“তাকদুম তাকদুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল
সব ভুলে যায় তাও ভোলেনা বাংলামায়ের বোল।।”
বাজনার তালে তালে দারুণ উচ্ছ্বাসে গান গেয়ে চলেছেন শিল্পী। উল্লসিত দর্শক প্রাণ ভরে উপভোগ করছে সুন্দর সুন্দর গান। অপূর্ব সঙ্গীতের মুর্ছনায় সবাই যেন বুদ হয়ে গেছে। আবালবৃদ্ধবনিতা শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মত গানই শুনছে না, অনেকেই গানের তালে তালে নেচেও উঠছে।
আর সবার মত লাবুরও খুব ভাল লাগছে আজ। এত সুন্দর গান শোনা হয়নি অনেকদিন। শুনবেই বা কোথা থেকে। গাঁয়ের এমন মেলায়ই তো আসার সুযোগ হয়নি প্রায় পাঁচ বছর। শেষ যে বার উদয়পুরের মেলায় এসেছিল লাবু, সেবার সে কি গণ্ডগোল! ছোট কাকুর সাথে মেলায় এসে কোনমতে দৌড়ে পালিয়ে বেঁচেছিল লাবু আর ছোটকাকু। অবশ্য ভীড়ের মধ্যে ছোটকাকুর ঘাড়েও দুই একটা লাঠির বাড়ি পড়েছিল। আজ তেমনটা না হলেও লাবুর মাঝে মধ্যে সেই দিনের কথা মনে হয়ে একটু ভয় ভয় লাগছে।
লাবু তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। খুব বায়না ধরে ছোট কাকুর সাথে মেলায় এসেছিল সে। মেলায় এসে তার সে কি আনন্দ। প্রথম প্রথম মেলায় এসে কত কিছু খেয়েছিল সে। খুরমা, কদমা, বাতাসা, হাওয়াই মিঠাই, তরমুজ ইত্যাদি। কিনেছিল নানান রকম খেলনা, একটা বড় পুতুল, বাঁশের বাঁশি, একটা চরকা আর একটা মাটির ব্যাংক। খাওয়া দাওয়া ও কেনাকাটা শেষে গিয়েছিল গান শুনতে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল হট্টগোল। একজন শিল্পী মঞ্চে উঠে একটা হিন্দি গান শোনালেন। এরপর তিনি ঘোষণা দিলেন এবার তিনি একটি ইংরেজি গান শোনাবেন। কিন্তু বাঁধ সাধলেন লতিফ স্যার। তিনি বললেন “এসব কি হচ্ছে ! আমরা কি এইজন্য ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম? এটা একুশের মেলা। অথচ এখানে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে বিদেশী ভাষা-সংস্কৃতিকে লালন করা হচ্ছে। বহু মানুষের রক্তের বদৌলতে আমরা আমাদের ভাষা পেয়েছি। সুতরাং তার সম্মান আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। বাংলা ভাষায় তো গানের অভাব নেই জারি, সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী, নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সংগীত, লালনগীতি, হাসন রাজার গান, আরও কত সুন্দর সুন্দর গান আছে আমাদের। “লতিফ স্যারের কথা শুনে অনেকেই তার কথায় সায় দিলেন। কিন্তু কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল ছেলে লতিফ স্যারকে অপমান-অপদস্ত করলেন। এতে অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। একপর্যায়ে বেঁধে গেল তুমুল গণ্ডগোল। সেই থেকে আজ অবধি এখানে আর মেলা হয়নি। এবার সবাই মিলে আবার মেলার আয়োজন করেছে। সেবার যারা গণ্ডগোল করেছিল তারাই এবার লতিফ স্যারের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিল। তাদের উদ্যোগেই মেলা হচ্ছে। এবার তারাই বলেছে বাঙালি সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে বাঁচাতে হলে মেলার ভুমিকাও অপরিসীম।
অনেকক্ষণ গান শোনার পর লাবু ও তার বন্ধুরা লটারীর ফলাফল ঘোষণার মঞ্চের কাছে গেল। একে একে বিভিন্ন পুরস্কারের ফল ঘোষণা হচ্ছে। আর মাত্র দুটি পুরস্কার বাকী। লাবুরা বাড়ি ফেরার জন্য তৈরী হচ্ছে। এমন সময় ঘোষণা শুনে তো সবাই অবাক। পঞ্চাশ হাজার টাকার দ্বিতীয় পুরস্কারটি পেয়ে গেছে লাবু। সবার মুখে উচ্ছ্বাসের হাসি। আনন্দে বুক ভরে গেছে সবার।
গ্রামের সবাই লাবুকে কোলে তুলে নাচতে নাচতে গ্রামের পথে ফিরে যাচ্ছে। গাঁয়ে ঢুকতেই চেয়ারম্যানের সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন “এই টাকা দিয়ে তুমি কি করবে লাবু? এবার না হয় তোমাদের টিনের ঘরটি ছাদ করে ফেলো।” এ কথা শুনে লাবু দ্বিমত পোষণ করল। সে বললো “না চেয়ারম্যান কাকা, আমি এই টাকাটা গ্রামের উন্নয়নে খরচ করতে চাই। আপনি চাইলে কালই গ্রামে একটা সভা ডাকতে পারেন। আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে জানাবো আমরা গ্রামের কি কি উন্নয়ন মূলক কাজ করতে চাই।”
