তৃপ্তিতেই প্রাপ্তি।

রিতু জাহান ৩০ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ০২:৩৪:২৩অপরাহ্ন গল্প ১২ মন্তব্য
ক্যাডেট কলেজ ছুটি। বাড়িতে এসছি। মহাআনন্দ। আসলে বই পড়তে পারব এটাই আমার মহাআনন্দ। আজ শুক্রবার। আমার অভ্যাসমতো প্রতি শুক্রবার জানলার দিকে মাথা দিয়ে কাঁথার নীচে গল্পের বই নিয়ে পড়া। মাত্র শুয়েছি। পুরো বাড়িতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। গ্রীষ্মের ভর দুপুর, আম্মুও হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। কয়েকদিন যাবত আম্মুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। এবার নানুবাড়ি মোংলা গিয়ে আম্মুর সব টেস্ট করিয়েছি। টাইফয়েড হয়েছে আম্মুর। চৌদ্দটা ইনজেকশন দিতে হলো আম্মুকে। তার উপর এতো লম্বা একটা জার্নি। মোংলা থেকে এই উত্তরবঙ্গ রংপুরে আসতে সতেরো থেকে আঠারো ঘন্টার জার্নি। আম্মু খুব ক্লান্ত। আসলে টেনশনও করে খুব আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে। তার উপর বাবার শরীরটাও ভালো থাকে না। আমার ছোটো ভাইকেও আম্মু ক্যাডেটে দিবে, আমার এবার জেএসসি সব মিলায়ে আম্মু টেনশন করে।
বাইরে গেটে কেউ নক করছে মনে হলো। একটু বিরক্তি নিয়েই উঠলাম। সারা সপ্তাহে এই একটা দিনই আমি গল্পের বই পড়ার সুযোগ পাই। জেএসসি দিব বলে আম্মু একটু কড়াকড়ি শুরু করেছে আসলে। যাইহোক, উঠে দরজা খুলতে গেলাম। দেখি আমাদের পেপার দেয় যে, সেই দাদু। প্রায় বৃদ্ধ বয়স এখন তার। এক সময় তার শক্ত সামর্থ এক শরীর ছিলো দেখেই বোঝা যায়। এখন মুখে তার ক্লান্তির ছাপ। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। তবু কোমলতা আছে যেনো এখনো। আমাদের এই বাসায় এখন পেপার দেয়। চিনি কিন্তু কখনো আলাপ হয়নি ওরকম। বললাম কি দাদু? তিনি বললেন, খুব পিপাসা পেয়েছে একটু পানি চাই। আম্মুর শরীর কেমন জিজ্ঞেস করলেন। মামনিকে তিনি খুব স্নেহ করেন জানি।
ভর দুপুর, মলিন মুখ, হাতে ধরা একটি জংধরা সাইকেল, সাইকেলের পিছনে দৈনিক পত্রিকা। মনে হলো, দুপুরে খাওয়া হয়নি। তাই পানি আনলাম সাথে বিস্কিট। বললাম, শুধু পানি খেতে নেই। কিছু খেয়ে পানি খান। আমিও তাই করি।
আমাদের বাড়ির বারান্দাটা বেশ ঠান্ডা। বললাম, একটু বসে যান। বাইরে প্রচন্ড রোদ সাথে তাপদাহ।
মনে হলো, এক টুকরো নিঃশ্বাসের ধাক্কা লাগলো আমার শরীরে। বড় বেশি ভারি কি মানুষের জীবন!
এই ছাতিফাঁটা গরমে জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসেও কতোটা কষ্ট করে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাচ্ছেন।
তাকে বসতে বলে, তার পাশে ফ্লোরে বসে পড়লাম। গরমে ফ্লোরেই আরাম করে বসলাম। আজ না হয়, বই না পড়লাম। জীবনের গল্প শুনি। কোনো লেখক বলেছেন, প্রতিটা মানুষের জীবন এক একটা উপন্যাস, এক একটা রহস্য গল্প। শুধু তাকে খুঁটিয়ে জানতে হয়। এতোদিন তার নামটা জানা হয়নি। আজ কেনো যেনো জানতে চাইলাম। যদিও, মা বয়ষ্ক মানুষের নাম জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করেছে। এটা আদবের মধ্যে পড়ে না বলে। তবু জিজ্ঞেস করলাম তার বাড়ি কোথায়, তার কি নাম। তার নাম রহিম, বাড়ি চরে।
আমার হাতের বইটা দেখে জিজ্ঞেস করলেন,”এতো গভীর ধরনের বই তুমি পড়ো!”
