ছয় নম্বর চাচ্চুটাকে কখনো লেখালিখি করতে পারে বা লেখে, এরকম কোনোরকম ধারনাই ছিলোনা এ সময়ে। ‘কবিতা লেকতে পারো?’ এমন প্রশ্নে যেমন যারপরনাই অবাক, বিস্মিত হয়েছিলাম! ম্যাগাজিন বা সংকলন বের করার ভাবনা ভাবছে ভেবেও ততটাই বিস্মিত হয়েছিলাম। আমার জানার গন্ডি প্রঃচন্ড খাটো বিধায় এটাই স্বাভাবিক। চাচ্চু’র বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন(?)……নাহ্, তাইবা বলি কি করে? পাড়ার মধ্যে মাত্র একজনার সাথেই শুধু সবচে বেশি চলাফেরা করতে দেখছি। আর আরেকজন আছেন দেখেছি, তবে তিনি আমাদের পাড়ায় না, অন্য পাড়ায় থাকেন বলে খুব কম দেখি। তাও সেও খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু পানুকাকা সে। আরেকজন যার কথা উল্লেখ করলাম! তাঁর নাম এখানে বলছিনা ইচ্ছে করেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদের মধ্যে যে কেউ সৃজনশীল সাহিত্যের ধারায় পদচারনা করতে পারেন, এই সময়ে আমার জ্ঞানের ধারেকাছেও নেই, ছিলোনা।
সমস্ত সংকোচের নিকুচি করে একটা সত্যি কথা বলেই ফেলি?
ফেসবুকে যখন চাচ্চুকে এ্যাড করি! মাঝে মাঝে লাইক কমেন্ট করছেন আমার লেখায়! আমি কি ভাবছি? কাকু কি বোঝে আমার লেখা? কাকু কি লেখালিখি পছন্দ করে? কি বোঝে কাকু? বুঝুন একবার পাঠকবৃন্দ! বুঝবেনই বা কি করে? আমার কাক্কুটা যদি এইটুকু লেখা পড়ার সুযোগ পেতেন!নিশ্চিত একচোট হাসতে হাসতে বিষম খাবেন আমার অর্বাচীনতার নমুনা দেখে। কথা হলো -আমার কি দোষ? কতটা যুগ হবে? তা ধরা যায় তিন যুগ হতে বাকি আরো ৫/৬ বছর বাকি! এই সময়ে এসে যদি ভাস্তি জানার সুযোগ পায়, যে সেই ছয় নম্বর চাচ্চুটা এক বিশাল সাহিত্য সভার মধ্যমনি হয়ে অধিষ্ঠিত! তো ভাস্তির আর দোষ কি?
ফিরছি ক্লাস নাইনের ক্লাসরুমে!
ক্লাসরুমটা এমন এক জায়গায় অবস্থিত যে বয়েজ সেকসনের টিচার্স রুম, প্রধান শিক্ষকের অফিস রুম (যা একসাথেই ছিলো) থেকে স্যার বা দপ্তরী মজিবর’দা কোনো নোটিশ বা কোনো বার্তা নিয়ে দরজা দিয়ে রওনা দিলে স্পষ্ট দেখা যায়। জানালা বরাবর প্রথম সারির বেঞ্চে বসেই চোখ গেলো সোজা সেই টিচার্স রুমের দিকে। মজিবর’দা হাতে ঝুলিয়ে লম্বা নোটিশ লেখা লাল বাইন্ডিং খাতাটা নিয়ে এগিয়ে আসছেন গার্লস্ সেকসনের দিকে। হটাৎ কেন যেন চনমন করে উঠলাম কয়েকজন মিলে। আজ আর ক্লাশ করতে ইচ্ছে করছেনা। যদি এমন নোটিশ হয় তো ভালোই হয়,যে আজ চার পিরিয়ডের পর ক্লাশ অনিবার্য কারন বশতঃ ছুটি ঘোষনা করা হলো।
আদতে তেমন কিছুই হলোনা। অতি বিস্ময়ের আরেক ধাপ এই নোটিশ। স্কুল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হবে এই প্রথম বারের মতো। যার যেমন প্রতিভা অনুযায়ী লেখা জমা দাও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।যে যা পারো, গল্প, কবিতা,ছড়া, নাটিকা, বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখা, কৌতুক, ধাঁধা, আঁকা ছবি ইত্যাদি ইত্যাদি। চোখ মুখ হেসে উঠলো খুশিতে।
এবারই হয়তো প্রথমবারের মতো আমার কবিতা অফসেট পেপারে প্রিন্ট হয়ে জায়গা পাবে স্কুল ম্যাগাজিনে। একটা ভালোলাগা ঢেউ খেলে গেলো বুকের গহীনে। কেবলই মনে হতে থাকলো, ‘ কি নিয়ে লিখবো? দেশ,মাতৃভূমি? কিছু একটা যাই লিখিনা কেন আব্বা তো আছেন! দেখাই যাবে!
