রাগ চেপে রাখা আসলে কতটা কঠিন? নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখার মতোই কি? এই মুহূর্তে রাগে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে৷ আমি সজীবের দিকে আরো কয়েকবার রাগী রাগী চোখে তাকালাম। চোখমুখ কুচকে বসে থাকলাম। নাহ্, কিছুতেই কিছু হলোনা। একটা মানুষ রাগে ফোস ফোস করছে, অথচ তার পাশে বসে থাকা মানুষটার কোনো ভাবান্তর হচ্ছেনা। এটা এক প্রকার অপমান। সজীব আমাকে অপমান করছে, এটা ভেবে রাগটা আরো বহুগুণ বেড়ে গেলো। আমি আর থাকতে পারলাম নাহ্।
– সজীব, এই সজীব।
খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সে আমার দিকে ফিরে বলল,
– হুম, বলো।
– আমার তোমার উপর রাগ উঠেছে খুব।
– ওহ্, ভালো।
– নাহ্। রাগ উঠা মোটেও ভালো না।
– তাহলে রাগকে নামাও।
– নামাতে পারছিনা বলেই তোমাকে বলছি।
– আমাকে বলে কি লাভ?
– কারণ তোমার কারণেই রাগটা উঠেছে।
– ও আচ্ছা।
– তুমি কিছু বলবেনা?
– কি বলব?
– আচ্ছা, তুমি এমন কেন? বলেই আমি প্রায় কেঁদে দিলাম। রাগ উঠলেই কেন জানি আমার কান্না পেতে থাকে।
সজীব তারমতো চুপচাপ বসে আছে।
আমি তার পাশে বসে অনবরত চোখের পানি ঝরাচ্ছি। আমার শুধু বারবার মনে হচ্ছে, আমার স্বামী আমাকে একটুও ভালোবাসেনা। তবু নিজেকে কিছুটা শক্ত করে, জিজ্ঞেস করলাম,
– আচ্ছা, আমরা এখানে কেন বসে আছি? চলো, বাসায় যাই।
অনেকদিন পর বাহিরে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। অথচ ঘুরাঘুরি শুরু হওয়ার আগেই রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান দেখেই সজীব বসে পড়লো৷ তারপর থেকে পুরো একঘন্টা যাবত বসে আছি ।আশপাশের মানুষ আসছে। আমাদের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে। সজীবের কিছু হচ্ছে না। রাগে শুধু আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
সজীব উদাস একটা ভঙ্গি নিয়ে বললো,
– এখনি আসলাম। আর কিছুক্ষণ পর যাই। ভালোই লাগছে। ঠান্ডা বাতাস।
মুখ ফুটে বলেই ফেললাম,
– সজীব, আমার এখন খুব কান্না পাচ্ছে। তুমি জানো রাগ উঠলেই আমার কান্না পায়।
সজীব শুধু শুনলো মনে হলো। তারপর সে আগের মতোই নির্বিকার ভঙ্গিতে ঠান্ডা বাতাস খেতে লাগলো।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। রাগটা ঠিক কি কারণে সেটাও তাকে বলে লাভ নেই৷ কারণ আমার রাগ দুঃখ কিছুতেই সজীবের তেমন যায় আসেনা৷ সে তারমতো থাকে আর আমি আমার মতো। খুব রাগ উঠলেও সে সবকিছু নিবে হালকাভাবে। কত স্বপ্ন ছিলো আমার! আমার জামাইটা হবে সিনেমার নায়কদের মতো। কি আবেগ! নায়িকার চোখের পানিতে তার বুক মোচর দিয়ে উঠবে। অথচ সজীব এমন আচরণ করে,যেন সে খুব আবেগহীন।মাঝেমধ্যে সে কোনো কারণ ছাড়া কথা বলাও বন্ধ করে দেয়৷ কখনো আমার শত কথার একটাই জবাব দেয়, ‘হুম’। মাঝখানে মনে হতো, সজীব মনে হয়, আমাকে ভুলে অন্য কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছে। তাই আমার প্রতি আর কোনো আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছেনা। আমি লুকিয়ে ওর ফোনের সব চেক করলাম। নাহ্,কিছু পেলাম না। ফোন চেক করার কারণে ধরাও পড়লাম। ফোন হাতে নিয়েই সে বুঝে ফেলল। জিজ্ঞেস করলো, ফোনে কি করলে এতোক্ষণ? আমি বললাম,কই, কিছুনা তো। সে কেবল বলল, ও আচ্ছা। আমার কাছে সজীবের এই নিস্তব্ধতা, এই রাগ- অভিমান- অনুভূতিহীন, আবেগ বিবর্জিত ভাবটা খুব অদ্ভুত লাগে। যার ভেতর সামান্য অভিমান নেই, সে তো ভালোবাসতেও জানেনা বোধ হয়।