“কিছু চাঁদ আকাশে নয়, ফুটপাতেও থাকে।”
লাইনটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কোথাও পড়েছি না এমনি তা মনে করতে পারছিনা। রান্না করছি,খাচ্ছি,কাজে যাচ্ছি লাইনটি মাথায় নিয়ে।
প্রায় প্রতিদিনই শহরের কোন না কোন ফুটপাতের পাশেই তাঁকে দেখি। লালটুকটুকে পান খাওয়া ঠোঁট,মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল কাঁধে একটা বিরাট বড় ঝোলা, দুহাতেও দুটো।এত কষ্ট করে কাঁধে নিয়ে কেন সে ঘোরে?আজ একফুটপাত কাল অন্যফুটপাতে।কারনটা অবশ্য অন্য।কেউ হয়ত তাঁকে বিরক্ত করে কিংবা দোকানের সামনে বলে উঠিয়ে দেয়। তারপর সে আবার ভারী পোটলাগুলো কাঁধে নিয়ে নতুন জায়গা খুঁজতে থাকে।নতুন বাসা বাঁধে অন্য কোনো ফুটপাতে।
আমার ওর পোটলা গুলো একবার তুলে দেখতে ইচ্ছে করে।এত ভারি কি করে টানে?সে আশায় পান কিনে গেলাম তাঁর কাছে।অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।বললাম- পান তোমার জন্য।পান খেলে তোমাকে সুন্দর লাগে।
এবার সুন্দর করে হাসল।পান খেল মাথা চুলকাতে চুলকাতে। আমি চলে এলাম কিন্তু মাথায় থেকেই গেল।সবাই পাগলী বলে আমার মানুষ বলতেই ভালো লাগে।মনে মনে ওকে গোসল করিয়ে সুন্দর কাপড় চোপড় পড়িয়ে দিলাম। বাহ্ দারুন!গোলগাল মুখ, গালে টোল পড়ে।মায়ামায়া চেহারা।বেশ সুন্দর ছিল বোঝাই যায়।
শীতের সময়টা না জানি কত কষ্টে কাটে ওর।মাথার উপর খোলা আকাশ তবুও নিশ্চিতে ঘুমায়।আমরা ঘরের ভেতরে হিটার চালিয়ে ঠকঠক করে কাঁপি।অথচ সে দিব্যি কাটিয়ে দেয়।
আর একদিন গেলাম পান দিতে।সামনের দোকানি বলল-মারবে।
নাহ্ মারেনি। কিন্তু পানটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।কি আবার হল!আজ বোধহয় মেজাজ খারাপ।
– কি হয়েছে তোমার? কি যে বলছে আ – উ করে কিছুই বুঝতে পারছি না। বুঝলাম কথা বলতে পারেনা।বোবা। কিছু একটা হয়েছে এটা বোঝা গেল। তলপেট দেখিয়ে কি যেন বলছে। তলপেটে ব্যাথা।পাশের দোকানী বিচ্ছিরি ভঙ্গিতে হাসছে।
আমার ভালো লাগলো না।উঠে এলাম।
পরের দুদিন তাঁকে কোথাও দেখতে পেলাম না।মনে মনেই খুঁজে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম।মাথা নিচু করে বলল – আমার আর কাজ নাই। আপনার মত পাগল ছাগল নিয়ে থাকব।
আমার কেমন সন্দেহ হল।চলে এলাম।রাত আটটার পর ছোট্ট মোড়ের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।আমরা কজন মিলে হাটতে বের হই।আজও হাঁটছি, সবাই বিভিন্ন সাংসারিক গল্প করছে।অন্য সময় আমিও বলি।আজ আমি কিছুতেই মনোযোগী হতে পারছিনা।সকালের ঘটনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।আমি দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম।দোকানির গোডাউন মত একটা দোকানের সাথেই সবসময় তালা দেয়া থাকে।এখন তালা ঝুলছে না।জানতে ইচ্ছে হল এটাতে কি আছে।ভেতরে অল্প আলো জ্বলছে। খুটখাট শব্দে আমার সন্দেহ হল।আমি শাটারে জোরে জোরে ধাক্কা দিলাম।বাকি সবাই আমার কান্ড দেখে একটু অবাক।
দোকানি বের হয়ে এল।
– আপনি এতরাতে ভেতরে কি করছেন?
