আমেরিকায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বসবাসের দিক দিয়ে সংখ্যায় নিউইয়র্ক নগরী সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। বাংলা ভাষাভাষীদের উদ্যোগে নিউইয়র্ক স্টেটে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়েই বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে চলছে নানান কর্মসূচী। বিচ্ছিন্নভাবে একাধিক স্থানে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে একাধিক সংগঠন। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরের আগে বিকেল থেকেই দেশের গান, আবৃত্তি, ছড়া, নাচ চলে বিরামহীন। সবচেয়ে আশার কথা হোল যে, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের অধিকাংশই বিদেশে জন্ম এবং বেড়ে উঠা আমাদের নতুন প্রজন্মের শিশু কিশোররা। এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতিকেই যে শুধু তুলে ধরা হচ্ছে তা কিন্তু নয়। বিশ্ববাসীর সামনে আমাদের বাংলা ভাষার গৌরবকেও তুলে ধরা হচ্ছে। রাত বারোটা এক মিনিটে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অঞ্চল ভিত্তিক সংগঠনগুলো একে একে শহীদমিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের ধারা চলমান রেখেছে। এই ধারা আমাদের নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত। এদিক থেকে আবার মুক্তধারার উদ্যোগ ভিন্ন। বাংলাদেশের অমর একুশের প্রথম প্রহরের সাথে মিল রেখে জাতিসংঘের সামনে অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করা হয়। এবং এই আয়োজনে প্রবাসের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষী মানুষ সামিল হন সপরিবারে। দেশ ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে বাংলা ভাষার প্রতি সন্মান রেখে এই যে এত আয়োজন তা কেবল একটি বিশেষ দিন কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসকে ঘিরেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রবাসে বেড়ে উঠা শিশু কিশোরদের সাথে নিয়ে বাংলা সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত বিশেষ বিশেষ দিবসকে উপলক্ষ করে এমন আয়োজন চলে সারা বছর জুড়ে।
শুধু তাই নয়, নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষার চর্চা এবং সংস্কৃতি শেখানোর জন্যে নিউইয়র্কে বেশ কিছু বাংলা স্কুল গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ম্যানহাটনে চালু করা হয়েছে বাংলা সাংস্কৃতিক স্কুল। প্রবাসের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির উদ্যোগে বাংলা স্কুল চালু করা হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বেশ কিছু বাংলা স্কুল ঘরোয়া ভাবে শুরু করেছেন কেউ কেউ। এমন একটি বাংলা স্কুল সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে এবং নিজের খরচে পরিচালনা করছেন এমন একজনের সাথে কথা হয় এ বিষয়ে। জানতে চেয়েছিলাম প্রবাসে বেড়ে উঠা আমাদের নতুন প্রজন্মের বাংলা ভাষার চর্চা নিয়ে তিনি কতটুকু আশাবাদী কিংবা সন্তুষ্ট। তিনি জানালেন যে, একেবারেই বিনামুল্যে শিশুদের জন্যে স্কুলটি চালু করেছিলেন একরকম চ্যালেঞ্জ হিসেবে। নিজের সন্তানকে নিয়েই শুরু করা এই স্কুলের শুরুর দিকে দারুণভাবে সাড়া পেয়েছিলেন। মায়েদের মাঝে উৎসাহও পরিলক্ষিত হয়েছিল। কিন্তু কালক্রমে ধীরে ধীরে সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে। স্কুলটিতে বাংলা বর্ণমালা, শব্দ, বাক্য লেখা শেখানোর পাশাপাশি ছবি আঁকাও শেখানো হতো। শিশুদের নিজের শেকড়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার ছবি আঁকা শেখানো হতো। জানালেন এরই মাঝে একজন স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। সেই কিশোরীরর মায়ের কাছে জানা গেলো যে তার বাবা খুবই পরহেজগার মানুষ। বিধায় ছবি আঁকা পছন্দ করেন না বলে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। স্কুলটির পরিচালক জানান, শিশুদের পরিবার আন্তরিক হলে খুব দ্রুতই বাংলা শেখানো সম্ভব হতো। তিনি বেশ আক্ষেপ এবং দুঃখের সাথেই বলেন, ‘ এই প্রবাসে লক্ষ করলেই দেখতে পাবেন কোন বৈশাখী মেলা কিংবা অনুষ্ঠানাদিতে প্রতিজন মায়ের সাথে দুই/তিনজন শিশু কিশোর