
বউ বাপের বাড়ি গেলে ছেলেরা কতটা স্বাধীন হয়, সেটা তাদের কর্মকান্ড না দেখলে বোঝার উপায় নেই! ট্রাউজার পরার ঝামেলা একদমই থাকেনা। যেমন-তেমন করে লুঙ্গি পেচিয়ে ঘুমানো যায়। রাতে খুলে গেলেও সমস্যা নেই, শাসন করবার মত কেউ থাকে না। জুতা-মোজা, জামা, আন্ডারওয়ার যেখানে সেখানে ফেলে রাখা যায়। বলার কেউ নেই, তাই গোছানোর ঝামেলা থাকে না। ঘনঘন হাত ধোয়া- ধুয়ি এসবের ঝামেলাও একদমই থাকে না। বাইরে থেকে এসে হাত না ধুয়েই যে কোন কিছু খেয়ে ফেলা যায়।
আমার বউ অবশ্য বাপের বাড়ি যায়নি কারণ তার বাবা- মা নেই আর ভাইয়েরা কোনদিনই খোঁজ- খবর নেয় না। আমাদের দুজনের তিনবেডের ফ্ল্যাট বাসা। এখন একটা রুমে সে, অন্যটাতে আমি। আজ বুঝলাম এত বড় বাসা ভাড়া নেবার কারন কি ছিল? মাঝে মাঝে যেন আমাকে সাজা দিতে পারে তাই! আগামী যতদিন তার ভালো না লাগে আমি তার বেডরুমে যাব না, সেও আমার বেডরুমে আসবে না। সে হিসেবে বলাযায় আমি পুরাই স্বাধীন! এ কদিনে রুমের বারোটা বাজিয়েই ছাড়ব।
আমি কাব্য আর আমার বউ কণা। আমরা দুজনে দুই মেরুর বাসিন্দা। কণা ঢাকা ভার্সিটি থেকে ফিজিক্স এ আর আমি ন্যাশনাল ভার্সিটি থেকে ফিলোসফি। সে চাকুরী করে পলিটেকনিক্যাল কলেজে আর আমি মহিলা কলেজে। সে গণিত, নিউটনের সুত্র এসব শেখায় আর আমি অযৌক্তিক যুক্তিকে জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করাই মেয়েদের মাঝে।যেমন- “গরু ঘাস খায়, আমরা গরুর মাংস খাই সুতরাং আমরাও ঘাস খাই”। আর মেয়েদের পড়াতে পড়াতে মেধা আরও ড্যামের দিকে।এ কথা অবশ্য আমার নয়, কণা বলে!
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ফিজিক্সের এই কড়া মানুষটাকে আমার বিয়ে করা মোটেও ঠিক হয়নি। কিন্তু কি করব! স্কুলে আমরা একসাথে পড়তাম; অনেক বছর বাদে ফোন দিতেই মাসখানেকের মাথায় দুজনে প্রেমে পড়ে গেলাম। সে প্রেম যেনতেন নয়, একেবারে হাবুডুবু প্রেম!যার পরিনতি সামনে আমাদের নবম ম্যারেজ এনিভারসেরী।
কণা আজ সকালেই আলাদা হয়েছে মানে আলাদা ঘরে থাকছে। কারন আমি ভীষন অগোছালো। সবসময় জামা- জুতা যেখানে সেখানে রাখি। আজ গন্ধ মোজা ওয়ারড্রবে তুলে রেখেছিলাম। এজন্যই সে রাগ করেছে। আমিও উল্টা রি- একশ্যান দিতেই, সে রাগ করে চলে গেল! এখন মনে হচ্ছে একদমই উচিত হয়নি। তারপর অবশ্য হাজার সরি বলেছি;তারপরও কাজ হল না।
আমি খুউব কষ্টে আছি। কারন একা একা বউ-ছেলেকে ছেড়ে আর কতক্ষন থাকা যায়! সারাটা সন্ধ্যা বাইরে ঘুরে খেয়েদেয়েই ফিরলাম। রাগে ওর রান্নাও খাচ্ছি না।
ভাবছিলাম,আজ লুঙ্গি স্বাধীনতায় বিরাট এক ঘুম হবে হয়ত! তাই তারাতারি শুয়ে পড়লাম। কিন্তু কেন যেন কিছুতেই ঘুম আসছে না, শুধু এ পাশ ও পাশ করছি। কিছুতেই যখন ঘুম আসছিল না তখন উঠে টাইট ফিট ট্রাউজারটা পরে নিলাম। এতকালের অভ্যাস বলে কথা! এবার হয়ত ঘুম আসবে; নাহ্! দুচোখে তবুও ঘুম নেই।
এ সময় ফোনে টুকটুক করে ম্যাসেজ এল, ‘কি কর’?
