
শীত এসেই গেল! আমার পছন্দের ঋতু। কিন্তু বয়স যত বাড়ছে পছন্দ ততই বাঁধ সাধছে। কোমর ব্যথা চরম আকার ধারণ করেছে। বসলে উঠতে পারিনা। নামাজ চেয়ারে বসে। সারাদিন হট ওয়াটার ব্যাগ কোমরে দিয়ে শুয়ে থাকি। কি যে যন্ত্রণা যার ব্যথা আছে সেই বুঝতে পারবে। তো ঘটনায় আসি। ঘটনা দিন পনের আগের-
কর্তার ফোনে জানলাম তিনি ভূরুঙ্গামারী নদী সার্ভের কাজে আসছেন। সাথে আরও কয়েকজন থাকবেন আর অফিসের গাড়িতে আসছেন তাই বাসায় নামা সম্ভব হবেনা। আমি যেন সকাল সকাল শাপলা মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি বাধ্য বউয়ের মত অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছি। মাত্র ঘন্টাখানেক দেরি করিয়ে অবশেষে তিনি এলেন। হাসতে হাসতে মাত্র তিনটে ব্যাগ নামিয়ে বললেন, ভীষন দেরি হয়েছে। ডাকবাংলোয় উঠেই ফিল্ডে যেতে হবে। তোমার সাথে ফোনে কথা হবে।
মনে মনে আমি বেজায় খুশি। তুমি কই যাও,তাতে আমার মোটেও আগ্রহ নেই। আমার সমস্ত মনোযোগ ব্যাগে কিকি আছে তার উপর। কুতকুতে চোখ জোড়াও লোভে বড় হয়েছে। নতুন কোনকিছু পাবার উত্তেজনায়, খুশিতে রিক্সা ভাড়া ডাবল দিয়ে দিলাম। হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে ফটাফট ব্যাগ খুললাম। আমি এতটা সারপ্রাইজড অনেকদিন পর হলাম!
জনি লিভারের মুভির ঘটনা মনে পড়ল- ট্রেনে আসতে জনি লিভার বিরাট বড় একটা লাগেজ পায়। কেউ ভালোবেসে তার সিটের উপরে রেখে গেছে। সে হিরা-মানিক ভেবে টেনেহিঁচড়ে বাসায় নিয়ে আসে। তারপর বউ সহ কিছুক্ষন আনন্দ নাচ নাচে।
বউ বলে- কি এনেছ সেটা তো দেখাও?
জনি লিভার- আরে খুলকে তো দেখ পাগলি, তেরে লিয়ে ম্যায় কেয়া লায়া হু!
বউ ব্যাগ খুলল কিন্তু ওখানেই স্ট্যাচু।
জনি লিভার- কেয়া চক গেয়া না। হা হা হা। ম্যায় ভি দেখুউ।
তারপর নিজে খুলে স্ট্যাচু। কি বুঝলেন, কেন এমন হল?কারন ভেতরে গলা কাটা লাশ ছিল।
আমার প্রথম ব্যাগে দুটো কম্বল, দ্বিতীয়টাতে তিনচারটে কাঁথা আর তিননম্বরে বিছানার চাদর, প্যান্ট শার্ট গেঞ্জি। চিরকুটও আছে- অবশ্যই কাজের মানুষ দিয়ে ধুয়ে নেবে। ঢাকায় খালার বেশি বয়স, কোমর ব্যথা। কাপড় ধুতে পারেনা।
আমাদের আমেনা বুয়ারও বয়স অনেক। টুকটাক কাজ, আম্মার কাজ করে। বাকিসব আমিই করি। অন্যসময় ব্যাপার ছিল না। এখন কোমর ব্যাথায় মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম।
কমবয়সী একটা মেয়ে ছোটবাচ্চাসহ প্রায়ই ভিক্ষা করতে আসে। ওকে দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। চা বিস্কুট খাইয়ে বলেই বসলাম। বেশ টাকাও দিতে চাইলাম। সে বোধহয় আকাশ থেকে পড়ল। মুখ ছাইবর্ন করে বলল-“আপা আইজ হবার নয়। ছাওয়া কোনা কান্দবে। কাইল আসিম।”
আমি ঘপাত করে হাত ধরে বললাম- আসিও। খুউব বিপদ!
