এই যে লিখছি, মনে হচ্ছে তেমন কিছুই না এভাবে লিখতে পারা, তাই না? এই আমার কাছেও এখন লাগছে, এমন কী আর ঝড় ছিলো! কিন্তু কী পরিমাণ টানাপোড়েন চলছিলো মন এবং জীবন জুড়ে, সেসব কিছু লিখতে গেলে বিশাল হয়ে যাবে। স্বস্তিহীন জীবন কাটানোর মতো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আর কিছু হতে পারেনা। যাক হ্যামিল্টনের জীবনযাত্রা সম্পর্কে সংক্ষেপে বলে নেই। সব লিখতে গেলে বিশাল হয়ে যাবে, তাই খুব হাল্কা আকারে লিখছি। আগেও বলেছি আমি টেনশন নিতে পারিনা। টেনশন এলেই আমার রক্তচাপ নেমে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। যেটা হ্যামিল্টনে আসার পর বেশ কয়েকবারই হয়েছিলো। অজ্ঞান হবার পরের মুহূর্তটা খুব ভয়ঙ্কর, লিখে বোঝানো যাবেনা। কেমন এক আতঙ্ক সবসময়, ভয় শুরু হয়, ভেতরে একেবারে শূন্যতা ছেয়ে যায়। তখন পাশে কেউ না থাকলে খুব অসহায় লাগে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই পাশে কেউ ছিলোনা। ডাক্তার বলেছিলো আমি এভাবে যতো বেশী অজ্ঞান হবো, আমার স্মৃতিশক্তি ততোই হ্রাস পাবে। একটা সময় ব্রেন আর সঠিকভাবে কাজ করবে না। তবে সুখের খবর হলো বহুবছর হয়ে গেলো আমি পুরোপুরিভাবে সুস্থ আছি। যাক সেসব কথা।
হ্যামিল্টনে এসে জীবনযাত্রার যথেষ্ট পরিবর্তন হলো। একেবারে নিজের সিদ্ধান্তেই এসেছিলাম। সেই সময় বন্ধু ঊর্মী যথেষ্ট সাহায্য করেছিলো বিভিন্নভাবে। নার্সিং-এ ডিপ্লোমার জন্য প্রচুর টাকার দরকার ছিলো। একেক স্কুলে একেক ফি। আমার কাছে সে পরিমাণ টাকা ছিলোনা। চলার জন্য সোনার অলঙ্কার বিক্রি করতে হলো। অবশেষে সরকারী স্কুলে সুযোগ পেলাম। ভর্তি হলাম সেন্ট চার্লসে। কোর্স চলাকালীন সবকিছুই ঠিক ছিলো, ইন্টার্নশিপের সময় ঝামেলা হলো সুপারভাইজারের সাথে। এমনই ঝামেলা আমি শেষ করতে পারলাম না। সে যে কী যন্ত্রণাদায়ক সময়! ভেতরে ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দুঃসময়ে পাশে যে কেউই থাকুক না কেন, অসহায়তা কেউ নিতে পারেনা। এতোকিছুর মধ্যে জীবন চলে যাচ্ছিলো। পরীক্ষা দেবার সময় মুখোমুখি হোলাম আবার অর্থসংকটের। ওই সময় বন্ধু শিল্পী সাহায্য করলো £৫০০ দিয়ে। পরীক্ষা শেষের পর কমিউনিটি ইন্টার্নিশিপ করতে হলো। ভাগ্যটাই এমন সেই সময়ই Ankle-এর Ligament ছিঁড়লো। সত্যি বলতে কী আমার শিক্ষক পলা ডিলন প্রতিটি পদে সাহায্য করে গেছেন। উনি না থাকলে এ জীবনে আমার ডিপ্লোমা নেয়া হতোনা। বললেন যেতে হবেনা, বিশ্রাম নিতে। কোর্স চলাকালীন সময়ে গ্রীষ্মের ছুটিতে সিনিয়র হোমে হাউজকিপারের কাজও করেছি। নাহ আমার খারাপ লাগেনি। কারণ আমার চোখে সততার সাথে উপার্জনে কোনো লজ্জ্বা নেই। যাক সার্টিফিকেট পেলাম। প্রথম ইন্টারভিউতেই চাকরী হয়ে গেলো। জানেন চাকরী কনফার্ম হবার পর কি শুনেছি আমি? এ আর এমন কি! এমন চাকরী নাকি সকলেই পায়। মজা হলো কোর্স শুরুর আগে ভর্তির সময়েও এমনই কথা শুনেছি, কানাডায় স্কুলে ভর্তি হওয়া কোনো ব্যাপারই না, সকলেই পারে। কষ্ট পেয়েছিলাম কথাগুলোতে, তাই মনে থেকে গেছে। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, কথাগুলো দিয়েই মানুষের চরিত্রকে চেনা যায়। আমি চিনতে দেরী করেছি, কিন্তু চিনেছি তো!