আমি তারাতারী উত্তর দিলাম, ‘তোমাকে ছাড়া ঘুম আসছে না’।
ফিজিক্স বলে কথা, বউ কিছুই বলল না, শুধু ঘন্টাতিনেক কথা বলল। আমি খুউব বুঝলাম, সে আমাকে চরম মিস্ করছে! কিন্তু মুখ ফসকে যখন বলে ফেলেছে। তখন শর্ত কিছুতেই ভাঙ্গবে না এবং এই শর্তে আগামী নয়দিন আমাদের চলতে হবে।
তবে আমরা প্রতিরাতেই ফোনে অর্ধেক রাত অবধি প্রেম করতে লাগলাম। অনেক মধুময় সময় কাটতে লাগল। যেন আবার নতুন প্রেম ফিরে এল।
আমাদের বিয়েটা খুব তারাতারী হয়েছিল প্রেমের ছয়মাসের মাথায়।রাত দশটা নাগাদ বিয়ের সব কাজ শেষ। আমি আধাপাগল সেদিন তাকে কাছে পাবার জন্য পুরাই পাগল হয়ে অপেক্ষায় আছি।বউ বিয়ের শাড়ি পাল্টে দুধের গ্লাস হাতে ঘরে এল।
– এখনও জেগে আছ, এই নাও খেয়ে ঘুমাও?
কি কপাল আমার ফুলশয্যায় কেউ এমন করে বলে? আর বলারও সুযোগ দিল না শাডিতে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে! পাশ ফিরে ‘গুডনাইট’ জানালো। আমি গরম দুধ খেয়ে মনোব্যাথায় কাতরাতে লাগলাম।
রাত তখন বোধহয় তিনটে হব বোধহয়, বুকের উপর কি যেন ভারী বোধ হচ্ছে। আর বেলী ফুলের গন্ধে পাগল হবার জোগার। ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি বউ শিশুর মত আমার বুকে ঘুমাচ্ছে। আর বকুল ফুল নয়, তার চুলের গন্ধ। আমি খুশিতে ফুলশয্যার বিসর্জিত চুমুর দু:খ নিমিষেই ভুলে গেলাম।
নিজের আটাশ বছরের ভার্জিনিটি বিসর্জন দেবার শুরুটা কেমন করে হবে তার কোন নাম নিশানা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তারপরও সাহস বুকে রাখতেই হবে। কিছু একটা তো নিশ্চয়ই হবে! সাহস করে যখন ভারজিনিটি খোয়ানোর প্রথম স্টেজে নেমেছি হঠাৎ বউ বলল, ‘বমি পাচ্ছে, সর ওয়াশরুমে যাব’।
যা বাবা কিছু তো করিনি শুধু চুমুতেই! গডগড করে বমিতে ওয়াশরুম ভাসিয়ে চলে এল। আমি বেচারা অপরাধী হয়ে নির্ঘুম রাত কাটালাম। কত জিজ্ঞেস করলাম, মুখে গন্ধ ছিল না অন্য সমস্যা।
শুধু বলল, লিপ কিস তার ভালো লাগে না, বমি পায়, ঘেন্না লাগে।
কি সর্বনাশা কথা ; আমাকে তাহলে বাকি জীবন ভার্জিন হয়েই কাটাতে হবে?
পরের দিনেও বউ এর বমি থামছে না। শশুরবাডির সবাই কটর- মটর করে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন, আমি এই মাত্র খুন করে এসেছি! মনের দু:খে বিদায় হলাম। বউ থাকতেও বলল না বরং ভাব করল , ‘ তুই গেলেই বাঁচি’।
দুদিন বাদে বউ এর ফোন বলছে, ‘ তুমি আসছ না কেন? কি এত কাজ কর যে,আমাকেও ভুলে গেছ। আমার ভালো লাগছে না এখুনি আসো”।
আর কি থাকা যায় বলেন?