দোকানি বলল-কি করছি আপনাকে বলতে হবে। আমার গোডাউনে কাজ থাকতে পারেনা। জিনিস পত্র গুছাচ্ছি।আপা প্লিজ নিজের কাজে যান।
চলে এলাম। আমার সাথের সবাই একটু বিরক্ত।বাসায় ফিরে আমার পুলিশ বন্ধুকে জানালাম।সে হাসতে হাসতে খুন।
– তোমার ইদানিং কি হয়েছে বলতো? আজব সব জিনিস নিয়ে ভাবছ। ডাক্তার দেখাও। আমার পরিচিত সাইক্রিয়াটিষ্ট আছে। বলোতো সিরিয়াল দেই।
নিরাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকলনা।এরপর কদিন অন্যসব কাজে ব্যস্ত ছিলাম। হাঁটতে বের হইনি।খোজ নেবার জন্য বের হয়ে দেখি মোড়ের দোকানের ফুটপাতে।পান খাচ্ছেনা,লাল ঠোঁটও নেই।শুয়ে আছে গুটিশুটি মেরে।দেখে মায়া হল।আমি পান কিনে এগিয়ে দিলাম।
– কোথায় ছিলে এ কদিন!
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল।তলপেটে হাত দিয়ে বুঝিয়ে দিল ব্যাথা।বুকে ব্যাথা।পায়ের কাপড় তুলে দাগ দেখালো।
খেয়াল করলাম গলার কাছেও কালো দাগ।ঠোঁটের কোনায় ফেটে রক্ত শুকিয়ে গেছে।আমাকে বোঝালো তাঁকে বেঁধে রেখেছিল এবং অনেক ব্যাথা দিয়েছে।
– আমার সাথে চল।যাবে?
হাত নেড়ে নেড়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বোঝালো আমরা ভালো না।কোথাও কেউ শান্তি দেবেনা।পানটাও নিলনা আজ।আসতে দোকানির দিকে তাকালাম শুকরের দাঁত বের করে হাসছে। বুঝলাম সেই তাঁকে বেঁধে রেখে এতদিন রেপ করেছে।
পাগলির পেট ফুলে উঠছে একটু একটু করে।আজকাল সে আর ভারি ব্যাগগুলো নিয়ে হাটেনা।চুপচাপ শুয়ে থাকে। আমি মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে দিয়ে আসি।অন্যএকটি চালার নিচে আশ্রয় নিয়েছে।মা মা চেহারায় বেশ ঢলঢলে সুন্দর লাগছে।
চাঁদের মত ফুটফুটে মেয়ে বাচ্চা হয়েছে।পাগলির আচরনে অনেক পরিবর্তন এসেছে।মা হওয়ায় ওর দায়িত্ব বেড়ে গেছে।আদরে মশগুল।নিজেও বেশ পরিচ্ছন্ন হয়েছে।বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। আমি বাচ্চার কয়েকটা কাপড় কিনে নিয়ে গিয়েছি।সে আরও কয়েকটা বের করে দেখালো আর খুশিতে খে খে করে হেসে উঠল।খুব জেদ করলাম আমার সাথে আসতে।সে কিছুতেই এলনা। বাচ্চাকে আদর করতে গেলেই জোড়ে বুকে চেপে ধরল।বুঝতে বাকি রইল না সে কাউকেই বিশ্বাস করে না।
যে কোন পুনর্বাসন কেন্দ্রে কথা বলতে পারলে ভালো হত।অন্তত ওর বাচ্চাটার একটা সুন্দর পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ হত। তানাহলে হয়ত কোন একদিন সেও মায়ের মতই হায়েনাদের শিকার হবে।মনের ভেতর এমন সাত পাঁচ ভাবনা চলছিল।