পরদিন স্কুল মাঠে যথাসময়ে সভা শুরু হল। গ্রামের গন্যমান্য সকলেই হাজির। শুধু পূর্ব পাড়ার কেউ উপস্থিত নেই। থাকবেই বা কি করে। গতবছর গণ্ডগোলের পর থেকে দুই পাড়ার মধ্যবর্তী খালের উপরের সাঁকোটি নেই। গ্রামের সবাইকে একসাথে না পাওয়ায় খুব মন খারাপ হল লাবুর। চেয়ারম্যান কাকা সভা শুরুর ঘোষনা দিলেন। গ্রামের মণ্ডল-মাতব্বর সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে লাবুদের কর্মসূচি শোনার জন্য। চেয়ারম্যান কাকু এবার লাবুকে ডেকে বললেন “বল লাবু তোমরা কি কি করতে চাও?” গ্রামের অন্য লোকেরাও সমস্বরে কর্মসূচি জানার আগ্রহ প্রকাশ করল। সবার প্রতি সম্মান জানিয়ে উঠে দাঁড়াল লাবু। সালাম জানিয়ে বলল-“আমরা আমাদের এই সুন্দর গ্রামটাকে সোনার গ্রামে পরিণত করতে চাই। কিন্তু এজন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন সততা ও একতা। সবাই একবার ভেবে দেখুন গতবছর গণ্ডগোল হবার আগে খেলাধুলা, শিল্প-সংস্কৃতি কোনকিছুতেই কোন গ্রাম আমাদের গ্রামের সাথে জিততে পারেনি। অথচ গতবছর পুজা উতসবকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া গণ্ডগোলের পর দুই পাড়ার মানুষের মধ্যে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ। তাই গত এক বছরে কোন কিছুতে জয়ী হওয়া তো দূরের কথা, কোথাও আমরা অংশগ্রহণই করতে পারিনি। অন্য গ্রামের মানুষেরা আমাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তাই আমাদের অনুরোধ আজ থেকে ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সবাই আমরা একসাথে বসবাস করব, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গ্রামের উন্নয়ন করবো। লটারীতে পাওয়া টাকা দিয়ে দুই পাড়ার মধ্যবর্তী ভেঙে ফেলা সাঁকো পুন:স্থাপন করব ও গ্রামের রাস্তার দুই পাশে গাছ লাগাবো। এই গাছ আমাদের অক্সিজেন দিয়ে জীবন বাঁচাবে। আমরা ফুল ও ফল পাবো, কাঠ পাবো, গ্রামের সৌন্দর্য বাড়বে। সবাই মিলে আমরা আমাদের গ্রামকে সুন্দর, সৌহার্দপূর্ণ গ্রামে পরিনত করবো।” গ্রামের সবাই লাবুর কথা শুনে খুব খুশী হল। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন সব পাড়ার লোকদের ডাকো। আজ থেকে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই আমরা ভাই ভাই। এই গ্রাম আমাদের সবার। লাবু যেভাবে গ্রামকে ভালবাসে তা অসাধারণ দেশপ্রেমেরই নামান্তর। আমাদের সবার চোখ খুলে দিয়েছে লাবু। এই গ্রামকে সুন্দর করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। যেহেতু এবারের ঈদ ও পুঁজা একই সপ্তাহে হবে, তাই ঐ সপ্তাহে আমাদের এই বড় মাঠেই এবার মেলার উৎসব হবে।”
গ্রামের সকলেই চেয়ারম্যানের ঘোষণাকে মহানন্দে স্বাগত জানালো। সভা শেষে কোলাকুলি ও মিষ্টি বিতরণ শুরু হল। আনন্দ আর উল্লাসে মেতে উঠলো লাবুদের প্রিয় গ্রাম।
———————–0 0———————–
২৫টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
আমরা স্বপ্ন দেখে দেখে একদিন সত্য স্বপ্নে পৌঁছে যাব।
স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলব।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ ভাই।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
মেলা, একুশ, গ্রামবাংংলার ঐতিহ্য, আনন্দ, উৎসব, মেলা এবং আবহমান বাংলার প্রাণচাঞ্চল্য খুব সুন্দরভাবে লেখায় উঠে এসেছে। ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ মূল্যবান মন্তব্যের জন্য।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
মেলাকে ঘিরে এতো সুন্দর দেশপ্রেম ফুটিয়ে তুলেছেন ধন্যবাদ আপনাকে। হিংসা বিদ্বেষ কখনো ভালো কিছু আনতে পারে না। একতাই সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
হালিম নজরুল
আমরা অসাম্প্রদায়িক জাতি।
জিসান শা ইকরাম
এমন লাবু আজকাল বিরল।
দেশকে নিয়ে আমাদের সবারই এমন চিন্তা থাকা উচিৎ।
স্বপ্ন দেখি, একদিন সবাই আমরা লাবুর মত হবো।
হালিম নজরুল
আমরা সবাই আশাবাদী মানুষ, সুন্দরের প্রতীক্ষায় থাকি। ধন্যবাদ ভাইজান।
সুরাইয়া নার্গিস
চমৎকার লাগছে ভাইয়া,
পড়ে মুগ্ধ হলাম।
হালিম নজরুল
শুভকামনা রইল আপা।
কামাল উদ্দিন
এমন দেশ প্রেম আমাদের সবার মনে থাকলে আমাদের গ্রামগুলো স্বর্গ হতো। আচ্ছা পঞ্চাশ হাজার টাকায় এতো কিছু হবে তো?
