
মরতে আমার খুব ভয় লাগে।
কয়েক মুহূর্তের জন্য জমাট নিস্তব্ধতা নেমে আসে যেন মৃত্যুভয় গ্রাস করে ফেলে সবাইকে। কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশ রাত জানালার ওপাশে বিশাল বকুল গাছের ঘন ডালপালার ফাঁক ফোকর গলে মরা চাঁদের আলো বয়ে এনেছে বকুলের ঘ্রান। সবার গায়ে কাটা দিয়ে উঠে, হঠাৎ মনে হলো যমদূত বকুলের গন্ধ সাথে নিয়ে এইমাত্র প্রবেশ করলো ঘরে। নিস্তব্ধ কক্ষের সবাই পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করছে কেও কোন কথা খুঁজে পাচ্ছেনা।
রামদেব ঘোষালের বুকের ভিতরের চাপা কাশির ঘড়ঘড় শব্দটা আবার বেজে উঠতেই সবাই বুঝলো না সে এখনো মরেনি। কাশির ধমক হঠাৎ একটা দমবন্ধ নিস্তব্ধতা নিয়ে এসেছিলো। গভীর জলের অনেক নিচে গিয়ে দম বন্ধ ফুরিয়ে গেলে বাতাসের জন্য যেভাবে মরিয়া হয়ে ভেসে ওঠে মানুষ সেভাবে বাতাস টেনে টেনে বাঁচার চেষ্টা করছেন তিনি। আর তখনি বুকের ভেতরে দীর্ঘদিনের কফ স্লেশার ভিতর বাতাস ঢুকে ঘড় ঘড় শব্দ করছে।
কাশিটা যতটা সম্ভব চেপে রাখার চেষ্টা করেন তিনি যাতে তার কফ গুলো বুকের ভেতর থেকে না বের হয়। কফ বের হলে সাথে করে নিয়ে আসে দলা দলা রক্ত। রাজক্ষয় রোগ তিনমাস আগেই বৈদ্যরা জবাব দিয়ে দিয়েছে। এটাই শেষ যাত্রা সম্ভবত আজই শেষ রাত।
সন্ধ্যার পর থেকে রামদেব ঘোষাল যেন নতুন করে চেতনা ফিরে পেয়েছেন। বড়ো বড়ো চোখ করে এদিক ওদিক তাকিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় চোখ গুলো অক্ষিকোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে। পালঙ্কের চারপাশে ঘিরে থাকা পরিজনের দিকে আকুতি নিয়ে তাকান। ক্ষয়রোগে কঙ্কালসার মুখ-মন্ডলের সমস্ত হাড়গুলো বের হয়ে গেছে এই চেহারার ভিতর দিয়ে এমন বড় বড় চোখের চাহুনির দিকে তাকিয়ে থাকা যায়না।
বাতি নেভার আগে ধপ করে জ্বলে ওঠার মতো করে তিনি আবার বলে উঠলেন ” মরতে আমার খুব ভয় লাগে রে তোমরা কেউ আমার কাছ থেকে সরবেনা। আমি যমের গায়ের গন্ধ পাচ্ছি। ”
এবার সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে মহলের সাথে লাগোয়া শতবর্ষী বকুল ফুলের গাছ ছুঁয়ে একটু আগে যে ধমকা হাওয়া ঘরের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে সেটাই যমের গন্ধ।
“এই তোমরা এতো দূরে কেন আমাকে ঘিরে থাকো আমার কাছে কাছে থাকো আমাকে ধরে রাখো।”
রামদেব ঘোষালের এই করুন আর্তি উপস্থিত সবার ভয়কে আরো বাড়িয়ে দেয়। তাকে ঘিরে থাকা স্বজনেরা বুঝতে পারে যমদূত তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। এমন সময় তার নজর থেকে দূরে থাকাই ভালো।
কারো নড়াচড়া না দেখে রামদেব ঘোষাল মৃত্যু ভয়ে কেঁদে ওঠেন। মায়ের পেটের একমাত্র ছোট ভাই বাসুদেব ঘোষালের দিকে হাড্ডি চর্মসার হাতখানা বাড়িয়ে দেন। ” ও বাসু ও বাসু বাসুরে। ”
স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শক্ত মনের মানুষ বাসুদেব ঘোষাল তার বড় দাদার এ ডাককে অবজ্ঞা করতে পারেনা। দুই কদম এগিয়ে শুন্যে বাড়িয়ে দেওয়া শীতল হাতটা ধরে পালঙ্কের পাশে গিয়ে বসে। বসেই তাকায় ঘরের বিপরীত পাশে নামাবলী গায়ে দিয়া অনিল ভট্টের দিকে।
গত তেরোদিন ধরে নিজেদের মন্দিরের পুরোহিত অনিল ভট্ট নিয়মিত এই ঘরের কোণে বসে ইষ্টনাম জপে
মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ যাত্রা সহজ আর আনন্দময় করে তুলতে শ্রী ভগবতগীতায় যে নির্দেশনা আছে সেই অনুযায়ী পূজা অর্চনা করে যাচ্ছে। পূজা অর্চনা ইষ্টনাম জপের চাইতেও প্রধান কাজ।
রামদেব ঘোষালের নড়াচড়া বন্ধ হলেই সে তার তক্তপোষ ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে এসে নাকের কাছে হাত রেখে পরীক্ষা করে প্রাণ আছে নাকি। মনে মনে একরাশ বিরক্তি আর মুখে একরাশ বিষাদ নিয়ে পুরোহিত অনিল ভট্ট তার আরামের তক্তপোষ ছেড়ে এসে দাঁড়ালো বাসুদেব ঘোষালের পাশে। এসেই জোরে জোরে ইষ্টনাম জপতে শুরু করে দেয়।