আমরা অনেকেই ভালো কিছু করার জন্য ভেতরে ভেতরে তাগিদ অনুভব করি। বাস্তবতা অনেক কঠিন।পরিবেশ,পরিস্থিতি,সামর্থ্যের অভাবে আর করা হয়ে ওঠেনা।আর যাদের এরকম বাধাবিপত্তি থাকেনা তাঁদের সদিচ্ছার বড় অভাব।
কদিন থেকে বেশ জ্বর বিছানা থেকেই উঠতে পারলাম না। আশেপাশের যারা আমায় দেখতে এল অন্য আলাপচারিতার মাঝে জানতে চাইলাম তাঁর খবর।অবাক চোখে তাকায়।কেন যে তাকায়।হয়ত ভাবে আমার মাথা নষ্ট কিংবা সারাক্ষন একা একা থাকি বলেই এসব ভাবি। আচ্ছা সরকার এদের নিয়ে ভাবেনা কেন?সঠিক পরিচর্যা পেলে তো ভালোও হয়ে যেতে পারে।
সাতদিন পর একটু ভালো বোধ করলাম। গেলাম তাঁর কাছে।একি অবস্থা!হাতে পায়ে মারের দাগ।আর বাচ্চাটা কই?পাগলি চিৎকার করে করে কাঁদছে।আমাকে দেখে আরও জোরে কেঁদে ওঠল।কেউ তাঁকে মেরে তাঁর বাচ্চাকে নিয় গেছে।আমার হাত থেকে খাবার দাবার সব খসে পড়ে গেল। কেন আমরা এমন!কাউকে তাঁর ইচ্ছেমত বাঁচতে দিতে চাইনা।নিজের প্রয়োজনে একটা বোধহীন মানুষের সাথে শারীরিক লীলা চালাই।সে যখন আবার সুখী হবার আশায় নিজেকে তৈরি করে ঠিক তখনি তাঁর সুখটুকু আবার কেড়ে নেই।
২৭টি মন্তব্য
শামীম চৌধুরী
আপনার অনুগল্পটি পড়ে আপ্লুত হলাম।
চাঁদ যখন আলো ছড়ায় তখন সেটা ফুটপাতেও গড়ায়।
শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
প্রথম মন্তব্যের জন্য অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।আপনার সাথে আমিও সহমত।দোয়া করবেন আর পাশে থাকবেন।
শুভ কামনা।
সুপায়ন বড়ুয়া
সমাজের এই অন্ধকার দিক গুলো থেকে কবে মুক্ত হবে
জানা নেই।
তবে আপনার মতো আমার বলতে ইচ্ছে করে
কিছু তারা আকাশে নয় ফুটপাতে ও থাকে।
রাতের আধাঁরে ফুঠে আলোতে অদৃশ্য হয়ে যায়।
ভাল থাকবেন শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
মানুষের এই অন্ধকার দিক কেটে মানবতা ফুটে উঠুক এই কামনা।তারা ঝলমলে সময়েরই অপেক্ষা।
শুভ কামনা রইল দাদা।
ভালো থাকবেন।
ফয়জুল মহী
অতীব সুন্দর প্রকাশ।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া।
দোয়া করবেন। শুভ কামনা।
খাদিজাতুল কুবরা
হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো গল্পটি পড়ে। অহরহ ঘটে চলছে এসব অনাচার। রাতের বেলা পাগল ও যাদের হাত থেকে রেহাই পায় না। দিনের আলোয় তারাই বুক ফুলিয়ে চলে।
উন্নয়নের জোয়ারে এই ভারসাম্যহীন মানুষগুলোর ভাসার অধিকার নেই। এদেরকে বাদ দিয়েই আমরা ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছি। তবে আর কাজ কি?