খেয়াল করলাম, তখনও আমার হাতে জওহরাল নেহরুর হিস্ট্রি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড বইটা। যেটা তিনি তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন।
আমি বললাম, আম্মু দিয়েছে এবার এটা পড়তে। তাই আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। আম্মুর নাকি বইটা খুব প্রিয়। কিন্তু পড়তে গিয়ে বুঝলাম, এটা মামনির চালাকি। আম্মু মূলত আমাকে এই বইটা পড়ার মাধ্যমেই পৃথিবীর জন্ম ইতিহাস থেকে পুরো ইতিহাস পড়ায়ে নিয়ে আসতে চাচ্ছে। বইটা বেশ চমৎকার। খুব সহজ করে ইতিহাস তুলে ধরা। আসলে তার কিশোরী মেয়েকে এই লেখার মাধ্যমে জ্ঞান দেওয়া আর কি। আমার নাকি এখন ওরকমই বয়স, তাই মামনির এই বুদ্ধি। আমার আম্মু এসব দিক থেকে খুব চালাক।
– মুক্তিযুদ্ধের বই পড়েছো?
-হুম, বেশ কিছু পড়েছি।
-আমি যুদ্ধ করেছি তোমার মতো এমন কিশোর বয়সে। অবশ্য তোমার থেকে আর একটু বড়ই হবো । নিজের জন্য, দেশের জন্য, নিজের মাতৃভূমির জন্য ভালোভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য যুদ্ধ করেছি। তখন তো অতোশতো বুঝতাম না। শুধু জানতাম তারা আমাদের চুষে খাচ্ছে, আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চাচ্ছে। সমস্ত সুযোগ সুবিধা ওরা ওদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। রেডিওতে শুনলাম মানুষ মেরে ফেলছে গুলি করে, ঘুমন্ত মানুষের উপরে গুলি করছে নির্বিচারে। কিশোর বয়সের সে রক্ত টগবগ করে উঠলো। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সে রক্ত আরো তেজি হয়ে উঠলো। কি ঘর, কি জীবন, চলে গেলাম ক্যাম্পে। কোনোরকম বন্দুক ধরে কেমন করে গুলি করতে হবে শিখে ঝাঁপিয়ে পড়লাম যুদ্ধে । সে যুদ্ধে মাথা উঁচু করে জয়ী হলাম ঠিকই। দেশ স্বাধীন হলো। একসময় পুরোপুরি গেরস্ত হলাম। এক ছেলে এক মেয়ের সংসার। কিন্তু দিন যেতে যেতে এক এক করে নদী সব গিলে খেলো। শেষ বসতবাড়িসহ ভিটের জমিটাও গিলে খেলো ব্রহ্মপুত্র নদী। জীবন যুদ্ধে নদীর কাছে হেরে গেলাম। নদীর এক কুল ভাঙ্গে এক কুল গড়ে মানে চর পড়ে, সে চর চলে যায় ভূমি ধখলদারদের হাতে। সে চরে ফসল ফলে, সে জমিতে কাজ করে সামন্য কিছু ফসল আসে আমাদেরই নদীভাঙ্গা মানুষের হাতে। কিন্তু আমি তা হাত পেতে নেই কি করে!
