দেন। ভাগ্য নির্মাতার ভুল ধরবে এমন সাহস রাহেলাদের নেই, থাকেও না।
ভালো থাকুন, শুভ কামনা 🌹🌹
হালিমা আক্তার
এভাবেই বাংলার রাহেলারা সমাজের চোখে হয় অবাঞ্ছিত।আর রমিজেরা মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকে। শুভ কামনা অবিরাম।