রামদেব ঘোষাল একটা কাশির দমক সামলে কি যেন বলার চেষ্টা করছেন সেটা দেখে বাসুদেব হাতের ইশারায় ভট্ট কে থামতে বললো। রামদেবের চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কান্না।
সেই কান্না দেখে ছোট ভাই বাসু দেবের ভাবান্তর হয়। খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস টেনে রামদেব বলেন ” ও বাসু ভাই আমার আমি মরতে চাইনা না রে আমি আরো কটা দিন বাঁচতে চাই। মরতে আমার খুব ভয় লাগে রে। তোরা আমার কাছাকাছি থাকে আমাকে ঘিরে রাখ যম যেন আমার কাছে আসতে না পারে।”
কথাগুলো বলেই রামদেব ঘোষাল প্রচন্ডভাবে হাপাতে থাকেন। হাঁপাতে হাঁপাতে উগরে দিলেন একদলা
রক্তমিশ্রিত কফ। গালবেয়ে গড়িয়ে নামার আগেই শিওরে ঘোমটা টেনে বসে থাকা রামদেব ঘোষালের তরুণী স্ত্রী পূর্বদেবী একটা নাকড়ায় মুছে নেয় রক্ত মাখা কফ টুকু। এর পর আতরদানির সুগন্ধে ভেজা তুলো দিয়ে মুখমন্ডল আর গলা মুছে দেয়। দীর্ঘদিন বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ঘা দেখা দিয়েছে, সেসব থেকে একধরণের পচা গন্ধ বের হয়। সেই পচা গন্ধ ঢাকতে এখন ঘন ঘন আতর দিয়ে শরীরের অনাবৃত অংশ গুলো মুছে দেওযা হয়। ঘরের মধ্যে পোড়ানো হয় চন্দন কাঠি আর ধুপ।
সতেরো জন চাকরানী পালা করে নিয়োজিত আছে রামদেব ঘোষালের দেখভালের জন্য। বিছানায় প্রাতঃক্রিয়া সারা থেকে শুরু করে খাওয়ানো পোশাক বদলানো সবটাই তারাই করে। পূর্বদেবী দুইবেলা করে মন্দিরে স্বামীর কল্যানে পুজো দিয়ে তার শিওরে এসে বসে থাকে। মূলত বসে থাকা ছাড়া তার আর কোন কাজ নেই যা কিছু করার সব কিছু দাসী চাকরানিরাই করে থাকে। স্বামী সেবার এই পুন্যটুকু চব্বিশ বছর বয়সী পূর্বদেবী খুব একগ্রতা নিয়ে করে থাকে।
১০টি মন্তব্য
হালিম নজরুল
ছোটগল্পটি ভাল লাগল। অসাধারণ বর্ণনাশৈলী।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
মৃত্যু ভয় নিয়ে দারুণ লিখলেন। অসাধারণ হয়েছে। কিন্তু দিদি যতিচিহ্ন দেন নাই কেন? ভালো থাকুন সবসময় শুভ কামনা রইলো শুভ সকাল
ইঞ্জা
মৃত্যু ভয়, কে না সয়?
সবারই মৃত্যু ভয় , কবি গুরু লিখেছিলেনঃ
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
আহা কে না মরতে চাই, চমৎকার লিখেছেন আপু।
আপু একটা নিয়ম বলে দিই ব্লগের, খেয়াল রাখবেন প্রতি ২৪ ঘন্টা পর পর পোস্ট দিতে পারবেন, এর আগে নয়।
শুভেচ্ছা, হ্যাপি ব্লগিং।
সুরাইয়া পারভীন
যতিচিহ্নের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটানা এমন লেখা পড়তে সত্যিই অসুবিধে হয়। মৃত্যু ভয়কে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। যতিচিহ্নের ব্যবহার দেখাটাকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলতে পারতো।
মুন
সবাইকে ধন্যবাদ বাংলা ফ্রন্ট এ চাইলেও অনেক যতিচিহ্ন কিছু দিতে পারিনা
কামাল উদ্দিন
মরতে আমাদের সবারই ভয়, তবে বিছায় পড়ে থেকে এমন কঠিন দিন গুলো সত্যিই খুব যন্ত্রণাময় হয়। খুব গুছিয়ে লিখেছেন আপু, যেন একেবারে কাছ থেকে আমরাও রামদেব ঘোষালের বুকের গড়গড় আওয়াজটা শুনতে পেলাম। শুভ কামনা সব সময়।
জিসান শা ইকরাম
গল্পে সত্যিকারের মৃত্যু পথ যাত্রীকে যেন দেখলাম আমি।
এভাবেই চলে যেতে হয় পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটিকে।
ভালো লেখেন আপনি।
শুভ কামনা।
তৌহিদ
এই বিষন্ন সময়ে লেখাটি পড়ে মনে মৃত্যুভয় ঢুকে গেল্প। মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি সামনে দেখেছি অনেক। মনে পড়ে যাচ্ছে তাদের কথা।
ভালো লিখেছেন।
ফয়জুল মহী
মন ছুঁয়ে গেল লেখা। ভালোবাসা ও শুভ কামনা আপনার জন্য।
মুন
ধন্যবাদ সবাইকে সব সময় আপনাদের উৎসাহ ও সমর্থন চাই