তাই সব ছেড়ে বুড়িটাকে( তার স্ত্রী) নিয়ে চলে এসেছি সরকারের খাস জমিতে।
বঙ্গবন্ধু যদি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতো, তবে নদীও হয়ত তার দিক পাল্টাতো না।, মরে যেতো না। ভারত থেকেও আমরা পানির ন্যায্য হিসেব পেতাম।
হঠাৎ নিরাবতা। আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ যেনো নিজেই শুনতে পাচ্ছি। নিরাবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, দুপুরে কি খেয়েছেন? বললেন, চিড়া গুড়।
বুড়ি তার পুঁটলিতে বেঁধে দেয় রোজ। আমি বললাম, আপনার সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। যদি কিছু মনে না করেন, অল্প একটু ভাত খান। বয়স হয়ে গেছে। অভিজাত অভিমানি মন তবু একটা শিশুর সরলতা এখনো আছে। তিনি মৌন সম্মতি জানালেন। ভিতরে গিয়ে দেখি মা গরমের জন্য ভাত বাদে অন্য সব খাবার ফ্রিজে রেখে দিয়েছে। আম্মুর শরীর ভালো না দেখে তাকে ডাকার সাহস হলো না। কোনোরকম একটা ডিম ভেজে ডাল নিয়ে আসলাম তার জন্য। তিনি সামান্য খাবারটুকু তৃপ্তি নিয়েই খেলেন।
জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেমেয়েরা কে কোথায়।
-ছেলেটা কোনোরকম ইন্টার দিয়ে ঢাকা একটা কোম্পানিতে। বিয়ে করেছে। তার এক ছেলে। তারও খরচের সংসার। ঢাকা শহর, কষ্টের শহর। বুড়াবুড়ির ভার তাই আর তাকে দেইনি। মেয়েটা আছে শশুর বাড়ি। নিত্য তার খোঁটা শুনতে শুনতে দিন যায়। বাপ নাকি মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তা কি করেছে শুনি? কতোজন তো কতোকিছুই পেলো! কতো কতো কথা!
একসময় নদী ভাঙ্গা শুরু হলে ভেবেছিলাম সার্টিফিকেটা নিয়েই নেই।
গেলামও ছুটে এলাকার মাতব্বরের কাছে। সে মাতব্বর যুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর দালাল ছিলো। আজ আমি তার কাছে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নিতে এসেছি! নাহ, সহ্য হলো না, বিবেক ধিক্কার দিলো।দৌড়ে পালিয়ে এলাম ঘরে। বউ আমার অপেক্ষায় আছে সে এক টুকরো কাগজের বিনিময়ে অনেক সুবিধা পাবে সেই আশায়।
চুপ করে রইলে যে খোকা?
– না, ভাবছি। ছোটো জীবন অথচ কতো তার পথ চলা। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি পড়াশুনা করেছেন।
– হুম, এক আধটু পড়েছিলাম আমাদের গ্রামের হাইস্কুল পর্যন্ত। তারপর পুরো গেরস্তে ঢুকে গেলাম বলে আর পড়াটা হলো না। তবে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু নদীভাঙ্গা ঠেকাতে গিয়ে আর সেদিকেও কুলিয়ে উঠতে পারলাম না।
কিন্তু এখন আমি পড়ি। দুইশো টাকা দিয়ে একটা লাইব্রেরী কার্ড করেছি পৌর পাঠাগারে। সকালে বাড়ি বাড়ি পেপার দিয়ে কোনোরকম খেয়ে ঢুকে যাই লাইব্রেরীতে। অনেকটা সময় বই এর সাথে কথা বলে ফিরে যাই বুড়ির কাছে। বুড়িকে বলি সে সব কথা। বুড়িটা আমার হাজার অসুখ, হাজার দুঃখেও সে সব কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। খাসজমির সে আমার অন্ধকার ঘর। কেরোসিনের বাতি শুধু খাওয়া পর্যন্ত জালিয়ে রাখে বুড়ি।