রাগারাগীর নবম দিনেই আমাদের নবম এনিভারসেরী। এতকিছুর পরও আমি জেদি,রাগী ফিজিক্সকে একমুহূর্ত না দেখলে থাকতে পারি না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আর জীবনেও ঘর- দোর অগোছালো করব না। দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ আমার। তার প্রতি খেয়াল রাখা আমার একান্ত কর্তব্য। আমি কাজের বুয়ার সাহায্যে ঘর- দোর সব ঝকঝকে করে ফেললাম। তার পছন্দের রান্না করলাম। বাইরে থেকেও অনেকগুলো পছন্দের খাবার নিয়ে এলাম। তার পছন্দের ফুল দিয়ে বাসা ভরিয়ে ফেললাম। বাইরে থেকে এসে সে যেন চমকে যায়।
বউ সত্যিই চমকে গেল! সব সুন্দর দেখে বউয়ের রাগ পরে গেল। সে এত আয়োজনে চমৎকৃত, তাই আজ আমরা একসাথে খেতে বসেছি। এতসুন্দর একটা ক্যান্ডেল নাইট ডিনার শেষে ডেজার্ট না থাকলে যেন কেমন লাগে! খাওয়া শেষে দেখা গেল তাই মিসিং।
আমি কোন আক্কেলে আনতে ভুলে গেছি। খারাপ লাগলো। বউ ভীষণ পছন্দ করে। আমি একটু আসছি বলে দরজার চাবি নিয়ে দিলাম দৌড়! রিকশা নিয়ে সোজা মিষ্টির দোকান। সব আইটেম অল্প অল্প করে নিলাম কারন আজ সে যেটা চাইবে সেটাই যেন খুঁজে পায়।
রিকসার গতি আজ ভীষন খারাপ, পথ যেন শেষই হচ্ছে না। এদিকে মনের লাড্ডু তো একে একে ফুটে শেষ! প্রেমের তেলাপোকারা কিলবিল করছে উড়ার জন্য। চুপিচুপি
দরজা খুলে সারাশব্দ না পেয়ে বেডরুমে কান পাতলাম।ফুসফুস শব্দ হচ্ছে। নিজের উপর ভীষন রাগ হল।জীবনেও কোনকিছু ঠিকঠাক কেন করতে পারি না? তাকে আজকের দিনেও কাঁদিয়ে ছাড়লাম? যা থাকে কপালে, ভয়ে ভয়ে আমি রুমে ঢুকে অবাক! ভাই সকল,ফিজিক্স বউ আমার নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। কান্না নয়, নাক ডাকার শব্দ।
কি আর করা,একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমিও পাশে শুয়ে পড়লাম। ভেতরে ভেতরে যে রোমান্টিক হয়ে ফুলে ফেপে একাকার হয়েছিলাম, মুহূর্তেই তা ফুস হয়ে গেল!
কিছুক্ষন পর বউ পাশ ফিরে আমার হাতে মাথা রেখে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করল, “ মিষ্টি এনেছ”। কি সর্বনাশ সে জানল কি করে??
বললাম ,হ্যাঁ সোনা এনেছি; খাবে না!
কাল খাব, আজ ঘুমাই। শুধু শুধু রাগ করে কতগুলো রাত তোমাকে ছাড়া ছিলাম, একটুও ঘুমাইনি। আজ তোমাকে জডিয়ে অনেক ঘুমোবো।
আমার চোখ পানিতে ভিজে গেল! তাকে বুকে জডিয়ে নিলাম। যদি পরজন্ম সত্যি হয়, তাহলে এই রাগী, জেদী মেয়েটাকেই বারবার আমার বউ করে চাই!!!!!