মাঝেমধ্যে ওর জন্য খুব মায়া হয়। ভালোবাসতে না পারার অক্ষমতা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অক্ষমতা। সজীব কি এই অক্ষমতা নিয়েই জন্মেছে? নাকি হুট করে অক্ষম হয়ে গেছে? তার এই নির্লিপ্ততায় আমার রাগ কেবল বাড়ে৷ অভিমান হয় শুধু। কখনো চেপে রাখি। কখনো প্রচন্ড রাগে ফেটে পড়ি,কখনোবা কেঁদে কেটে একাকার। কিন্তু মানুষটার কোনো ভাবান্তর নেই। একজন আবেগহীন মানুষের সাথে বসবাস করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটা হয়তো। আমি সজীবকে বুঝতে পারিনা। কিন্তু কেন জানি ভালোবাসাটা বেড়েই যায় শুধু। অবহেলা ব্যাপারটাও অবাক করে। যত অবহেলা, তত আকর্ষণ। মাঝেমধ্যেই মনে হয়, সবকিছু ছেড়েছুড়ে কোথাও হারিয়ে যাই। তারপর মনে হয়, একা থাকবে ও, কষ্ট হবে বেচারার। আমার মাঝে এতো আবেগ,আর ওর মাঝে কিছুই নেই।
.
আমি আর রাগ থামাতে পারলাম না। হুট করে একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়লাম। সজীব একমনে আকাশ দেখে যাচ্ছে। আমি রিক্সা নিয়ে চলে গেলাম৷ বাসার কাছাকাছি এসে মনে হলো, ওকে এভাবে ফেলে আসা উচিত হয়নি। আবার রিক্সা ঘুরিয়ে চায়ের দোকানে ফিরে গেলাম। সজীব এখনো বসেই আছে।
আমি রিক্সা থেকে নেমে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
– কি হলো? বসেই থাকবে? বাসায় যাবেনা?
– সজীব খানিকটা হাসলো। তারপর চুপচাপ রিক্সায় উঠে গেলো।
আমি অভিমানের সুরে বললাম,
– আর যদি না আসতাম?
সজীব তার স্বভাবমতো চুপ করে থাকলো। আমি তার কাঁধে মাথা রাখলাম।প্রকৃতির নিয়মগুলোও বড় অদ্ভুত। যাকে ভালোবাসা যায় একসময় হয়তো তার নিস্তব্ধতাও প্রিয় হয়ে উঠে!
১৮টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সোনেলায় স্বাগতম। একদম ঠিক। যাকে ভালোবাসা যায় তার সব দোষত্রুটি, নির্লিপ্ততা, নিস্তব্ধতা ও প্রিয় হয়। তার উপর যত ই অভিমান হোক ধরে রাখা যায় না ভালোবাসার জালে। দারুন মান-অভিমানের গল্প পড়লাম। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন। শুভ কামনা রইলো
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
অনেক ধন্যবাদ ম্যাম। এতো চমত্কার একটি মন্তব্য করার জন্য। সোনেলায় আসতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছি। আপনিও অনেক ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
জিসান শা ইকরাম
সোনেলার উঠোনে স্বাগতম আপনাকে।
চমৎকার একটি গল্প নিয়ে আসলেন প্রথম আবির্ভাবেই।
সজীব ভালোই খেয়ালী একজন মানুষ বুঝা যাচ্ছে। নইলে স্ত্রীকে নিয়ে কেউ চা এর দোকানে বসে ঠান্ডা বাতাস খায়! সব কিছুতেই তার নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা দেখে স্ত্রীর রাগ হতেই পারে। সিনেমার নায়কের মত প্রতিক্রিয়া দেখাবে – তুলনাটি খুব সুন্দর হয়েছে।
সজীবের প্রতি রাগ হলেও সজীবের এই উদাসীনতায় অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছে তার স্ত্রী। এই অভ্যাসকেই ভালোবেসে ফেলেছে সে।
নিয়মিত লিখবেন।
