জয় আর তিথী দুজনেই আমার অতি প্রিয়॥ ভার্সিটিতে জুনিয়র ছিল কিন্তূ সম্পর্ক বন্ধুর মতই।তিথী আমার মামাত বোন।সবরকমের দুষ্টুমি হয় ওদের সাথে।এটা আগে ছিলনা।জয় অসম্ভব মিশুক এবং দুষ্টু একটা ছেলে। আমি গম্ভীর হলেও ওর কাছে শেষ রক্ষা হয়নি। আমি প্রথম যখন জানলাম তিথী জয়কে পছন্দ করে। আমি না করে দিয়েছিলাম। বড় বোন বলে কথা।যত ভালোই হোক আপনাকে না করতেই হবে।
যা হোক বেশ কদিন থেকে আমায় ওদের বাসায় ডাকছে।অনেকগল্প জমে আছে।আপু আস,অনেকদিন দেখা হয়না ।করোনার সময় আর ওরা আমার থেকে চল্লিশ কিলো দুরে থাকে।মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না যাবার ব্যাপারে।
তারপরও অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়না॥ওদের সাথে জম্পেশ আড্ডার লোভটাও সামলাতে পারছিলাম না।অবশেষে করোনাকালীন সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে বিসমিল্লাহ বলে রওয়ানা দিলাম।
দুর যেহেতু,ভেবেছিলাম বাসে যাব।বাসস্টপে গিয়ে তো হা।কিসের একসিট ফাঁকা আর তিনফুট কিংবা স্যানিটাইজার,কিচ্ছু নেই।আমি বেশ চিন্তিত হলাম।দেখি অনেকেই রিজার্ভ অটোতে যাচ্ছে।সেখানেও একই অবস্থা সামনে দুজন আর পেছনে আমরা পাঁচজন। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা কোনভাবেই সম্ভব নয়।তারমধ্যে দুজন আঙ্কেল আন্টি ও আছেন।
কুড়িগ্রামে করোনা প্রকোপ বেড়ে গেছে।আর্মিরা মাস্ক ছাড়া কোথাও যেতে দিচ্ছেন না।
অটোঅলা ভাই তাই সবাই কে মাস্ক পড়তে বলল।
চাচাকে বললো-চাচা মাস্ক পরো বাহে।নাইলে অটো যাবার দিবার নয়।
চাচা খুব আরাম করে পান খাচ্ছিলেন,মাস্ক কানে ঝুলিয়ে।বিরক্ত হয়ে বললেন-
থাকেন তো বাহে।মোক পানটাও খাবার না দেন। তোমার গুলার মুখ দেবরির জলান আর ভাল নাগেনা। আল্লাহর উপরে বিশ্বাস নাই খালি মুখদেবরি।(কুড়িগ্রামের ভাষা,মুখদেবরি হল গরুকে আটকাতে ব্যবহার করা হয়)।
কমবয়সী একটা ছেলেও ছিল।সে কিছুতেই মাস্ক লাগাবে না। সিগারেট ধরিয়ে টানছে।আমার পাশে বসা মেয়েটি তাকেবলল-
ভাইয়া আমরা খুব খারাপ সময় পার করছি আমাদের সবার নিয়ম মেনেই চলা উচিত।আপনি নিয়ম মানবেন না কেন?
ছেলে খেকিয়ে উঠল- অত জ্ঞান দিতে হবেনা। আমার কিছু হবেনা।
-হ্যাঁ,অটোতে বয়স্ক আঙ্কেল আন্টি আছে।তাদের জন্যই তো আমাদের সাবধানে চলাচল করতে হবে।
-এই চুপ থাকেন তো!
-অটোঅলা ভাই এতকরে বলছে। না পড়লে নেমে যান আমার অফিসে দেরি হচ্ছে।
-ছেলেটি খুব জোড়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো।আমি কে আপনি জানেন? লীগ করি।আমারে না নিলে অটোর বাপের সাহস আছে যায়।সব গুঁড়া করে ফেলব।মহিলা মানুষ মহিলার মত থাকেন।দুনিয়া মেরে খান তাতে কিছু নাই॥আমার মাস্কে তার করোনা হবে।আমি কি করোনা রোগী নাকি?