ছবি- নেট থেকে।
২৪টি মন্তব্য
বোরহানুল ইসলাম লিটন
মান অভিমানে সুন্দর সংসার
দু’জনের সমঝোতার মানষিকতা অতি
বাড়িয়ে দিয়েছে সংসারে সুখের গতি।
ভীষণ মুগ্ধতায় শুভ কামনা রেখে গেলাম নিরন্তর আপু।
রোকসানা খন্দকার রুকু
প্রথম মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আপনাদের অনুপ্রেরণা লিখতে সাহস যোগায়। শুভ কামনা রইল।
ছাইরাছ হেলাল
এই তো জীবন, এমন-ই জীবন, সুখের ও দুঃখের।
রোকসানা খন্দকার রুকু
হ্যা ভাইয়া। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
পপি তালুকদার
দারুন ভালোবাসার গল্প পড়লাম।প্রেমের পড়ে গেলাম মনে হয়। সংসারে সুখ- দুঃখ সবি থাকে। তবে ভালোবাসা থাকলে দুঃখ কে ও জয় করা যায়।
হলুদ গোলাপের শুভেচ্ছা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
প্রেমে পড়ে গেলেন তাহলে তো আমি স্বার্থক। হলুদ গোলাপের শুভেচ্ছা নিলাম। শুভ কামনা রইল।
আরজু মুক্তা
চলুক প্রেম প্রেম ভালোবাসা। দেখা যাবে ফিজিক্স বৌ এর মোজার গন্ধ ছাড়া ঘুমেই আসে না।
রোকসানা খন্দকার রুকু
হা হা হা কি অবস্থা। খালি শুনুক ফিজিক্স বউ।
ধন্যবাদ অফুরান কিন্তু এত বড় লেখায় এত ছোট কমেন্ট মন ভরল না।
ফজলে রাব্বী সোয়েব
আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। ভালোবাসাটা ঠিক এমনই হওয়া উচিৎ। শুভেচ্ছা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাই। শুভ কামনা রইল।
রেজওয়ানা কবির
প্রেমে টুইটুম্বুর অবস্থা, রম্য পাক্কা গিনেচ বুকে রাখার মত, হায়রে অগোছালো হোক তবে রোমান্টিক তো বটেই,ফিজিক্স বউ আর রম্য বর অসাধারণ রম্য। শুভকামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমাদের পরিচিত দুজন বুঝলে! মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।শুভ কামনা রইল!!!!
রেজওয়ানা কবির
পরিচত জন্যই তো রম্যের মাঝে কল্পনা করে ভালোই মজা পেলাম🤪🤪🤪।
খাদিজাতুল কুবরা
অনেক দিন পর মন খুলে হাসলাম। বউগুলা আজকাল বেশিই রাগী হয়। মোজা গামছা নিয়ে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে বসে। দেখা যাচ্ছে বিয়ের আগে রম্যবরদের ট্রেইন হয়ে আসতে হবে বউ যদি ফিজিক্স হয়।
দারুণ গল্প লিখেছ।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ভাবলাম ব্লগে হাসি মশকরা হারিয়ে যাচ্ছে। সব সিরিয়াস পোষ্ট দিচ্ছে তাই একটু চেষ্টা আরকি।
তোমাকে হাসাতে পেরে আরও ভালো লাগছে। ভালো থেক।
ইঞ্জা
এমন রোমান্টিকতা কার জীবনে আছে, লিপ কিসে বমি এ যেন ভুতের মুখে রাম নাম। 🤣
বেশ ভালো লাগলো লেখাটি। 💕
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া। সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
শুভ কামনা রইল।
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা আপু।
জাহাঙ্গীর আলম অপূর্ব
অতীব ভাবগাম্ভীর্য পূর্ণ প্রকাশ
রোকসানা খন্দকার রুকু
হা হা হা। মন খারাপ করবেন না কিন্তু এটা মোটেও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ নয়।খুনসুটিময় সংসারের গল্প। কষ্ট করে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন ভাইয়া। তাতে আপনারই লাভ হবে।
ভালো থাকবেন। শুভ কামনা সবসময়।
তৌহিদ
সুখ দুঃখ নিয়েই জীবন। সরলতা জটিলতা মিলেমিশে একাকার জীবনকে অংক কষে সবসময় পরিচালিত করা যায়না। এটাকেই বুঝি জীবনের ছন্দময়তা বলে।
ভালো থাকুন আপু।
রোকসানা খন্দকার রুকু
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। পাশে থাকবেন।
শুভ কামনা রইল
আশরাফুল হক মহিন
শুভকামনা প্রিয় কবি অসাধারণ হয়েছে আপনার লেখা শুভেচ্ছা রইল আপনার জন্য ভালো থাকুন সবসময়
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনিও ভালো থাকুন!