লিখে জমা দেবার দিন। ক্লাশে অনেকেই লেখা এনেছে। আমি সবারটা পড়ে দেখতে চাইছি, কোনো আশ্চর্য কারনে কয়েকজন মোটেই দেখতে/ পড়তে দিলোনা লেখা।
সবার লেখা জমা নিলেন স্যার ফখরুল আলম। খুব বেশি লেখা নয়। সবার লেখায় চোখ বুলাচ্ছেন স্যার। গিতা,মঞ্জুর লেখা স্যার দেখেই বাতিল করে দিলেন। বলে বসলেন সবার সামনেই,’এ লেখা তো খবরের কাগজের সাহিত্য পাতা থেকে উঠাইয়া নিয়া আসছো!’
প্রতিবাদ করে গিতা কিছু বলতে চাইতেই স্যার রুঢ় ভাবে থামিয়ে দিলেন। কেন যেন আমি খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। তখনও বুঝতে পারিনি স্যার আমাকে কাঁদিয়ে ছাড়বেন!…
প্রত্যেকের লেখায় নিজ নাম আছে শিরোনামের নিচে। আমার লেখাটা পড়েই আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন।
-এই লেখা তোর?
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। মুখে কিছুই বললাম না। শুধু মাথা নোয়ালাম হ্যাঁ সূচক। অবাক বিস্ময়ে বিস্ফোরিত চোখে খেয়াল করলাম, ফখরুল আলম স্যার ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়ছেন আর ঠোঁট কামড়াচ্ছেন।
এর মানে কি? আশ্চর্য! স্যার বিশ্বাস করছেন না এটা আমি লিখেছি? বিস্ময় আর হতাসায় আমি আশেপাশে তাকাচ্ছি, মালা, বাসন্তি, পুতুল, বিনা, রেখা, কেউ কিছুই বলছেনা। স্যার দৃঢ় ভাবে মাথা নাড়ছেন অবিশ্বাসে।
— এটা তোর লেখা হতেই পারেনা!
গলার কাছে হঠাৎ কিছু আটকে গেলে যেমন লাগে! আমারো তেমনি অনুভূতি হচ্ছে। আমি কিছু বলে ওঠার আগেই লুনা উঠে দাঁড়ালো।
লুনাঃ ছার,এইটা লিপি’ই লিখছে। ওতো ল্যাখে ছার! আপনে জানেন না?
তখনও স্যার মাথা নাড়ছেন আর বলছেন।
— সেইটা বুঝবে নির্বাচক দল। নিয়ে তো যাই!
ততক্ষনে আমার চোখে বৃষ্টিধারা বইছে। আমার লজ্জা লাগছিলো। আমাকেও কি স্যার গিতা,মঞ্জুর মতো লেখা চোর মনে করেছেন নাকি?…………
চলবে–
১১টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
ছয় নাম্বার চাচ্চুর কথা জানলাম, এত বছর পরে যদি জানো যে সে লেখা লেখির সাথে যুক্ত, তাহলে অবাক হতেও ভুলে যাবার কথা।
স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য লেখা জমা দেয়ার চমকপ্রদ কাহিনী জানলাম, নিজের লেখাকে যদি বলে চুরি করে লেখা, তাহলে কস্ট হওয়াই স্বাভাবিক।
চমৎকার উপস্থাপন করতে পারো তুমি।
শুভ কামনা।
বন্যা লিপি
অবাক হওয়া তো ভুলেই গেছি সেই কবে!! ২+২=৪ গুণতে ভুল হয়নিতো আমার!
এর চেয়ে বড় নামতা হলে হয়তো ফেল মারতাম😊
আর দুটো পর্বেই শেষ করে ফেলবো এ লেখা আশা করি।
এস.জেড বাবু
-এই লেখা তোর?