এই চাকুরী আমার জন্য শুধু অর্থ উপার্জনের পথ ছিলোনা, এর মধ্যে আমার আবেগও ছিলো। এতোটাই ভালোবেসে ফেলেছিলাম এই চাকুরিটাকে। কিন্তু জীবন আমাকে আরোও অনেক নতুন কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে, তখন পর্যন্ত ভাবিনি। তবে ভাবনার বাইরেরটুকুই আসলে সত্যিকারের জীবন, যে জীবনের মুখোমুখি হওয়া খুব কঠিন। যারা ওই কঠিনকে আগলে নিতে পারে, তারাই জয়ী হয় জীবনে। আর একটা কথা সবসময় মনে রাখতে হবে যে কোনো অবস্থায়, বিপদের সময় যে পাশে থাকে তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ, তাই বলে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নয়। আমার চরিত্রের একটা বিশেষ দিক হলো যে কোনো সমস্যা সামনে এলে অস্থির হয়ে পড়িনা। ভেতরে ভেতরে যে অস্থিরতা কাজ করেনা, তা অবশ্য নয়! কিন্তু বাইরে আমি খুব শক্ত থাকি। কেউ সেটা বোঝেনা। এই অভ্যাসটা আমি শিখেছি নিজের থেকেই। আমার কাছের মানুষদের সবসময়ই বলি সমস্যা নিয়ে অস্থির না হয়ে, শান্তভাবে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করতে। যদিও সবাইকে দিয়ে সবকিছু সম্ভব না, কিন্তু অসম্ভবও কী? “কর্ম করে যাও, ফলের আশা করোনা”—শ্রীমদ্ভগবতগীতার এই বাণীকে আমি গ্রহণ করেছি। আগে থেকেই যদি আমরা ভেবে নেই নাহ আমায় দিয়ে এ হবেনা, তাহলে হবেই না। আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে নিজের পথ তৈরী করে নিতে হয়, তাহলে অন্তত মেঘের কাছে পৌঁছানো যায়। মেঘের দিকে দৃষ্টি রাখলে বৃষ্টিই পাওয়া যাবে। তা বলে মনুষ্যত্বকে দুমড়ে মুচড়ে, মানুষকে ব্যবহার করে আকাশের দিকে হাত বাড়ালে একদিন মাটিতেও জায়গা হবেনা।
★ভেবেছিলাম এই পর্বেই শেষ করে দেবার। কিন্তু লেখাটা বিশাল হয়ে যাওয়াতে এই পর্যন্তই রাখছি। বর্ণনা সংক্ষিপ্ত করে লিখছি। পরের পর্বটি দিয়ে সমাপ্ত হবে।
লিঙ্ক –
এক – জীবনে কঠিন চাপ এবং বিষণ্ণতার সাথে জয়ী হওয়া
দুই – জীবনে কঠিন চাপ এবং বিষণ্ণতার সাথে জয়ী হওয়া – পরীক্ষার ফলাফল
তিন – জীবনে কঠিন চাপ এবং বিষণ্ণতার সাথে জয়ী হওয়া – দায়িত্বশীলতা
হ্যামিল্টন, কানাডা
১১ ডিসেম্বর, ২০১৭ ইং।
১৬টি মন্তব্য
মৌনতা রিতু
জীবনে এমন সব সময়ে পাশে দাঁড়ানোর মানুষ খুব কমই পাওয়া যায়।
কষ্টকরে পাওয়া কোনো সাফল্যকে এমন অনেকেই বলে ফেলে,এটা পাওয়া কোনো ব্যাপারই না। আসলে কি জান তো! তারা সেটা পেতে চায়, কিন্তু পায় না তাই বলে ফেলে। সৎভাবে উপার্জন করা কোনো কাজই ছোটো না।
