বড় পাথরটা আরো ছোট ছোট পাথর সাথে নিয়ে তীরের বেগে নীচের দিকে ছুটে চলছে। ঐ যে মমব্রুকে দেখা যাচ্ছে ! পাথরের গতিপথের ঠিক নীচেই সে দাঁড়িয়ে আছে এ কথা মনে হতেই আমার হাত পা হীম হয়ে গেলো।
মমব্রু! মনব্রু! চিৎকার করে ডাকলাম। কিন্তু পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দে আমার আওয়াজ তার কান পর্যন্ত পৌঁছালোনা সেটা তার হাত নাড়ানো দেখেই বুঝতে পারলাম। ইশারায় কি যেন বলছে! সেও দেখতে পেয়েছে পাথরগুলো তার দিকেই ছুটে যাচ্ছে! তবে কি ইশ্বর তার বাবার মত তাকেও বুকে টেনে নিতে চলেছে! আমার দম বন্ধ হয়ে উঠছে।
মমব্রু পাহাড়ের সন্তান। এখানকার সমস্ত বিপদআপদ তার চেনা। কখন কি করতে হবে তা সে ভালো জানে। তারপরেও বিপদ কি কখনো কাউকে ছেড়ে কথা বলে?
দুপাশে লাঠিতে একটা মোটা কাপড় বেঁধে স্ট্রেচারের মতন বানিয়ে তাতে মমব্রুকে শুইয়ে আমরা ছুটে চলেছি। সাথে গাঁয়ের আরো দু’জন। মমব্রুর মা চিনিপ্রু শোকে প্রলাপ বকছে আর বুক চাপড়িয়ে আমাদের সাথে দ্রুত হাঁটছে।
আমরা পাহাড় থেকে তখন দ্রুত নীচে নেমে আসি। সবার আগে নেমেছি আমি। মামা বারবার সাবধান করছিলেন পিছন থেকে, কিন্তু আমার একবারও মনে হয়নি পাথরে পড়ে আমারো পা ভাঙতে পারে! আমার শুধু বার বার মনে হচ্ছিলো নীচে মমব্রু বেঁচে আছেতো!
নীচে নামতেই মমব্রুর নীথর দেহ পড়ে থাকতে দেখলাম। দু এক জায়গায় থেঁতলে গেছে। মাথা দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। মাথার নীচের মাটি রক্তে ভিজে উঠছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি নিজের হাতটা দিলাম তাকে। সে আঙুলগুলো জড়িয়ে ধরে বললো – আত্তি!
লিপন ভাই দ্রত মমব্রুর মাথায় নিজের শার্ট খুলে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। মামা তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে ছুটতে লাগলেন। পিছে পিছে আমি। সে বেঁচে আছে, তবে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। এক দুপুর লেগে যাবে সেই আর্মি ক্যাম্পে পৌছতে! পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেয়েই মমব্রু উপরের দিকে তাকিয়েছিলো। কিন্তু সরে যাবার খুব বেশী সময় পায়নি। চট করে পাহাড়ের গায়ে শুয়ে পড়েছিলো বলেই রক্ষা পেয়েছে। তিন চারটা মাঝারি পাথর তার শরীরে আঘাত করে। ইস! যদি বড় পাথরটা মাথায় পড়তো! আমি আর ভাবতে পারলাম না!
আমরা ছুটছি হাঁসফাঁস করে। আর কিছুদুর গেলেই আর্মি ক্যাম্প। সেখানে ডাক্তার আছে, চিকিৎসার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে। তাদের গাড়িও আছে। প্রয়োজনে হয়তো তাদের সাহায্য নিয়ে ব্যবহার করা যাবে, যদি হাসপাতেলে যেতে হয়। আমি আর খারাপ কিছু ভাবতে চাইনা।
আমি মমব্রুর রক্তমাখা মায়াবী মুখের দিকে তাকালাম। আমরা দ্রুত হাঁটছি, মমব্রু একটু চোখ খুলে ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলো। আমি তার পাশে আসতেই সে আমার আঙুলগুলোকে নিজের হাতের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আবার চোখ বন্ধ করলো। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। আমি কানটা তার মুখের কাছে নিয়ে শুনতে পেলাম- আত্তি আত্তি ; আব্বাজী! আব্বাজী! আমার চোখ ভিজে উঠছে।
(সমাপ্ত)
এটি একটি কাল্পনিক গল্পকাহিনী। লেখাটি পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
ছবিঃ সংগৃহীত
১৮টি মন্তব্য
তৌহিদ
ক’দিন নেট কানেকশন না থাকায় এই পর্বটি দিতে দেরী হলো। আশাকরি সবার ভালো লাগছে লেখাটি।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
পড়লাম।আমি বাকরুদ্ধ!