হালিম নজরুল
খালের উপর সাঁকো নির্মাণ করতে শুধু কিছু বাঁশ- কাঠ আর নিজেদের শ্রম লাগবে, বৃক্ষ রোপনের জন্য কিছু চারা লাগবে, বাকী কাজগুলোর জন্য লাগবে সবার আন্তরিকতা। ইনশাআল্লাহ ঐ অল্প টাকাকে কাজে লাগিয়েই অনেক বড় কাজ করতে পারব, যদি আমাদের বুকে সত্যিকারের দেশপ্রেম থাকে। আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ কামাল ভাই।
তৌহিদ
এমন দেশপ্রেম বিরল। লাবুর মত যতি দশভাগ মানুষ এরকম চিন্তা চেতনা ধারণ করতো দেশ এগিয়ে যেত আরো সামনে।
চমৎকার গল্প পড়লাম ভাই।
হালিম নজরুল
আপনার প্রেরণাদায়ক মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাই।
ফয়জুল মহী
অসাধারণ উপস্থাপন । চমৎকার ভাবনার প্রকাশ।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ ও শুভকামনা ভাই।
এস.জেড বাবু
অন্য গ্রামের মানুষেরা আমাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তাই আমাদের অনুরোধ আজ থেকে ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সবাই আমরা একসাথে বসবাস করব, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গ্রামের উন্নয়ন করবো। লটারীতে পাওয়া টাকা দিয়ে দুই পাড়ার মধ্যবর্তী ভেঙে ফেলা সাঁকো পুন:স্থাপন করব ও গ্রামের রাস্তার দুই পাশে গাছ লাগাবো। এই গাছ আমাদের অক্সিজেন দিয়ে জীবন বাঁচাবে। আমরা ফুল ও ফল পাবো, কাঠ পাবো, গ্রামের সৌন্দর্য বাড়বে। সবাই মিলে আমরা আমাদের গ্রামকে সুন্দর, সৌহার্দপূর্ণ গ্রামে পরিনত করবো।”
যদি এমন হতো !
বদলে যেত দুনিয়ার মেকাপ করা চেহারা।
চমৎকার উপভোগ্য ছিলো
হালিম নজরুল
অন্তহীন ভালবাসা ও শুভকামনা ভাই।
প্রদীপ চক্রবর্তী
হিংসা,কুসংস্কার কখনো দেশকে উন্নত করতে পারেনা।
দেশকে উন্নত করতে হলে দেশ প্রেমের প্রয়োজন যা এ গল্পে ফুটে উঠেছে।
হালিম নজরুল
চেষ্টা করেছি একটি অসাম্প্রদায়িক সুন্দর দেশ গড়ে তুলবার মন্ত্র তুলে ধরতে। ধন্যবাদ দাদা।
আরজু মুক্তা
দেশপ্রেমিকের বড় অভাব। সবকিছু বদলে যাক
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ আপা।
সাবিনা ইয়াসমিন
**সেবার যারা গণ্ডগোল করেছিল তারাই এবার লতিফ স্যারের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিল। তাদের উদ্যোগেই মেলা হচ্ছে। এবার তারাই বলেছে বাঙালি সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে বাঁচাতে হলে মেলার ভুমিকাও অপরিসীম**
সঠিক শিক্ষা আর ভুল ধরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে নব প্রজন্মের হাত ধরেই এগিয়ে আসে ভবিষ্যতের আলোকিত দিন। লতিফ স্যারের মতো মানুষেরা পথের হাল ধরে থাকলে লাবুর মতো দেশপ্রেমিক গড়ে উঠবে।
গল্পের মাঝে সুন্দর বার্তা দিলেন নজরুল ভাই।
শুভ কামনা 🌹🌹
হালিম নজরুল
এত মনোযোগ দিয়ে গল্প পড়ে সুন্দর মন্তব্য করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু।
নিতাই বাবু
মেলা! মেলা! মেলা! ছোটবেলাতে চলে গেলা, আপনার লেখা পড়ে। আবার আপনার এই লেখা পড়ে দেশের জন্যও কিছু করতে ইচ্ছাপ্রকাশ করবে। বিশেষ করে রক্তে কেনা ভাষা নিয়ে অনেককিছু ভাবতে পারবে একালের যুবসমাজ।
শুভকামনা থাকলো।