
দুই পাহাড়ের মাঝের দীর্ঘ হ্রদের/ খাদের/ জলা ধারকে বান্দরবানের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় খুম। আগে আমিয়াখুম, নাফাখুম, সাতভাই খুম আমার দেখা হয়েছে। বাদ ছিল নব আবিস্কৃত দেবতাখুম। এবার সুযোগ পেয়ে তা কাজে লাগাতে দেরী করলাম না। টিম টিম নামক একটা ভ্রমণ গ্রুপের সাথে বেড়িয়ে পড়লাম একদিনের ট্যুরে। আমিয়াখুম আর নাফাখুমের একপাশে যেমন জলপ্রপাত রয়েছে এখানে তেমনটি নাই। সাতভাই খুমের সাথে এই দেবতা খুমের ভালো সামঞ্জস্য রয়েছে।
বান্দরবানে যতগুলো খুম দেখেছি তার সবগুলোকেই আমার মনে হচ্ছে স্বর্গের পথ। এটাও তার ব্যতিক্রম নয়। চারদিকে সুনসান নীরবতা, দুই পাশে সুউচ্চ পাথুরে পাহাড়, পাহাড়ের উপরে সবুজ বনানী। নিচে নীল চলমান পানি। দুই পাশে সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝের ফাটলে সিপ্পি পাহাড় থেকে পানি নেমে এসে এইখানে জমে তৈরি হয়েছে দেবতা খুমের। প্রায় ৬০-১০০ ফুট গভীর এই খুমের দৈর্ঘ্য ৬০০ ফুট। সব থেকে কাছের গ্রামটার নাম শীলবান্ধা পাড়া। ছবির মতোই সুন্দর মারমাদের গ্রাম। এখানকার মানুষের কাছে এই দেবতা খুম একটি পবিত্র স্থান।
(২) বান্দরবানের রোয়াংছড়ি থেকে চান্দের গাড়ি নিয়া এমন স্বর্পিল পথে এগিয়ে যেতে হয় দেবতাখুমের পথে।
(৩) ওয়াগই গ্রামে এসে পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে সামনের দিকে আগাতে হয়। এখানে এসে পেয়ে গেলাম দেবতাখুমের আবিস্কারক পলাশ তঞ্চঙ্গ্যা কে। তাই একটা ছবি উঠিয়ে নিতে ভুল করলাম না।
(৪) পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা সুন্দর পাকা রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চললাম কচ্ছপতলীর দিকে। লিরাগাঁও আর্মিক্যাম্প থেকে ২য় বার গাইড সহ গিয়ে অনুমতি নিতে হবে দেবতা খুমের দিকে যাওয়ার জন্য জন্য। রাস্তার দুই পাশে প্রচুর সবুজ তামাক ক্ষেত।
(৫) কচ্ছপতলী বাজারে এসে চান্দের গাড়ির যাত্রা শেষ। বাজারের উল্টো পাশেই সেনা ক্যাম্প। ওখান থেকে অনুমতি নিয়েই শুরু হয় পায়ে হেটে পাহাড় কিংবা ঝিরি পথের দেবতাখুম যাত্রা।
(৬/৭) ঝিরি পথের এমন যাত্রাটা বেশ রোমাঞ্চকর। কখনো পিচ্ছিল উঁচু নিচু পথে ঝুকিপূর্ণ হাটা, কখনো ঝিরিতে পা, হাটু বা কোমড় অবদি পানি পাড়ি দেওয়া। তবে আার মতে পিচ্ছিল পথের চেয়ে পানিতে হাটাই ভালো, যদিও পানি গতি কমিয়ে দেয় আর পানির নিচের সব কিছু দেখা যায় না। এই ঝিরি পথ মূলত তারাসা খাল, এই তারাসা খালের উৎপত্তি হচ্ছে সিপ্পি আরসুয়াং পাহাড়, যা দেবতা খুম হয়ে এইদিকে এসে কচ্ছপতলী পার হয়ে সামনে দিকে চলে গেছে।
(৮) ক্লান্তি এসে যখন ভর করে তখন এমন লাল সবুজের পাহাড়ি ফুলগুলো পথিকের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।
(৯) পাহাড়িদের মাছ ধরা, ওরা ব্যাটারির সাহায্যে মাছকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে হাতের ছোট জালে তুলে আনে।