তার অবস্থা”ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি”। সেই যে গেছে আজও তার ছায়া দেখিনি।
মামীমা ফোন দিয়েছেন। একথা সেকথায় ইনিয়ে বিনিয়ে বলেই ফেললাম কারন তার দুটো কাজের মানুষ।
– মামীমা আমার তো কোমর ব্যথা। অনেক ময়লা কাপড় চোপড়। কি যে করি!
– তুমি এক কাজ কর সবগুলো ভালো করে ডিটারজেন্ট দিয়ে ভিজিয়ে উপরে নিয়ে আস। ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে খালি শুকাতে দিবা। অনেক সহজ হবে। কষ্টও হবেনা।
আমি নাকি তার মেয়ে সবাইকে বলে। আজ তার প্রমান হল। সব দিলেও কাজের মেয়ে দিতে নারাজ। কারন সে চলে গেলে বিপদ! চার- পাঁচ বালতি কাপড় টেনে টেনে দোতলায় তুলব। তারপর মেশিনে কেচে শুকাতে দিব। ভেবে মাথায় মোটামুটি আগুন ধরে গেল। গু মারি তোমার মেশিনে। ওর চেয়ে সহজ আমার বাসায় ধোয়া।
ভাবীকে বললাম- সে শুরু করল তার দুঃখ। মনোয়ারা জিভ দেখিয়ে, বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, মাটিতে লাথি মেরে আজই ঢাকা যাবার হুমকি দিয়ে চলে গেছে। অঙ্গভঙ্গির কারন কি জানেন, সে কথা বলে বোঝা যায় না মানে প্রতিবন্ধী। তোয়া বাবু তাকে ছাড়া থাকতে পারেনা। তাই এ কাজ সে প্রায়ই করে। আবার হাত- পা ধরে তাকে আনা হয়।
ভাড়াটিয়া বউদি বলল, একজন আছে। আমি বিকেলে আপনাকে নিয়ে যাব। বিকেলে নিয়ে গেলেন। কাপড় চোপড় ভালোই পড়েছি। মনেহয় তার মনমতো হয়নি। আগাগোড়া ভালো করে দেখলেন। মোটামুটি একটা ইন্টারভিউ দিতে হল। কি করি, কোন বাসা এসব। সব ঢেলে দেবার পরও কাজ হল না।
– “আপা হামার হবার নয়। হামরা তো তোমার পাশে জজের বউয়ের কাম করি। জজের করোনা হইছিলো তাই কয়দিন কাম আছিলনা। ছুটা কাম করচিলাম। কাইল থাকি ফির জয়েন করমো। কিচু মনে করেন না, চা খাও।”
জজের বউ না হবার আফসোসে সারারাত ঘুম হলনা। করোনাও কেয়ার করেনা। পরদিন দিপ্তী ফোন দিয়েছে
– আপু গলা বসা কেন? ঘুমাও নাই।
– আর বলিসনা তোর ভাইয়ার যাবার সময় হয়ে এল। এখনও কাপড় ধোয়া হয়নি।
– আহারে! বলকি? এখনও ধোও নাই। আচ্ছা এক কাজ কর ব্যাগ কয়টা আমার বাসায় নিয়ে আসো। আমার বুয়াকে আজাদের কাপড় বলে ধুয়ে নেব। ধরা পড়লে বকশিস দিব না হয়। ওর ভালোবাসায় সিক্ত হলাম। কিন্তু সে আমার থেকে বিশ পঁচিশ কিলো দুরে থাকে আর আমি নাকি ব্যাগ নিয়ে যাব।
বললাম- একটা ট্রাক ভাড়া করে বাকি কয়টা সহ না হয় তোর বাসায় উঠেই যাই।
বেজায় খুশি সে- তাহলে তো অনেক মজা। চলে আস।
অবশেষে বুদ্ধি এলো আমার জমিজমা দেখাশোনা করে খলিল ভাই। গ্রামে তাকে দেখেছি পুকুরে নেমে সব ধুয়ে ফেলে। তো সে আজ আমার বাগানে কাজ করতে এসেছে।মহাখুশি হয়ে খলিল ভাইকে গিয়ে বললাম। সে ভীষন মাইন্ড করল।