তুমি অনেক সাহসি এবং ধৈর্য্যশীল। জান আপু, মানুষের হৃদয়ভার কেউ বইতে পারে না।
কিন্তু ঐ যে বললে না, এই যে লিখতে পারছি, এ আবার কঠিন কি! আপু, এই লেখাটাই বা কতোজন লিখতে পারে। লিখতেও ঘিলু লাগে।
আমি জীবনে কঠিন চাপগুলোতে ভেঙ্গে পড়ি না। আমার সাহস আমার দুই ছেলে। আমার একটাই চিন্তা, তাদের মানুষ করতে হবে।
ভাল থেকো আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু আমার সাহস আবার আমি নিজেই। সন্তান নয়! সন্তানের সাহস হয়ে থেকো।
অনেক ভালো থেকো।
ইঞ্জা
আপু, আপনি অনেক সাহসী ও ধের্য্যশীল, এমন সব বিপদ আপনি পাড়ি দিয়ে আসছেন যেমন আমি দিয়ে আসছি, আপু আমার জীবনের গল্প প্রায় আপনার মতোই, এরপরেও বলবো আপনার ইচ্ছা শক্তি প্রবল, এবং এই শক্তিকেই পুঁজি করে এগিয়ে চলুন আগামীর জন্য।
নীলাঞ্জনা নীলা
ভাইয়া একা যখন ক্যান্সার হাসপাতালে গেলাম, ডাক্তার দেখে চমকে গেলো। আমার সাথে কেউ নেই।
হুম আমার মনের জোর খুব বেশী। ভেঙ্গে গিয়েও ভেঙ্গে পড়ে নেতিয়ে যাইনা।
অনেক ভালো থাকবেন।
মোঃ মজিবর রহমান
জীবন মানেই সংগ্রাম, সংগ্রাম মানেই জীবন— হিটলার। আর এখানে যে যেখানে জীবন যে রকম সেভাবেই চলা উত্তম।
নীলাঞ্জনা নীলা
মজিবর ভাই চমৎকার মন্তব্য।
খুব সুন্দর বলেছেন।
ভালো থাকুন।
তৌহিদ ইসলাম
আপনার পরিশ্রম স্বার্থথক হয়ে উঠুক এই কামনা করি। তবে যারা পিছনে কথা বলে তারা জেলাস ফিল করে তা বলে। আর ভালো কিছু করলে এসব এক আধটুকু হবেই আপু। সুন্দর প্রকাশ।
নীলাঞ্জনা নীলা
ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
ভালো থাকবেন।
জিসান শা ইকরাম
তোর এই লেখাগুলো পড়ে আমি প্রেরনা পাই।
কিভাবে এত চাপ নিয়ে সমস্ত কিছু কাটিয়ে উঠে যাও, অবাক বিষ্ময়ে তা ভাবি।
ভাল থাকিস সারাক্ষন।
নীলাঞ্জনা নীলা
নানা জীবনে একবার ভেঙ্গে পড়লেই আর উঠে দাঁড়ানো যায়না। তাই সবচেয়ে সহজ উপায় ভেঙ্গে যাবার আগেই নিজের মনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরা।
ভালো থেকো নানা।
আগুন রঙের শিমুল
আপু
দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে।
সংখ্যাযোগ
॥ ২-৫৬॥
চেষ্টা করি, অসামাজিক হিসাবে সামান্য দুর্নাম হইছে, কিন্ত ভালো আছি 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
অসামাজিক হিসেবে দুর্নাম করলোটা কে?
কার এতো সাহস!
শ্লোকটি পছন্দের।
ভালো লাগলো।
ছাইরাছ হেলাল
অপেক্ষায় রইলাম!
নীলাঞ্জনা নীলা
অপেক্ষা শেষ হয়নি? 😀
ছাইরাছ হেলাল
হইছে তো!
নীলাঞ্জনা নীলা
তাইলে কই!?