থাকেন। সেইসব মায়েরা যদি নিজ নিজ সন্তানদের বাংলা শেখানোর ব্যাপারে আগ্রহী হতেন তবে আমার স্কুলে স্থান সংকুলান হতো না। আরো অধিক সংখ্যক বাংলা স্কুল গড়ে উঠত নিশ্চিত। সবচেয়ে বড় কথা মায়েদের সদিচ্ছার অভাব। ‘ তিনি আরো জানান, তার স্কুলে আসা অনেক শিশু কিশোরদের মায়েরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন না। অধিকাংশই নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। যেমন পানিকে বলেন ‘হানি’, রুটিকে বলে ‘উটি’, আমাকে উচ্চারণ করে ‘হামাক’। আবার বাংলা স্কুলে শেখানো হচ্ছে জাতীয় ফল ‘কাঁঠাল’। কিন্তু বাড়িতে কিছু বাবা-মা বলছেন ‘কাঁডল’। এমনসব আঞ্চলিক শব্দ নতুন প্রজন্মের বাংলা ভাষা শেখার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কেননা বাংলা স্কুলে শেখানো হচ্ছে একভাবে, কিন্তু বাড়িতে সেই উচ্চারণগুলোই বাবা কিংবা মা করছেন অন্যভাবে। এতে এই প্রজন্মের শিশু কিশোরেরা দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায়। তাদের কাছে ভাষাটি কঠিন মনে হয়। তাই শিশুদের শেখানোর পাশাপাশি মায়েদেরও সচেতন করে দিতে হয় বাড়িতে শুদ্ধ বাংলা বলার জন্যে। আবার বিদেশে জন্মানো আমাদের এই প্রজন্মের সন্তানেদের অধিকাংশই যে উচ্চারণে বাংলা বলে, তা পুরোপুরি সঠিক উচ্চারণ নয়। যতবার ভুল উচ্চারণ করবে, ততবারই সংশোধন করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার পনর বছরের টেনথ গ্রেড পড়ুয়া ছেলে পরিবারের সাথে কিংবা ছোটভাইয়ের সাথে পুরোপুরি বাংলায় কথা বলে যদিও, কিন্তু তার উচ্চারণেও কিছুটা ভুল পরিলক্ষিত হয়। আমি হয়তো বললাম, তুমি আমাকে বিষয়টি আগে জানাওনি কেন ?’ জবাবে সে বলবে, ‘ আমি ভলে গেছি ‘। তখন সাথে সাথেই তাকে ধরিয়ে দেই, ‘ বল, ভুলে গেছি ‘। কখনোবা বলে ‘ তুমি কি আজ ওখানে যাইছো ?’ তখনই ছেলেকে সংশোধন করে দেই, যাইছো হবে না। শব্দটি হবে ‘ গিয়েছো ‘। বাংলা স্কুলটির পরিচালকের কাছে পরামর্শ চেয়েছিলাম ঘরে বসে সহজ পদ্ধতিতে কীভাবে বাংলা লিখতে শেখাবো আমাদের সন্তানদের। বললেন, শিশুরা যেন বাংলা লিখতে শেখাকে বাড়তি চাপ মনে না করে সেইজন্যে একটু ভিন্নভাবে শেখাতে হবে যাতে তারা এই শেখার মাঝে আনন্দ খুঁজে পায়। প্রয়োজনে দিনে একটি করে বর্ণ লেখা শেখাতে। শুরুতে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জন বর্ণ, তারপর আ-কার, ই-কার … এভাবে ধাপে ধাপে এগোতে হবে। শেষে তাকে শব্দ বানাতে দিতে হবে। যেমন, বর্ণের সাথে বর্ণ যুক্ত করে কেমন করে ‘বক’ শব্দটি লিখতে হয় শিশুকেই খুঁজে বের করতে দিতে হবে। এভাবে শেখানোটা শিশুরা আনন্দের সাথে গ্রহন করে। নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষার চর্চায় এই যে অল্প বিস্তর হলেও কাজ করে যাচ্ছেন আন্তরিকতার সাথে, এজন্যে তাকে সাধুবাদ জানাই।
আমি যে মসজিদে আমার সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষার জন্যে নিয়ে যাই, সেখানে বেশ কিছু বাংলা ভাষাভাষী মায়েরা তাদের সন্তানদের নিয়ে আসেন। সেইসব সন্তানদের কখনো বাংলাভাষায় কথা বলতে শুনিনি। মায়েরাও শিশুদের সাথে ইংরেজিতেই কথা বলেন। একদিন প্রশ্নটা করেই ফেলি। জানতে চাই সন্তানদের বাংলা না শেখানোর কারণ। যে বিষয়টি জানা গেলো তা হচ্ছে প্রবাসে জীবন জীবিকার তাগিদে প্রতিনিয়তই তাদের যুদ্ধ করে যেতে হয়। নানাবিধ টানাপড়েন থাকে। ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয় সাংসারিক ব্যয় মেটাতে এবং দেশে রেখে আসা সমস্যাসংকুল পরিবারের একটা বড় অংশকে সহযোগিতায়। এতো হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর দায়িত্ব পালন শেষে এদিকটায় মনোযোগ দেয়া হয়ে উঠে না। অন্যজন বললেন, ‘এই মার্কিন দেশে বাংলাভাষা চর্চা আমার সন্তানদের জীবিকার বাজারে তো কোন ভূমিকা রাখে না। রাখে কি ? ‘ তিনি আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকান। একজন বাংলাভাষী মায়ের এমন প্রশ্নে আমার মনে হচ্ছিল, নিজের ভাষা কিংবা সংস্কৃতি বিমুখ এই প্রজন্ম ভিনদেশি ভাষা কিংবা সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হলে তাদেরই বা দোষারুপ করি কেমন করে ! এভাবেই কী আমাদের রক্তের দামে কেনা গৌরবময় বাংলা ভাষা হারিয়ে যাবে ?