(১০/১১) ঘন্টা দেড়েক হাটার পর দেবতাখুমের সব থেকে কাছের মারমাদের গ্রামে পৌছি। গ্রামটার নাম শীলবান্ধা পাড়া, এখানকার মানুষগুলো সত্যিই অত্যন্ত চমৎকার হাসিখুশি এবং হেল্পফুল। আর গ্রামটাও প্রাকৃতিক পরিবেশে ছবির মতোই সুন্দর।
(১২) শীলবান্ধা পাড়ার পুর্ব দিকের খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে কিছু দূর এগোলেই পাওয়া যাবে লাইফ জ্যাকেট এবং পং সু আং খুমের নৌকা ভাড়া এবং বাঁশের ভেলায় চড়ার খরচ সহ যাবতীয় এখানে পরিশোধ করতে হয়। প্যাকেজে যাওয়ার কারণে কতো টাকা লাগে তা জানা হয়নি আমার।
লাইফ জ্যাকেট পড়ে নৌকায় চড়ার আগের এমন পাতা ঝরা রাস্তাটা বেশ চমৎকার।
(১৩/১৪) পাথুরে পথের পরেই “পং সু আং খুম” এটুকু আমাদেরকে নৌকায় পাড়ি দিতে হবে।
(১৫) নৌকা থেকে নেমে আবার কিছুটা পাথুরে পথে হেটে পৌছতে হবে আমাদের মূল গন্তব্য দেবতা খুমে।
(১৬/১৭) এবার বাঁশের ভেলা নিয়ে কায়াকিং করে দেবতা খুম পাড়ি দেওয়ার পালা।
(১৯/২০) খুমের ভেতর কোথাও বড় বড় পাথরে ভেলা আটকে পড়ে আবার কোথাও শতফুট গভীরতা। কিছুটা গা ছমছমে পরিবেশ ও বটে। তবে বেশ রোমাঞ্চকর।
(২১) দেবতা খুমের শেষ প্রান্তটা ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে এসেছে।
(২২) সরু পথ এক সময় বা দিকে বেঁকে গেছে, দুদিকের খাড়া দেয়াল বেশ কাছাকাছি বলে এখানটায় বেশ কিছুটা ভয়ও লাগে পার হতে।
(২৩) এটা দেবতা খুমের শেষ প্রান্ত। সামনে আর ভেলা নিয়ে এগোনো যাবে না। তবে পাথুরে পানি পথে সামনে আরো অনেক দূর চলে গেছে। সম্ভবত সিপ্পীর পায়ের কাছটা পর্যন্ত।
(২৪) দেবতা খুম থেকে ভেলায় চড়ে ফিরে আসার সময় তিনিও আমার সাথে এপাড়ে এসেছিলেন।
২৩টি মন্তব্য
সুপায়ন বড়ুয়া
এই দেবতা কুমটা খোদা
মনে হয় নিজ হাতে সাজিয়েছে।
ভালো লাগলো। শুভ কামনা।
কামাল উদ্দিন
হুমম, প্রকৃতির সাজ সব সময়ই অপরূপ দাদা।
ফয়জুল মহী
বেশ মন ছুঁয়ে গেল।
কামাল উদ্দিন
শুভেচ্ছা জানবেন ভাই
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বাপরে বাপ! কি অভিযান। সুন্দরকে উপভোগ করতে চাইলে এমন কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়। ভালো লাগলো। শুভ সকাল
কামাল উদ্দিন
সুন্দর কিছু দেখতে হলে কিছুটা কষ্ট করে যেতেই হয় আপু, শুভ কামনা জানবেন।
মনির হোসেন মমি
ছবি সহ খুব সুন্দর উপস্থাপনা।বরাবরের মতন অজানা তথ্য ও স্থান পরিদর্শন করলাম।ধন্যবাদ প্রিয়।
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ মমি ভাই, খুবই ব্যস্ততায় আছি বলে ব্লগে সময় দেওয়া ইদানিং খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
আরজু মুক্তা
অভিযান ভালো লাগলো
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ আপু, এমন অভিযান গুলো আমি হৃদয় দিয়ে উপভোগ করি।
আলমগীর সরকার লিটন
আসলেই ছবিগুলো গা ঝিমঝিম করছিল কামাল দা
কামাল উদ্দিন
এডভেঞ্চার ট্যুরগুলো এমনই হয় ভাই…..শুভ কামনা জানবেন।
ছাইরাছ হেলাল
দেখলেই তো ভয় লাগে, কেমনে যায় কে জানে!