মমব্রু! পরোপকারী জীবনের অবসান।
লেখার নামকরন স্বার্থক।তবে আপনি অনেক সাহসী মনে হল।
তৌহিদ
দাদা রিস্কি কাজে আমার অতিরিক্ত সাহস অনেকবার বিপদ ডেকে এনেছে। ছোটবেলা থেকেই আমি দুরন্ত স্বভাবের। লেখাটি ভালো লেগেছে জেনে উৎসাহ পেলাম। শুভকামনা জানবেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
পাহাড়ের গল্প,,পাহাড়ির গল্প। মমব্রুর মৃত্যু একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিলো। গল্পের শেষ অক্ষর পর্যন্ত আশা করছিলাম,,আপনি হয়তো মমব্রুকে বাচিয়ে আনবেন। ইশ্বরের পাহাড় ” গল্পের নাম আর পাহাড়ের নামটির সার্থকতা বজায় রইলো।
গল্পটা পড়ে খুব ভালো লাগলো ,,এমন গল্প আরো অনেক পড়তে চাই। শুভ কামনা ও নববর্ষের শুভেচ্ছা রইলো। -{@ -{@
তৌহিদ
আপনার মন্তব্যে উৎসাহিত হলাম আপু। অনেক শুভেচ্ছা জানবেন।
বন্যা লিপি
পাহাড়, পাহাড় ঘেরা জিবনের গল্পের ভক্ত হয়ে উঠেছি সেই বুদ্ধদেব গুহ,সমরেশ মজুমদারের লেখা পড়ে, আবার ওয়েষ্টার্ন সিরিজের অনুবাদীয় কাহিনী পরে পরে… এতো বাস্তবতার নিরিখে লখা!! এককথায়… লা — জবাব।শুভ কামনা। -{@
তৌহিদ
আপনার জন্যেও অনেক শুভকামনা আপু।
রেজওয়ান
মমব্রু শেষ পর্যন্ত বাবার কাছেই ফিরে গেলো😭মা’য়ের ভয়টাই সত্যি হলো!!😞
তৌহিদ
মায়ের মন যে তাই, মায়েরা আগে থেকে কিভাবে যেনো সব বুঝতে পারে।
মোঃ মজিবর রহমান
খুব হৃদয় বিদারক। এই মৃত্যু আমি চাই না। ভাল লেগেছে তবে সাবধান হওয়ার সুযোগ থাকেনা মৃত্যু যখন দোড় গোড়ায়।
ভাল লাগলো।
তৌহিদ
মৃত্যু একটি অমোঘ নিয়তির নাম, যাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমাদের কারোরই নেই। ধন্যবাদ জানবেন।
মাহমুদ আল মেহেদী
অনেক ভালো লাগলো ভাই। অনেক অনেক ধন্যবাদ ।
তৌহিদ
ধন্যবাদ ভাইয়া, ভালো থাকবেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
মায়ের যন্ত্রণাটা অনুভব করছি।
এভাবে শেষ হবে, আমি ভাবতে পারিনি। খুব কষ্ট হচ্ছে।
আপনার লেখাটা সার্থক।
তৌহিদ
মায়ের মন আগে থেকেই অনেক কিছু টের পায়। মায়ের তুলনা মা’ই। সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
🌺🌺
ছাইরাছ হেলাল
দেরি হওয়া কোন ব্যাপার না।
সমাপ্তিটা সত্যি হৃদয় বিদারক ছিল।
লেখা ভাল লেগেছে।
তৌহিদ
ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনারা লেখা পড়ে মন্তব্য করেন বলেই উৎসাহ পাই। শুভেচ্ছা রইলো।