প্রবাসে নানা ঘাত প্রতিঘাতের পরেও কিছু মানুষ আছেন তারা ভাষা চর্চা এবং সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে আরো সমৃদ্ধ করার জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। নিজস্ব ভাষা চর্চার সাথে নাড়ীর টান না থাকলে আমরা কখনো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো না। এক্ষেত্রে অভিভাবকদেরই সচেতন হতে হবে আগে। পারিবারিক অনুশাসনে বাঙালি হিসেবে আমাদের সন্তানদের গড়ে তুলতে হবে। কষ্টসাধ্য হলেও আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে। প্রবাসে আমাদের নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষাকে ধরে রাখার জন্য জোরালোভাবে ভুমিকা রাখতে হবে। নইলে এ দায় যে আমাদেরই।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৭টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
একুশে ফেব্রুয়ারীতে এত আয়োজন হয় নিউইয়র্কে জানাই ছিল না,
আসলে এসব জানিয়ে লেখা লেখিও চোখে তেমন পরে না।
বাংলা ভাষার জন্য যে সমস্ত মানুষ কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
পরিবারের মধ্যে বাংলার প্রতি ভালোবাসা না থাকলে, এই প্রজন্ম বাংলা থেকে দূরে চলে যাবে।
পরিবারেই মধ্যেই এর চর্চা বজায় রাখতে হবে।
ধন্যবাদ দিদি ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
প্রবাসে বসে এমন প্রায় অসাধ্য কেউ কিছু ভাবছে ভাবতে ভালই লাগে।
আপনার কাছ থেকে জানতে পারছি।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আমার প্রানের ভাষা বাংলাকে নিয়ে বিশ্বে কম আগ্রহ নেই।তাইতো এটা এখন আন্তজার্তিক মাতৃ ভাষা হিসাবে স্বীকৃত।এ সব ভিন দেশের বাংলা ভাষার প্রচারে যারা সহযোগিতা করছেন তাদের প্রতি রইল শুভ কামনা।
ইঞ্জা
ইদানীং বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস পালন করে বিভিন্ন দেশে তা জানি কিন্তু নিউইয়র্কে এতো বৃহত পরিসরে করে তা জানা ছিলোনা আপু যা আজ জানলাম।
গুড পোস্ট। (y)
মোঃ মজিবর রহমান
আন্তরজাতিক ভাষা হওয়াতে একুশে ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বে প্রসার ঘটেছে। এই লেখায় তা প্রমান।
সাবিনা ইয়াসমিন
মাতৃভাষা বাংলাকে আন্তর্জাতিক ভাবে বিশ্বে সস্মমানের আসনে রাখার জন্যে প্রবাসীরা যেভাবে নিরলস প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে তা প্রশংসা ও গৌরবের। আপনার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত জানতে পারি সেসকল। ভালো লাগে লেখাগুলো পড়তে। ভাষাদিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরাই বিশ্বের একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্যে প্রান দিয়েছেন।
ভালো থাকুন, ভালোবাসা নিরন্তর ❤❤
রিতু জাহান
আমার বান্ধবী তার দুই ছেলে নিয়ে আমেরিকা চলে যায় আজ পাঁচ বছর হলো।
ওর সাথে ইমোতে কথা হয় প্রতি শনিবার রাতে। ওর বড় ছেলে একটা স্কুলে বেশ কিছু বাচ্চাকে বাংলা শেখায়। গান শেখায়।
মাঝে মাঝেই গেট টুগেদার হয় ওদের। সংস্কৃতিকে যারা ধারন করে তারা খুব সুন্দের মতো তা পালন করে। তবে বাচ্চাগুলো আসলে এক সময় অভ্যস্ত হয়ে যায় ওখানকার ভাষা ও পরিবেশে। ইচ্ছা করলেও আসলে সে মাতৃভাষার টানটা আর আসে না। টান মানে বলার ধরন বলতে চাচ্ছি আমি। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি অন্যান্য দেশের চেয়েও সমৃদ্ধিশালী। একে লালন করে চলি আমরা সকল পরিবেশেই।
চমৎকার লিখেছো আপু।