
“পালকীত মুই না চড়ং
মাথা যে ঘোরে।”
গানটি ইউটিউবে সার্চ দিলে দেখা যাবে লাইক পরেছে পাঁচটা। অথচ নতুন একটা আধুনিক গান বের হলেই লাইক কয়েক লাখ হয়। ভুলে যাই, মাটির কথা। যাঁদের অবদানে আমাদের লোক সঙ্গীত সমৃদ্ধ, তাঁদের একজন শ্রদ্ধেয় কছিম উদ্দীন।
যে গানটা দিয়ে এই লিখা শুরু হয়েছে, সেটি ভাওয়াইয়া গান। এই গান মূলত রংপুর অঞ্চল ও ভারতের আসামের গোয়ালপাড়ায় প্রচলিত এক প্রকার সংগীত। এই গানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্থানীয় সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, কর্মক্ষেত্র এবং তাদের পারিবারিক ঘটনার প্রয়োগ।
ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট আব্বাস উদ্দীনের পর কছিম উদ্দীনের নাম আসে। তাঁকে বলা হয় ভাওয়াইয়া গানের যুবরাজ। তিনি গান লিখতেন, সুর করতেন আবার নিজেই গাইতেন। তাঁর জন্ম ১৯৩৪ সালের ১২ই মার্চ; লালমনিরহাট জেলার তিস্তা স্টেশনের কাছে রবিপুর গ্রামে। ছোটবেলায় তিনি অত্যন্ত ডানপিটে ছিলেন। গাছের ছায়ায় বা নদীর ধারে গলা ছেড়ে গাইতেন। গানের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা তাঁকে, তাঁর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে।
স্কুলে ভর্তি হলেও পড়াশোনার চেয়ে শিক্ষকদের মন কেড়েছিলেন গান দিয়ে। স্কুলের পাঠ শেষ না করে তিনি যোগ দিয়েছিলেন গানের দলে। একবার তিনি সেনাবাহিনীতেও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু চিরাচরিত নিয়ম তাঁর ভালো লাগেনি কখনো। ছেড়ে দিয়ে তিনি গানের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন রংপুরের আনসার বাহিনীতে ১৯৪৮ সনে।
১৯৫০ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে গান গেয়ে, মন কেড়েছিলেন আব্বাসউদ্দিনের। তাঁর সহযোগিতায় ঢাকা রেডিওতে সঙ্গিত শিল্পীর পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। ১৯৫২ সালে, ২৫ জুলাই তিনি প্রথম রেডিওতে সঙ্গিত পরিবেশন করেন।
১৯৫৪ সাল থেকে তিনি গান লিখতে শুরু করেন। সেই সময় মুসলিমলীগের নির্বাচনী প্রচারণায় গান গেয়ে “কোকিলকণ্ঠী” নামে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে কুড়িগ্রামের হোলখানা ইউনিয়নের আছমত ব্যাপারীর বড় মেয়ে গোলাফুন নেছার সাথে তাঁর বিয়ে হয়।
১৯৬৪ সনে, “হিজ মাস্টারস ভয়েজ” কোম্পানিতে প্রথম নিজের লেখা গান তাঁরই কন্ঠে রেকর্ড করা হয়। তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত টেলিভিশনে ভাওয়াইয়া গান পরিবেশন করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কুচবিহারের মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প পরিদর্শনে গেলে, কছিম উদ্দীন তাঁর সম্মানার্থে একটি স্বরচিত গান পরিবেশন করেন। গানটি ছিলো:
“তোমরা ভারতবাসী ভাই
তোমার গুণের সীমা নাই!”
এই গান শুনে ইন্দিরা গান্ধী নিজের গলার মালা তাঁকে পরিয়ে দিয়ে সম্মানিত করেন।
১৯৭৭ সনে বিবিসি তাঁর সাক্ষাতকার সহ, তাঁর কণ্ঠের একটি গান প্রচার করে। গানটি ছিলো:
একে তো গরমের দিন
কাটুয়া মশার প্যানপ্যানানি
নিদ ধরে না চাপরাইতে
বিচনের ঘ্যানঘ্যানি
আর কতো শুনিম
এমন করি কামড়ায় মশা
তোলেরে চমচমি।”
তিনি গান লিখতে, গাইতে সবসময় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় দুরন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যোগাতে তিনি গেয়েছিলেন:
“ওকি বাপরে বাপ
মুক্তিফৌজ কি যুদ্ধ করে, বাপরে বাপ।”
১৯৮৬ সালে তাঁর লিখা ও সুরারোপিত ১২টি গানের প্রথম অডিও ক্যাসেট বের হয়। তিনি একশো প্রকার পাখি ও মাছ নিয়েও গান লিখেছেন।
ইনিই একমাত্র শিল্পী যাঁকে নিজের গাঁ ছেড়ে যেতে হয়নি। তিনি ভাওয়াইয়ার পথে থেকেছেন, থেকেছেন কুড়িগ্রামে। তাঁর বিস্মিত হওয়া, ঠোঁট নাড়া, হাঁটা, সব ছিলো কুড়িগ্রামের মতো। তিনি ছিলেন কোচ রাজবংশী, চাড়াল- চন্ডালদের সন্তান। তিনি ছিলেন হালুয়া, জালুয়া, গাড়িয়াল। তাঁকে বলা হয় “মাটির ছাওয়া”। ভালোবাসা, সম্মান, স্বাধীনতা, দেশাত্মবোধ না শিখেই তিনি জান বাজি রেখেছিলেন ভাওয়াইয়া গানের জন্য। তিনি ছিলেন জাতীয় সংস্কৃতি নির্মাতাদের একজন।
গুণগ্রাহী এই শিল্পী, ১৯৯২সালের ২২ শে আগস্ট চলে যান, না ফেরার দেশে।
তাঁর শিল্পী সত্তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, কুড়িগ্রামের খলিলগন্জে ২০০৩ সালের ২৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠা করা হয় “কছিম উদ্দীন সঙ্গীত নিকেতন”।
আমরা ওনার কথা মনে রাখবো। এবং তাঁর গানগুলো সংরক্ষণ করার চেষ্টা করবো; যেনো আগামী প্রজন্ম তাঁর গানগুলোর ধারাবাহিকতা রাখে।
২৮টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
হ্যা আমরা মাটির এই সন্তান্দের ভুলেই যাই। এই আধুনিক সভ্য যুগে আর ঐসব কৌকিল কুন্ঠের কদর নেই। তার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
কামাল উদ্দিন
……………বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়। বংশে নয় কাজের জন্যই উনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে হাজার বছর।
আরজু মুক্তা
জি, কাজেই বেঁচে থাকবেন।
শুভকামনা!