-“এটা তো শহর। মাইনসে দেখলে মানসম্মান কিচু থাকপে। হামার কি কিচু নাই।”
অনেক বলে কয়ে তাকে রাজী করালাম। আল্লাহর নামে কাপড় ভিজিয়ে তার অপেক্ষা করছি। আধাঘন্টা পর সে এল হাত টিপে ধরে, রক্ত পড়ছে। কলার গাছে না কুপিয়ে নিজের হাতে কোপ মেরেছে। বুঝলাম না কপাল খারাপ না ইচ্ছে করে।
হাহ! এতটা হতাশ, নিরাশ, অসহায় কোনদিন লাগেনি। কাপড় তো ভিজিয়েই ফেলেছি। তাই কোমরে বেল্ট খুব শক্তপোক্ত করে বেঁধে নেমে পড়লাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হল খেলা। কোমরের কটকটানি, কামড়ানো, টেনে ধরা বিভিন্ন কার্যক্রম। আমি একবার বসে,কাত হয়ে, হেলান দিয়ে, চিৎ হয়ে, পা সোজা করে, আবার দাঁড়িয়ে পা দিয়ে কাপড় কাঁচতে থাকলাম। নিজের অজান্তে কষ্টে- যন্ত্রনায় চোখের পানি, নাকের পানি, ট্যাপের পানি সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল! এত পানি, এত পানি চোখে ছিল যে নিজের বিয়েতেও বোধহয় এতটা বের হয়নি!
হাসছেন? হাসেন কিন্তু নিজের খেয়াল রাখবেন। কারন আমরা তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। কিছুদিন পর কাজের মানুষ পাওয়া যাবেনা। সব কাজ নিজেকেই করতে হবে। তাই নিজের যত্ন নেয়া, সুস্থ থাকা জরুরি।
সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন। শুভ রাত্রি🥀🥀🥀🥀🥀
ছবি- সংগ্রহ।
১৯টি মন্তব্য
আরজু মুক্তা
হা হা। ওয়াশিং মেশিনের দামও কমছে। বাচ্চাদের এখন থেকে কাজ শিখানো দরকার। আমার বাসায়, যার যার কাপড় সে সে ধোও। এই সিস্টেম চালু। অতএব নো টেনশন।
ভাড়াটিয়া, ব্যথা, বকশিস বানান সম্পাদন করুন
রোকসানা খন্দকার রুকু
বাচ্চারা যদি মেয়ে হয় তাহলে রক্ষা। আর বাচ্চার বাপের থ্যারাপীটা জানালে ভালো হত।
শুভ কামনা রইল।
আরজু মুক্তা
জমায় রেখে দেন। বুঝুক
আলমগীর সরকার লিটন
রম্যটা পাঠ করলাম মজাই লাগল আপু
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া।
শুভ কামনা রইল।
রেজওয়ানা কবির
আজকাল কাজের মানুষ পাওয়া চরম দুস্কর আপু😋এত সুন্দর করে কিভাবে রম্য লেখ তুমি?আমার পেটে তো বিরহ ছাড়া রম্য আসেই না।ইশ! যদি লিখতে পারতাম তোমার মত রম্য😋।হাসতে হাসতে পাগলপ্রায় আমি।আজাদকে পড়ে শোনালাম তার ও একই অবস্থা। সত্যি খুব মজা পেলাম।ভালো থেক।
রোকসানা খন্দকার রুকু
হুম বিরহ সবাই পছন্দ করে কারন মিলে যায়। তোমার লেখাও ভালো হয়।
আজাদকে বলো হাসির ট্যাক্স যেন দেয়। শুভ কামনা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
হাসব না বলে তো প্রথম থেকেই হেসে গেলাম,দিদি।
অনেকদিন পর এমন রম্যগল্প পড়ে মুগ্ধ।
রোকসানা খন্দকার রুকু