শুভকামনা কলমের জন্য।
লিখুন মানুষের কথা যাদের কথা বলার ক্ষমতা নেই।
অনেক ধন্যবাদ।
রোকসানা খন্দকার রুকু
উন্নয়নের জোয়ারে এই ভারসাম্যহীন মানুষগুলোর ভাসার অধিকার নেই। এদেরকে বাদ দিয়েই আমরা ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছি। তবে আর কাজ কি?*****
অসাধারণ বলেছেন।।। শুভ কামনা রইলো।
শুভ সকাল। ভালো থাকবেন।
কামাল উদ্দিন
কয়েকদিন আগে ফেজবুকে পড়েছিলাম পাগলিটা মা হয়েছে বাবা হয়নি কেউ। তারই বাস্তব চিত্র আপনার গল্পে ফুটে উঠেছে আপু, যা আমাদের সমাজের একটা অন্ধকার দিক। গল্পটা পড়ে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো, জানিনা আমরা কবে মানুষ হবো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আসলেই আমরা কবে যে মানুষ হয়ে উঠব।আশায় বাঁচি।
শুভ কামনা ভাই। শুভ সকাল।
ভালো থাকবেন।
আরজু মুক্তা
সমাজের অন্ধকার দিক।
তবে, মাতৃত্ব আলাদা জগত। সবাই তার সন্তানের নিরাপত্তা চায়। ভালো চায়।
সরকার নিশ্চয় এ ব্যাপারে সচেতন হবেন।
রোকসানা খন্দকার রুকু
সরকারের আসলেই পদপদক্ষেপ নেয়া দরকার।আর আমাদেরও।
শুভ কামনা। শুভ সকাল আপু।
রোকসানা খন্দকার রুকু
সরি পদক্ষেপ হবে।।।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বাস্তবে এরকম ঘটনা ঘটেছে। আপনার সুন্দর লেখনীতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেলো। মানুষ কতটা অমানুষ হলে , মানবিকতা বিসর্জিত হলে এরকম পাগলী , বোবার সাথে এভাবে নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে! মানবতা আজ ডুকরে কেঁদে মরে। ব্যথায় মনটা ভরে উঠলো। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন শুভ কামনা রইলো
রোকসানা খন্দকার রুকু
কদিন আগে পড়লাম করোনা রোগী কে ধর্ষণ করেছে।।
নারী যে মানুষ হবে কবে?
শুভ কামনা দিদি।
শুভ সকাল।
সুরাইয়া পারভীন
মানুষ হিসেবে আমরা কতোটা ভয়াবহ বিভৎস মস্তিষ্কের অধিকারী তা এই সব ঘটনা থেকে জানতে পারি। আহারে! এমন গল্প পড়লে কান্না চেপে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। সভ্য জাতির মুখোশে অসভ্য বর্বর জাতি হিসেবেই বেশি পরিচিত আমরা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
অনেক সুন্দর করে বললেন। আসলেই মুখোশের আড়ালে আর কতদিন?
শুভ কামনা। শুভ সকাল আপু।
তৌহিদ
আবেগী হয়ে পড়লাম লেখাটি পড়ে। সহায়সম্বলহীন অসহায় মানুষদের যারা ঘৃণ্য কাজে ব্যবহার করে তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
আমাদের বুঝতে হবে তারাও মানুষ, কারো বোন, কারো সন্তান। মানবতা মনুষ্য হায়েনাদের কাছে রক্তলোলুপ হয়ে উঠেছে। একটি লাইন মনে পড়লো- “পাগলীটা মা হয়েছে…….”
চমৎকার এই লেখাটির জন্য আপনাকে শতসহস্র অভিবাদন জানাচ্ছি। এরকম লেখা আরো চাই কিন্তু!
শুভকামনা সবসময়।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন চমৎকার মন্তব্যের জন্য। শুভ কামনা। শুভ সকাল ভাই।
তৌহিদ
শুভ দুপুর আপু।
ছাইরাছ হেলাল
গল্পে আমাদের সমাজের একটি অন্ধকার দিক তুলে এনেছেন সুন্দর করেই।
রোকসানা খন্দকার রুকু
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। শুভ কামনা।
শুভ সকাল।
আলমগীর সরকার লিটন
চমৎকার লেখেছেন রুকু আপু অনেক শুভ কামনা জানাই
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনাকেও ধন্যবাদ ও শুভকামনা ভাই।
ভালো থাকবেন।
আলমগীর সরকার লিটন
জ্বি আপনিও ভাল থাকবেন—–
হালিম নজরুল
“কিছু চাঁদ আকাশে নয়, ফুটপাতেও থাকে।”
চমৎকার শিরোনাম। লিখেছেনও চমৎকার।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া। শুভ কামনা রইলো।
ভালো থাকবেন।