কামাল উদ্দিন
শুভকামনা আপনার জন্যও
এস.জেড বাবু
“কছিম উদ্দীন সঙ্গীত নিকেতন” এর যথাযথ সার্থকতা কামনা করছি।
একজন গুণী মানুষ সম্পর্কে জানলাম। ভাললাগা রইলো সংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন সম্পর্কে এমন সুন্দর পোষ্ট এর জন্য।
আরজু মুক্তা
শুভকামনা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
গুণী মানুষ সম্পর্কে জানলাম।
তাঁর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইলো।
ধন্যবাদ দিদি এমন সুন্দর পোষ্ট এর জন্য।
আরজু মুক্তা
দাদা, ধন্যবাদ পড়ার জন্য
নিতাই বাবু
লিংক দিলাম!
আরজু মুক্তা
কিসের লিংক দাদা।
দেখা যাচ্ছেনা!
নিতাই বাবু
তাহলে আপনার মোবাইল কিম্বা ল্যাপটপে সমস্যা হতে পারে । আমি লিংক পাচ্ছি, আপনি পাবেন না কেন?
সাবিনা ইয়াসমিন
তথ্যবহুল লেখা। এর মাধ্যমে একজন গুণী ব্যাক্তিকে জানতে পেলাম। ভাওয়াইয়া সঙ্গীত এক সময়ে আমাদের সস্কৃতিতে ওতপ্রেত ভাবে মিশে ছিলো। কিন্তু এখন এই গানের শিল্পী আর শ্রোতা নেই বললেই চলে।
ভালো লিখেছেন,
শুভ কামনা 🌹🌹
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ, আপি।
মাটির টান কি ভোলা যায়??
ছাইরাছ হেলাল
এই প্রথম আপনার মাধ্যমে এমন গুণী মানুষের কথা জানলাম।
যেখানেই তিনি থাকুন, ভাল থাকুন এই কামনাই করি।
আরজু মুক্তা
ওপারে ভালো থাকুন উনি।
শুভকামনা
রেহানা বীথি
শ্রদ্ধাবনত হই এমন শিল্পীর প্রতি। আমাদের সাহিত্য- সংস্কৃতির ধারক তাঁরা। তাঁদের মত গুণীজনরা অমর হয়ে থাকবেন ইতিহাসের পাতায়। তাঁদের কীর্তি ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের।
সুন্দর পোস্টটির জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
আরজু মুক্তা
আপি, আপনাকেও ধন্যবাদ।
মনির হোসেন মমি
ভাটিয়ালী ভাওয়াইয়া গানগুলোতে আমাদের অস্তিত্বের জানান দেয়।বংশ পরিচয় যাই হউক কর্মটাই বড়। তার কর্ম তাকে বাচিয়ে রাখবে চিরকাল।ভাল থাকুক প্রিয়।
আরজু মুক্তা
ভালো থাকুন উনি। আর তাঁর গান বেঁচে থাকুক হাজার বছর।
জিসান শা ইকরাম
কছিম উদ্দিন সম্পর্কে কিছুই জানতামনা।
আমাদের দেশে এমন ধরনের গায়কের প্রচার হয়না। অথচ বিদেশে কান্ট্রি মিউজিক খুবই জনপ্রিয়।
লোকজ গানের কদর নেই আমাদের দেশে।
একজন গুনিনকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
ভাল থাকুক উনি ওপারে।
এমন লেখা আরো চাই।
আরজু মুক্তা
ভালো থাকুন ওপারে।
দোয়া করবেন। লিখতে যেনো পারি।
তৌহিদ
তথ্য সমৃদ্ধ দারুন একটি লেখা পড়লাম। কছিম উদ্দিন সম্পর্কে আমি নিজেই কিছু জানতামনা। তিনি বেঁচে থাকবেন তার কর্মে। রংপুরের গর্ব তিনি।
এমন লেখার জন্য ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য।
আরজু মুক্তা
আমিও কৃতজ্ঞ। এমন প্লট পেয়েছি। তাঁর কর্মের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন। ভালো থাকুন ওপারে।
সুরাইয়া পারভিন
আমিই গান শুনি না তাই ভাওয়াইয়া গায়ক কছিম উদ্দিন সম্পর্কে জানার কথাও নয়। এমন গুনী শিল্পী সম্পর্কে জানতে পেরে ভালো লাগলো।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন আপু
আরজু মুক্তা
ভালো লাগলো লিখাটা পড়েছেন বলে।
শুভকামনা
নিরব সাগর
যার জন্য লিখেছেন তিনি একজন কিংবদন্তী তাকে ভুলে যাবার নয় ।যে লেখেছে সেও তো মহান তাকেও মনে রাখতে হয়।
আরজু মুক্তা
এরপর কিছু বলার থাকেনা।
শুভকামনা।