মেয়েও ছেড়ে দেবার পাত্রি নন।
-এই বেয়াদব ছেলে চুপ কর?তুমি জানো কিছু।
বেয়াদব বলায় আরো হইহই কান্ড রৈরৈ ব্যাপার হয়ে গেল।ছেলে কারে যেন ফোন দিল।মেয়েরে সাইজ করবে এবং তাকে আর এই অটোতে যেতে দিবে না। চলছে তর্কবিতর্ক।
-আমি মহিলা তো কি হয়েছে?
-হ্যাঁ, আপনারা যত সমস্যা। আপনাদের পাপের জন্যেই আজ করোনা আসছে।
শুরু হল মহিলা বিষয়ক ওয়াজ।আমি নিরীহ মানুষ।তারউপর মাস্টার।চুপই ছিলাম। কিন্ত মহিলা বিষয়ক খিস্তিতে আর থাকতে পারলাম না।মেয়েটিকে চুপ থাকতে বললাম।ছেলেরে বললাম তুমি নেমে যাও।সে কিছুতেই নামবে না।মাস্কও পড়বে না এবং এই অটোতেই যাবে। উৎসুক জনতার ভিড় জমেছে মজাও পাচ্ছে।
অটোঅলা আমাদেরই নেমে যেতে বলছে।
হঠাৎ,ম্যাডাম কেমন আছেন?কি হয়েছে?
আমি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম।
আমার ছাএ জীসান।ফাইনাল ইয়ারে পড়ে।আমি সবই বললাম। আঙ্কেল আন্টি ও বলল।
ছেলে অটো থেকে নেমে ধপাস করে জীসানের পায়ে পড়ল। ভাই আপনি তো আমারে চিনেন আমি লীগের একজন কর্মী।আমাকে নিয়ম শেখায়।দেশের জন্য আমরা কত কিছুই করছি।আর আমারে এই মহিলা অপমান করছে।বিচার চাই ভাই।
শার্টের কলার ধরে ছেলেকে নিয়ে দিল উত্তম মধ্যম।ব্যাটা তুই কোনদিন নেতা হইলি।দলের নাম ভাঙ্গায়ে খাস।তোদের জন্যই যত সমস্যা।
অনেক ঝামেলার পর অটো চলছে। আমার বুকের ভেতর কেমন যেন করছে।মেয়েটির সাথে কথা বললাম স্বাভাবিক হবার জন্য।সে অর্ধেক রাস্তায় নেমে গেল।বাকি যাঁরা ছিল কেউ মাস্ক খুলে পকেটে রেখেছে।কারও কানে ঝুলছে।যেতে যেতে দেখলাম একজনের মাস্কের একটা ফিতাও ছেঁড়া।
সারা বিশ্ব পর্যুদস্ত করোনা ভাইরাস এর কবলে।হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।কেউ জানে না শেষ কোথায় ! কতদিন আমরা কলেজে যাইনা।লেখাপড়া, পরীক্ষা সব বন্ধ হয়ে আছে।আর কিছু মানুষ কিছুই বুঝতে পারছেনা। আমি বেশ চিন্তিত বোধ করলাম।
এতক্ষনে অটো অলা মুখ খুলল। শুনলাম তার চুপ থাকার কারন।এরা রীতিমত জিম্মী।তখন কিছু বললে পরে ঝামেলা করত।সেও বোঝে ছেলে বেয়াদব কিন্তূ কিছু করার নাই।
অবশেষে পৌঁছে গেলাম।হইহই করতে করতে জয় বেড়িয়ে এলো। আনন্দে তার ডগমগ অবস্থা।বাইরে থেকে রান্নার মৌ মৌ গন্ধ পাচ্ছি।জয় আমার হাত ধরে প্রায় হিরহির করে টানতে টানতে নিয়ে গেল।
– ঈশ্ কতদিন পর দেখলাম। তিথী তোমার জন্য পোস্ত ইলিশ রান্না বাকি রেখেছে।দেরি করলে কেন?কত কথা।
আমি আসার সময়ের সব কস্ট ,ঝগড়া ভূলে গেলাম।
তিথী হেলে দুলে আস্তে আস্তে আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল।
আমি ওকে বললাম-পাগল এখন জানিসই তো সময় খারাপ।আমরা তো আগের মত আসতে,যেতে পারিনা।কি করবি বল,কস্ট সবার হয়।
জয় কানের কাছে মুখ এনে বলল।আপু তিথী পজিটিভ। তাই কাঁদছে।
-ও আচ্ছা।
আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আমি তিথীকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম।সে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। আমার মাথা ঘুরছে। ভাবতেই পারছিলাম না আমি কি অপরাধ করেছি যে,আমায় করোনার দাওয়াত দিল।এ জন্যই আমাকে রিসিভ করতে জয় একা ছিল। তিথী ছিলনা। হাঁটছে ও হেলেদুলে। অসুস্থ তাই। শিক্ষিত মানুষেরএতটুকু আক্কেল নেই। বুড়ো বয়সে করোনা হলে আমার কি আর রক্ষা আছে?চুমুও দিয়েছি।বিয়ের আগে জয়কে অপছন্দ করাটা এমনিই ছিল। মামা মামীকে দেখানোর জন্য। তাই বলে সে সুযোগ এ ছিল। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত অবস্হা।বোনও তাতে সায় দিল।
বাথরুউম,,, বলে আমি আর কিছু বলতে পারি না।
কতক্ষন জানিনা।চোখ মেলে দেখি আমি জয়ের কোলে আর তিথী আমার সামনে মাটিতে।মুখের একদম কাছে।
আর সহ্য হচ্ছে না।
– তিথী তুই পজিটিভএটা জেনেও কেন জড়িয়ে ধরলি?মুখের সামন থেকে সর। কান্ড জ্ঞান নেই। আমি তোর কি ক্ষতি করেছি?
তিথী আমার প্রায় বুকের উপর উঠে বসল।জয় হো হো করে বেহায়ার মতো হাসছে। তিথী আর দুটো চুমু দিয়ে দাও তাড়াতাড়ি ধরুক।
– ক্ষতি তো করেইছ। আমাদের এত ভালোবাস,আদর কর,এতকিছু নিয়ে এসেছ,রেঁধে খাওয়াও,ভার্সিটিতে শাসন করেছ বলে পড়াশুনা ভালো করেছি। আমরা দুজনে ভালো চাকরি করি।
এবং এবং আমি মা হতে যাচ্ছি।মানে আমার প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট পজিটিভ।
এবার আমি খুশিতে কেঁদে ফেললাম।
– গাধা আগে বলবিনা?
-তুমি আর সময় দিলে কোথায়।কিছু না বলতেই তো…
জয় আবার হো হো করে হাসতে লাগলো।তিথীও হাসছে আমায় জড়িয়ে। আমি লজ্জা পেলাম।
কি একটা সময়! করোনা ছাড়াও যে আরও পজিটিভ আছে ভূলেই গিয়েছিলাম। অবশেষে শুরু হল আমাদের সেই আড্ডা।
১৯টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
বেশ মজার গল্প —————-
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
মাঝখানে করোনার বাস্তবতা দেখলাম, লোকজনের খামখেয়ালিপনা, দলীয় শক্তির খেলা দেখলাম। এই মহামারী নিয়েও সাধারণ মানুষের এসব ঘাড় ত্যারামি দেখতে ভালো লাগে না। শেষটা তো হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল। সবকিছুর মধ্যে করোনা ঢুকে গেছে। শুভ কামনা রইলো আপনার জন্য
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ক্ষমা অনেক আগে থেকেই চেয়ে নেয়া উচিত ছিল সবার কাছে। এতসুন্দর করে মন্তব্য করেন আপনারা সবাই কিন্তু আমিতো ধন্যবাদ ভাইয়া আর আপু ছাড়া কিছুই খুঁজে পাই না॥হয়ত হয়ে যাবে যতদিন না হয় ততদিন না হয় ক্ষমাপ্রার্থী হয়েই থাকলাম।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আরে নাহ কিযে বলেন। নিয়মিত থাকুন পাশে , লিখুন দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। শুভ কামনা অফুরন্ত
ছাইরাছ হেলাল
সুন্দর গল্প, বুঝতে পারিনি প্রথমে গল্প কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের।