পৌর লাইব্রেরীতে প্রতিবছর বই পড়ার উপর একটা প্রতিযোগীতা হয়। বইটা পড়ে তুমি কি জানলে তার উপর। আমি প্রতিবারই প্রথম হই। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা একটা পুরষ্কার দিলো না। তাতের নাকি বাজেট নেই! বুড়িটা আমার অপেক্ষায় থাকে সে পুরষ্কারের। এখানেও বুড়িকে আমার প্রাপ্তিটা দেখাতে ব্যার্থ হলাম।
আত্নীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ নেই। খোটার ভয়ে বুড়ি আমার এখন সবার থেকে লুকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে সহ্য করতে না পেরে এক আধটু ঝড় তোলে শব্দের। বলে,”পোড়া কপাল আমার!” আমি চুপ করে থাকি।
গল্প করতে করতে দুপুরটা পার হলো। আম্মু উঠেছে মনে হলো। বললাম, চা খেয়ে যান আপনার আম্মার হাতের। আম্মুকে তিনি আম্মা বলে।
ভিতরে গেলাম। আম্মুকে বললাম চায়ের কথা। আম্মু বাইরে এসে দাদুকে সালাম দিয়ে চা করতে গেলেন।
খেয়াল করলাম যে সাইকেলটি করে তিনি পেপার বিলি করেন, সে সাইকেলটির সিট ছিঁড়ে গেছে একেবারে। জং ধরেছে প্রচুর। যেকোনো সময় সাইকেলটি তার ভেঙ্গে একটা এ্যাসিডেন্ট হতে পারে।
আমাদের দুই ভাই এর দুইটা সাইকেল। আমি তো কলেজেই থাকি। সাইকেলটাও আমার পড়ে থাকে। মনে মনে তীব্র ইচ্ছে হলো সাইকেলটি তাকে দেবার। আমি জানি আমার এ ইচ্ছাতে বাবা ও আম্মু খুশিই হবে। কিন্তু ভদ্রলোককে বলার সাহস পাচ্ছি না। কারণ, এতোক্ষণ তার সাথে কথা বলে মনে হলো, প্রচন্ড অভিমানী তিনি।
আম্মু চা নিয়ে আসলো। আম্মুর সামনে সাহস করে বলেই ফেললাম আমার সাইকেলটি তাকে নেবার জন্য। আম্মুও অনুরোধ করলেন। তাকে বোঝানো হলো যে, আমার সাইকেলটি পড়ে থাকে। একসময় আম্মুর জোর করে বলার কারনে নিতে রাজি হলেন। তার সাইকেলটি আম্মু ভ্যান ঠিক করে পাঠিয়ে দিলেন। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
গোধুলীও নামলো। সন্ধ্যার আযান কানে আসছে। তবু বসে আছি। জীবনের অনেক কিছুই এখনো বুঝে আসে না আমার।
কর্মগুনে সফলতা আসে আম্মু বলে। কিছু মানুষের একার কর্মে অনেক মানুষের ভালো হয়। এ মানুষগুলো ঠিক তেমন। আমি ‘কারমা’বিশ্বাস করি আম্মুর মতো। তুমি যা করবে তাতেই তোমার যে তৃপ্তি আসবে তাই তোমার সফলতা। তোমার নিজের তৃপ্তিই আসল।
হুম, তৃপ্তিই প্রাপ্তি।
সমাপ্ত।
জুহায়ের আফতাব মেমন
অষ্টম শ্রেণী
রংপুর ক্যাডেট কলেজ
রংপুর।
#এটা আমার বড় ছেলের লেখা গল্প। ওর অনুমতি নিয়েই গল্পটা প্রকাশ করলাম। ওর আরো কয়েকটা গল্প আছে। যদি পারি ব্লগে দিব। কারণ, ব্লগটা তো আমার আর এক পরিবার। ওর যাওয়া ও পড়া নিয়ে বেশ ব্যাস্ততা যাচ্ছে আসলে। পরশু চলে যাবে কলেজে। সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন। এবার বাবাটা আমার জেএসসি দিবে। আমার ছোটো ছেলেটা এবার ক্যাডেট কলেজ ভর্তি পরীক্ষা দিবে। সকলের কাছে আমার দুই ছেলের জন্য দোয়া চাই।
ভালো থাকুন সবাই।#
৬৭৯জন ৬৭৯জন
0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