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। মুখে কিছুই বললাম না। শুধু মাথা নোয়ালাম হ্যাঁ সূচক। অবাক বিস্ময়ে বিস্ফোরিত চোখে খেয়াল করলাম, ফখরুল আলম স্যার ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়ছেন আর ঠোঁট কামড়াচ্ছেন।
কেমনডা লাগে-
কেমন লাগে তা ভাষায় লিখা যাবে না।
চোখ, মুখ আর শরীরের একত্রিত রাগের প্রতিচ্ছবি অক্ষরে প্রকাশ হয়না সম্ভবত।
বন্যা লিপি
রাগের থেকে আমি অপমানিত বোধ করছিলাম প্রচন্ড।আর অপমানটুকু নিতে পারিনি বলেই চোখের বৃষ্টি বাঁধ মানেনি আমার।
পরের পর্বেই জানা যাবে, মলমের প্রলেপ কিভাবে আমাকে উজ্জিবিত করেছিলো?
কৃতজ্ঞতা, শুভেচ্ছা জানবেন।
এস.জেড বাবু
কান্নাও একরকম রাগের বহিঃপ্রকাশ।
সামনের জন বুঝলেই হলো।
শুভকামনা আপু
ছাইরাছ হেলাল
আহা, বুঝতে পারি কী ব্যাথা তার প্রাণে তাহার প্রাণে,
যখন কেউ শুনতে পায় নিজের লেখা নিজের নয়।
আপনি লিখিয়ে হবেন, এখানে লিখবেন তাও আমাদের ভাবনার বাইরেই ছিল!
চলুক এবং চলুক।
বন্যা লিপি
আপনি লিখিয়ে হবেন, এখানে লিখবেন তাও আমাদের ভাবনার বাইরেই ছিল!”
একদম,জিসান সাহেব তাও কিছুটা ফেসবুক ওয়ালে দেখেছিলো, আমার লেখা, আপনার বেলায় তাও ভাবনার বাইরেই ছিলো। যেমন আমার ভাবনাতেই ছিলোনা, আপনি সোনেলার কবি মহারাজ।
তৌহিদ
আপনার চাচ্চুর সাহিত্যে বিচরনের খবর আমাকেও মুগ্ধ করে। যদিও সামনাসামনি দেখিনি, তবে ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে দেখার ইচ্ছে প্রবল আমার। হয়তো দেখা হবে কোন একদিন ☺
আপনার লেখা পড়ে আমি নিজেই বিস্মিত হয়ে যাই মাঝেমধ্যে, সেখানে স্যারতো হবারই কথা। নাইনের একজন ছাত্রী ভালো লিখেছিলেন বলেই আজ আমরা তার লেখা পড়তে পারছি। এইতো বড় পাওনা।
বন্যা লিপি
বরিশাল আসেন ভাই, আমার চাচ্চুদের সবার সাথেই পরিচয় করিয়ে দেবো।
আমার সৌভাগ্য, আমি সোনেলার একজন সৈণিক হতে পেরে ভাই। আপনাদের প্রেরনা আমাকে লিখতে উৎসাহিত করে।
শুভেচ্ছা জানবেন।
শিরিন হক
মিতা তোমাকে তো ম্যার বিশ্বাস করতে পারেনি কষ্ট পেয়েছো অপমানিত হয়েছো রাগ ক্ষোভ কিছুটাতো ছিলই। আমাকেও একজন এমনি করে বলে কারতা কপি করছো?
ভাগ্গিস চাক্ষুষ জনেরা সাক্ষী দেয় আমার নিজ হাতে লেখা। তবুও কষ্ট হয় আমার অ লেখার এমন তাচ্ছিল্যের মন্তব্য শুনে।
তুমিতো খুব ভালো লেখো তোমার থেকে অনুপ্রেরণা পাই সবসময়। অমন স্যারের এমন মেয়ে কজন হতে পারে বলো?
ভালোথেকো।
বন্যা লিপি
তোমার মন্তব্যের কি জবাব দেই বলোতো মিতা? তোমাকে আগেও বলেছি এই অবজ্ঞা পাশ কাটিয়ে লিখে যাও তুমি তোমার অনুভূতির আশ্রয়ে। আমি আছি তোমার সাথে যতদিন বেঁচে আছি ইনশাল্লাহ্। তোমার আমার সম্পর্ক এখন আমার ‘বন্ধু’র চেয়েও কাছের! নিশ্চই বুঝতে পেরেছো কি বলছি?
তুমি আমার বাবা’কে কাছ থেকে দেখেছো, জেনেছো তাঁকে। একসময়ে তিনিও তোমাকে যতটুকু প্রেরণা দিয়েছেন, তাঁর মেয়ে হয়ে হয়তো তাঁর মতো পারবোনা। আমার যোগ্যতানুযায়ী আমি আমি তোমার পাশে আছি সবসময় জেনো।
ভালো থাকো সবটুকু ভালোথাকা নিয়ে।