আসলে করোনা আমদের জীবন ওলট-পালট করে দিয়েছে/দিচ্ছে।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
কিছু মানুষ তো বুঝতেই পারছেন না।
সুপায়ন বড়ুয়া
সবাই লীগ বেঁচে খায়
আবার কেউ সুযোগ পেলে ব্যবহার করে ইচ্ছে করে।
আমরা হতাশ হই করোনা থেকে শিখতে পারিনি জীবন থমকে যাবার পরে।
পজিটিভ বললে বন্ধুকে ও অবিশ্বাস করে বসি
কাকে দেব দোষ কাকে বলি পাপ
এ আমার দৈন্যতা শিখতে পারিনি বলে।
ভাল লাগলো। শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
দারুন বলেছেন। ধন্যবাদ।দোয়া করবেন।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
পড়তে গিয়ে আর পড়া হল না। “লীগ করি” বুঝে নিলাম গল্পে রাজনীতি ঢুকে গেছে। তাই ওখানেই শেষ।
ভালো থাকবেন ধন্যবাদ।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ঈশ্ কেন যে পড়লেন না রাজনীতি ছিল না। ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আসলেই না পড়াটা আমার বোকামি ছিল। অনুমান নিয়ে চলতে ধর্মেও নিষেধ তবুও দলকানা হলে যা হয়। তবে আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, মুক্তিযোদ্ধা দেখেছি, পাক আর্মিরা আমাদের বাড়ী পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল আর আওয়ামী লীগের হাত ধরে দেশের স্বাধীনতা এসেছে সবকিছু মিলে দলটার প্রতি ভীষণ দুর্বলতা। আসলেই খুব মিস করতাম সুন্দর এবং মজার গল্প। তথ্য বিভ্রাট — “কি একটা সময়! করোনা ছাড়াও যে আরও পজিটিভ আছে ভূলেই গিয়েছিলাম। অবশেষে শুরু হল আমাদের সেই আড্ডা”। ভালো এবং সুস্থ থাকবেন। শুভ কামনা রইলো।
ফয়জুল মহী
অতুলনীয় ভাবনায় অভিজাত লেখনী ।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। শুভ কামনা রইলো।
সাবিনা ইয়াসমিন
এমন এক দুঃসময়ে এসে পড়েছি যে এখন নেগেটিভ-পজিটিভ মানেই এক জিনিস বুঝি। ভাগ্যিস আপনার হার্ট বেশ শক্তপোক্তই আছে, তাই অল্পের উপর দিয়ে গেছে। নেতাদের নাম ভাঙিয়ে পাতিনেতারা যেভাবে ঘুরেফিরে বেড়ায় এভাবে আসল নেতারাও কোথাও ঘুরতে পারে না। খুব সুন্দর লিখেছেন রুকু। গল্পটা দারুণ উপভোগ্য হয়েছে 🙂
ভালো থাকুন সব সময়,
শুভ কামনা 🌹🌹
রোকসানা খন্দকার রুকু।
আপনার মত পারিনা। আপনার লেখা কেমন নেশা ধরিয়ে দেয়॥কি যেন আছে বা থাকে।অনেক বছর পর চেষ্টা করছি
প্রাপ্তি সবটুকুই আপনার।
নিতাই বাবু
চমৎকার লিখেছেন। মজার গল্প পড়ে ভালো লাগলো।
শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয়।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
দোয়া করবেন। ভালো থাকবেন।আর আমি এখনও পুরোপুরি শিখে উঠতে পারিনি।হয়ত সব লেখা পড়তে পারিনা।এমনও হয় নেটই পাইনা।কাল ফাল্গুনী আপুকে মন্তব্য করতে গিয়ে নেট অফ হয়ে গেল।সবাই মাফ করে দিয়েন।
নিতাই বাবু
কোনও সমস্যা নেই! নিজের সময়মত লিখুন! আমরা আপনার সাথে আছি।