এমন মন্তব্যে প্রীত হলাম দাদা। হাসাতে পেরে ধন্য হলাম।
শুভ কামনা। ভালো থাকবেন।
ফয়জুল মহী
শীত আসছে শিয়াল মামাও ভয় পাচ্ছে। শীতে গোসশ করবো কাপড় বদলাবো না কথ একটা। 😀😀😀
রোকসানা খন্দকার রুকু
শিয়াল মামার চেয়ে মনে হচ্ছে আপনি বেশি ভয় পেয়েছেন। কিছুই করার দরকার নেই।
শুভ কামনা রইল ভাইয়া।
তৌহিদ
আহারে!! ব্যাগের মধ্যে থাকার কথা কি আর পেলেন কি!! অবশ্য শীত এসে গেলো এখন গরম কাপর ধুয়ে শুকাতেই হবে। সমস্যা হলো কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছেনা।
আমাদের এখানেও একই সমস্যা। চিন্তায় আছি নিজেরাও।
রোকসানা খন্দকার রুকু
বড্ড বেরসিক। কাপড়ের সাথে ছোট খাট কিছু রাখলেও হত।
কপাল, কপাল!!
আর শীত কম থাকতেই ধুয়ে ফেলুন। অবশ্যই আপনিও সাথে থাকবেন।
শুভ কামনা ভাইয়া।
শুভ সকাল।
জিসান শা ইকরাম
কাপড় কাঁচার বিরম্বনা ভালোই ফুটিয়ে তুলেছেন।
কাজের বুয়া আপনার ইন্টারভিউ নিলো, এরপর পছন্দ হয়নি বলে জজের বাসার অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেলো 🙂 খুব মজা পেলাম এটুকু পড়ে।
একটি সময়ে কাজের লোক এত ব্যয়বহুল হবে যে তা রাখা আর সম্ভব হবে না। বিদেশের মত সব কাজ নিজেকেই করতে হবে।
রম্যে আপনি সোনেলার সেরা হবেন এটি নিশ্চিত ধারনা করছি আমি।
আরো রম্য লিখুন।
শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
কোমরের বেল্ট তাহলে শক্তপোক্ত করে বেঁধেই ফেলি।
সেরা তো হতেই হবে। আর এমন উৎসাহ দিলে তো হওয়াই যায়।
অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ভাইয়া।
শুভ কামনা। শুভ সকাল।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনার রম্য লেখাগুলো খুব ভালো লাগে আপু। এতো চমৎকার ভাবে গল্প কিভাবে সাজায় আমি বুঝিনা। আপনার প্রতিটা গল্প অসাধারণ। স্বামীরা এমনি বেরসিক হয় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে। বুয়া নিয়ে আপনার উপস্থাপন গুলো দারুন হয়। নিরন্তর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো
রোকসানা খন্দকার রুকু
দিদিভাই আপনার স্বপ্নটা দারুন ছিল। রম্য জমেছিল খুব। কলম আবার ধরেন হয়ে যাবে। সবসময় আপনার মন্তব্য মিস করি। আমি এমনি খামখেয়ালী মজার মানুষ এজন্য স্টুডেন্টরা ভীষন ভালোবাসে।
ভালো থাকবেন সবসময়।
শুভ কামনা রইলো।
ছাইরাছ হেলাল
কাজের বুয়া আর-না আর-না। মেশিন আছে-না!!
সাহেব এলো আর কোমড় ব্যাথা-ও সাথে করে নিয়ে এলো! ময়লা কাপড় ও!
দেখলেন তো, কোমড় ব্যাথা বলে পাড় পাওয়ার আর উপায় নেই।
রোকসানা খন্দকার রুকু
একদম ঠিক কথা। সবসময় তো আর ধুতে দেয়না।
এমন সময় কোমর বড্ড বেরসিক আচরন করে ফেলেছে।
শুভ কামনা রইলো ভাইয়া।