শুভ কামনা।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
মায়া ভালোবাসাও এক প্রকার অভ্যাসই হয়তো।
আমার লেখাটি আপনারা এতো সুন্দরভাবে গ্রহণ করছেন দেখে আমি সত্যিই খুব আনন্দিত। অনেক ধন্যবাদ।এভাবে ভবিষ্যতেও উৎসাহ দিয়ে যাবেন আশা করি।
শুভকামনা রইলো আপনার জন্যও।
তৌহিদ
সোনেলায় স্বাগতম জানাচ্ছি আপনাকে। প্রথমেই চমৎকার একটি লেখা নিয়ে এলেন দেখে ভালো লাগলো। আসলে জীবনের অনেক কিছুর ব্যখ্যা পাওয়া যায়না। খুঁজতে গেলে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। এই যে সজীবের উদাসীনতা, প্রেমিকার আকুলতা এসবই আসলে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। একেকজনের প্রকাশভঙ্গী একেকরকম। দুজনার একজনকে একটু বেশি কেয়ারিং হতেই হয়।
নিয়মিত লিখুন, আপনার লেখা পড়ে ভালো লাগবে সকলের।
শুভকামনা রইলো।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
সেটাই। কোথাও কম, কোথাও বেশি। এভাবেই সমতা হয় সবকিছুর।
গল্পটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আরো লিখার চেষ্টা থাকবে।
শুভকামনা নিরন্তর।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
প্রাণবন্ত লেখা রাগ অভিমানের সঙ্গে গল্প ভালোই লেগেছে। ধন্যবাদ।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
ভালো লেগেছে জানতে পেরে ভালোই লাগলো। সাথেই থাকুন। ধন্যবাদ।
ছাইরাছ হেলাল
খুব সুন্দর করে-ই মান-অভিমান খানিকটা কথোপকথনের ছলে তুলে ধরেছে, এই গল্পে।
এখানে লেখার জন্য, অভিনন্দন।
আপনার নামের ফাইরুজ দেখে চমকে উঠেছিলাম, এই নাম অনেক স্মৃতি বহন করে আছে,
তাছাড়া লেবানিজ এই গায়িকার গানের খুব ভক্ত ছিলাম এক সময়ে।
লিখুন নিয়মিত, আমরা আপনার সাথেই থাকবো।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
আপনাদের উৎসাহ আমাকে আরো লিখতে সাহায্য করবে। পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ফয়জুল মহী
দারুন ,মনোরম লিখেছেন
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
অনেক ধন্যবাদ।
সাবিনা ইয়াসমিন
সবাই নিজেকে প্রত্যাশিত ভাবে প্রকাশ করতে পারেনা, বিশেষ করে ভালোবাসা প্রকাশের সক্ষমতা সবার মাঝে একরকম হয় না। তবুও তারা ভালোবাসা পেয়ে যায়। যারা তাদের ভালোবাসার মানুষ, তারা অভ্যস্ত হয়ে যায় এমন প্রকাশহীন নির্লিপ্ত সম্পর্কের সাথে।
স্বাগতম সোনেলা ব্লগ পরিবারে। প্রথমেই খুব সুন্দর গল্প নিয়ে এসেছেন। আপনার উপস্থাপনাও চমৎকার।
নিয়মিত লিখুন।
শুভ কামনা 🌹🌹
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
প্রথমেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি গল্পটি পড়ে একে এতো সুন্দর করে অনুধাবনের জন্য। আমারো খুব ভালো লাগছে আপনাদের অনুপ্রেরণা। ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নিরন্তর।
হালিম নজরুল
স্বাগতম। সাথে থাকুন। সাথে রাখুন।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
আচ্ছা। আপনিও৷ শুভকামনা রইলো।
আরজু মুক্তা
ভালোবাসলে সবকিছুকে ভালো লাগতে হয়।
সোনেলায় স্বাগতম।
শুভকামনা
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
জি। ভালোবাসার ধর্মই যে তাই। আপনা থেকে ভালোবাসা জন্মে যায়। অনেক ধন্যবাদ।