কামাল উদ্দিন
কেমনে যায় তার পুরোপুরি হিসাবই তো দিলাম বড় ভাই, এই দেবতা খুম যাওয়াটা খুব কঠিন কোন কাজ নয়।
তৌহিদ
দেবতাখুমের ছবি দেখেই যাবার ইচ্ছে জাগছে। কবে যে কোথাও যেতে পারবো!!
শেষের ছবিটাতে ভয় পেয়েছি। সেটা কি প্রানী ভাই?
কামাল উদ্দিন
ব্রোঞ্জ কালারের এই প্রাণীটাকে আমরা স্থানীয় ভাষায় বলে থাকি আনজিলা। আমি ফিরতি ভেলায় চড়ার সময় কখন তিনি আমার উরুর উপর চেপে বসেছে দেখতে পাইনি। কিছুদুর এসে দেকার পর ভেবেছিলাম কাপড় ঝেড়ে পানিতে ওকে ফেলে দেই। পরে ভাবলাম দরকার কি? ওপারের ডাঙ্গায় ওকে পোছে দিলেই তো হয়।
তৌহিদ
আজই এ সম্পর্কে প্রথম জানলাম ভাই।
সুরাইয়া নার্গিস
লেখার সাথে সুন্দর ছবি অসাধারন বলার অপেক্ষা রাখে না, মুগ্ধ হলাম।
অনেক সুন্দর, ঘুরে দেখার ইচ্ছা জাগলো।
শুভ কামনা আপনার জন্য
কামাল উদ্দিন
ঘুরুঞ্চিমনাদের যেতে ইচ্ছে করবে এটাই স্বাভাবিক…..শুভ কামনা জানবেন আপু।
সাবিনা ইয়াসমিন
পুরো পোস্ট পড়ে/দেখে যা বুঝলাম, জায়গাটা বেশ দূর্গম। এই কারণেই হয়তো স্থানটা দেরিতে আবিস্কৃত হয়েছে। জায়গার সাথে এর আবিস্কারকের দেখাও পেয়েছেন, সৌভাগ্যই বটে! আমাদের দেশের মতো জনবহুল একটি রাষ্ট্রে এমন সুন্দর নিভৃত স্থান আছে দেখে সত্যিই বেশ ভালো লাগলো।
আমার পিঠের উপর এমন জিনিস বসে থাকলে আমার আর ফিরে আসা হতো না 🙁
শুভ কামনা 🌹🌹
কামাল উদ্দিন
বান্দরবানে এখনো হয়তো আরো অনেক অনাবিস্কৃত সুন্দর পড়ে আছে কোন একজন আবিস্কারকের আশায়। প্রাণীটা আমার পিঠে ছিল না আপু উরুর উপড়ে চড়ে দেবতা খুম পাড়ি দিয়াছে…….ভালো থাকুন সব সময়।
হালিম নজরুল
চোখধাঁধাঁনো সৌন্দর্য
কামাল উদ্দিন
হুমম, আমিও তাই বলি।