অজানা পথে

আরজু মুক্তা ২৭ জুন ২০২০, শনিবার, ০৮:৪৮:৪৩অপরাহ্ন গল্প ৩৪ মন্তব্য

আমার দাদা ছিলেন জমিদার। মানুষের জমিজমা জবরদখল করে নিজের করে নিয়েছেন। আব্বা, একাই ছেলে। যখন যা চান তাই হাজির। আবার পড়াশোনায় ভালো। ১৯৫০ সালে তৎকালীন সরকার ছবি আঁকার এক প্রতিয়োগিতার আয়োজন করেছিলেন। আব্বা,  অংশগ্রহণ করে প্রথম হয়েছিলেন। বিষয়বস্তু ছিলো : আজ হতে ৩০ বছর পর মেয়েরা বাজারে যাবে, ছেলেরা ঘরে রান্না করবে। এইচ.  এস. সি দেয়ার পর সুগার মিলে তাঁর চাকরী হয়। আমার দাদা এসে নিয়ে যান। বলেন, কৃষকের কাজ করতে হবে না; আমার জমি এমনি পরে থাকে। খাবার লোক নাই।

প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ির আঙ্গিনায় বিচার বসতো। বিচার সাথে সাথেই। মারধর না হলে জমি।

এসব দেখে, আব্বা পালিয়ে আসেন বাড়ি থেকে। তারপর সরকারি চাকরি নিয়ে রংপুরে জয়েন করেন।

আব্বা বলতেন, এমনও রাতে দেখেছি : বেশি ঝামেলা করলেই বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হতো। সে কি আহাজারি!  আর আমাদের বলতেন,  ” কখনো ঐ জমি নিতে যাবে না।  ওখানে মানুষের রক্তের দাগ।”

তখন, শুনতাম খুনাখুনির গল্প। আর এখন তা হরহামেশায় শোনা যায়। রাস্তা ঘাটে, মানুষ খুন হয়ে পরে আছে। কেন ভ্রুক্ষেপও নেই। বাহিরে বের হলেই কতো গল্প শোনা যায়। খুব জমিয়ে গল্প করে, জানো ; কাল রাতে আমাদের বাসার পাশে মার্ডার হয়েছে। ঐ যে দেখো রক্তের ফোটা! দোকানে, হাটে, বাজারে একই গল্প। চা খাইতে খাইতে কেউ বলে, ” ও আচ্ছা!” মানে, মৃত্যু গা সওয়া হয়ে গেছে।

বিজ্ঞান বলে, মৃত্যুই হলেই সাথে সাথে মানুষের মস্তিষ্ক অচল হয় না। ১০ মিনিট সচল থাকে। তখন তার মাথার নিউরনে সুন্দর সুন্দর স্মৃতি ভেসে ওঠে।

কাল রাস্তায় মৃত মানুষ দেখে আমারও মনে হলো, তার স্মৃতিতে হয়তো খেলা করছে স্কুলবেলার স্মৃতি। পড়া পারেনি বলে, মাস্টার মশাই তাকে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো। তার রোল ১। মান সম্মানের প্রশ্ন!  অথচ মাস্টার মশাই একবারও জিজ্ঞেস করলোনা কারণ কি? নানা বাড়িতে গিয়েই তো এই ঘটনা! চোখের জল, নাকের পানি সব একাকার করে পড়া মুখস্থ দিয়ে, তারপর বসেছিলো।

ঐ ছেলেটাই যখন হোস্টেলে থাকতো। একদিন খুব জ্বর তার। কোনরকমেই কমছে না। রুমমেটরা মাথায় পানি দিলো। জ্বরের ঘোরে, মা মা বলে ডেকেছিলো। পরদিন সকালেই মা হাজির। জ্বরের মাঝেই মায়ের গায়ের সুগন্ধ পাচ্ছে। মাকে দেখে জ্বরও জানালা দিয়ে পালালো।

আচ্ছা,  স্মৃতি কি বর্তমান না ভবিষ্যৎ? না কি মনের ভেতর লুকানো আবছা ছবি?

ছেলেটি খুব ভালো গান গাইতো। স্কুলের প্রতিটা অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়েও তা ধরে রেখেছিলো। বিকেলে, টি এস সির আড্ডায় তার সুরেলা কণ্ঠ থামিয়ে দিয়েছিলো নীলপদ্ম নামের একটি মেয়েকে। আর আশেপাশে যারা থাকতো, তারাও সমস্বরে গাইতো। গান শেষ হলে, বাদাম,  ঝালমুড়ি, চা চলতো।

বাড়ির কেউ নাম নিলে নাকি হেঁচকি ওঠে। ঐ ছেলেটিরও সেদিন তাই হয়েছিলো। পানি, পানি লাগবে। তার চিৎকারে শুনে, নীলপদ্ম পানির বোতল এগিয়ে দিয়েছিলো।

পরের দিনগুলো রঙিনই কেটেছিলো।

হঠাৎ সকালের পেপার পড়তে গিয়ে নীলপদ্মের চোখ আটকে যায় হেডলাইনে। যেখানে ছেলেটির নাম লিখা। এতো ভালো ছেলেরও শত্রু হয়!  নীলপদ্ম স্তব্ধ হয়েছিলো। কথা না, শুধু কান্না ঝরছিলো নীরবে। আজ তাদের ১০০ গোলাপ হাতে দেখা হওয়ার কথা।

ছেলেটিকে সমাধিস্থ করা হলো বনানী কবরস্থানে।

হয়তো, এতক্ষণে ছেলেটি মৃত্যুর পর আবার যাদের বন্ধুরূপে খুঁজে পেলো; তারা ও তার বন্ধু ছিলো। গত সোমবার সিলেট যাওয়ার পথে ট্রেনের যে বগি দুটা উল্টে গিয়ে কিছু মায়ের বুক খালি করেছিলো।  আর কিছু বুদ্ধিজীবি, যাঁরা করোনায় মারা গেছেন।

 

১৪৯২জন ১০৭০জন
0 Shares

৩৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