জীবনে প্রথম ধাক্কা খাই এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে। খুব ভালো ছাত্র ছিলাম না, কিন্তু একেবারে খারাপও ছিলাম না। গণিতে লেটার পেয়ে সেকেন্ড ডিভিশন, একেবারে মুষড়ে পড়েছিলাম নিজের ভেতর। স্বপ্ন ছিলো মেডিক্যালে পড়ার, যাক ইন্টারেও ধাক্কা খেলাম। বারোশো নম্বর হলোনা। মনে আছে মামনির বান্ধবীর মেয়ে, (নামটা মনে হয় লাভলী আপু, ঠিক মনে করতে পারছিনা), উনি গোলাপ ফুলের বিশাল বড়ো তোড়া নিয়ে এলেন। এসেই জড়িয়ে নিয়ে যে কথাগুলো বলেছিলেন, আমার জীবনে ওই কথাগুলো প্রতিটি মুহূর্তে কাজে লাগিয়েছি। আমাকে বললেন “আপু মন খারাপ করবেনা। যা হয়েছে, জীবনে আরোও অনেক কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হবে। So you should make yourself act properly. There is two options in our life. Make your own decision or take others decision. You have a wonderful brain and heart, so don’t ruin your life. তোমার এই রেজাল্টে কে কি বললো, না বললো don’t care, just care for your own life. আপু জানো আমিও এমন অবস্থার ভেতর দিয়ে গেছি? এই কথাগুলো আমাকে কেউ বলেনি, নিজেই নিজেকে বলেছি। বুঝিয়েছি।” আমি আপুর মুখটার দিকে চেয়ে রইলাম। নিজেকে তখন দেখলাম আমার স্বপ্ন পরাজিত হয়নি, বরং আরেকটি নতুন পথ তৈরী হয়ে গেছে।
ঢাবিতে সুযোগ পেলাম, ভাগ্য খারাপ ভাইবা দিতে পারলাম না। সেই ধাক্কা থেকে নিজেকে উঠিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলা নিয়ে পড়বো। আত্মীয়-স্বজন আহা উহু করে উঠলো। কান দিইনি। পাশ করলাম, কলেজে চাকরী করলাম। এই কলেজে চাকরী পাবার পরে যে শিক্ষক বলেছিলেন আমায় দিয়ে কিছুই হবেনা, উনার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, স্যার আমাদের ডেজিগনেশন এক, শুধু পার্থক্য আপনি সিনিয়র, আর আমি জুনিয়র শিক্ষক। এখনও কেউ কেউ বলবে কেন যে বাংলা নিয়ে পড়েছি, দেশের বাইরে এসে কিছুই কাজে লাগলো না। আমার খারাপ লাগেনা। কারণ দেশের বাইরে এসে আমি ভিক্ষা কিংবা চুরি করে আয় করছিনা অথবা দুই নম্বরী করে চাইল্ড বেনিফিট বা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া চাকরী করে সরকারের পয়সা মেরে খাচ্ছিনা।
আপনারা ভাবছেন এসব এমন আর কী! এ আর এমন কী ধাক্কা! এর থেকেও অনেক বড়ো ধাক্কা মানুষ পায়। হুম এসব কোনো ধাক্কাই নয়। তবে রেজাল্টের পরে প্রচুর ছেলে-মেয়ে আত্মহত্যা করে। কেন করে? কারণ তারা তখন নিজেকে দেখেনা, অন্যদেরকে দেখে। আমি এসএসসি পরীক্ষা দ্বিতীয়বার দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছিলাম। প্রথমবারের শেষ পরীক্ষার দিন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ায় পরীক্ষা দিতে পারিনি। আমার মাসতুতো দুই ভাই ওদের ফলাফল নিয়ে এলো, প্রথম বিভাগ পেয়েছে। আর আমি কিনা রান্নাঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে আছি। না কাঁদতে পারছি, না হাসতে। মনে হচ্ছিলো এ জীবন আর নয়, কেন বেঁচে আছি! সে যে কতো যন্ত্রণার! ভেঙ্গে না পড়ার মতো কী ছিলো সেটা? মোটেও না। অনেক যন্ত্রণা হয়, যার ঔষধ কেউ দিতে পারেনা। কিন্তু ভাগ্য ভালো কলেজে ভর্তি হোলাম, এতো ভালো বন্ধু পেয়েছিলাম, আজও তারা আমাকে ছেড়ে যায়নি। ভাগ্যিস প্রথমবার অসুস্থ হয়েছিলাম, তা না হলে তো স্কুলে যেমন একা থাকতাম, কলেজেও একাই থাকতে হতো।
ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলছি, জীবনে পাশ-ফেল দুটোই আছে। যখন মনের মতো ফলাফল পাওয়া যায়না, তখন কাউকে নয়, যেনো তারা নিজেরা নিজেকে দেখে। কারো বিদ্রূপাত্মক কথাকে কানে না লাগানোর শক্তিটুকু তৈরী করার একমাত্র উপায়, বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করা। যদি বাবা-মাও সঙ্গত্যাগ করে, তাহলে মন খারাপ না করে তাদের জায়গায় নিজেকে বসানোর চেষ্টা করতে হবে। সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভব নয়। বাবা-মায়ের রাগ উঠেছে, বকছে, কারণ তারা সন্তানের কষ্টে অনেক কষ্ট পাচ্ছে। তাই বলে যদি নিজেকে মেরে ফেলি, তাহলে বাবা-মায়ের সেই কষ্ট লাঘব আস্ত জীবনেও শেষ হবেনা। “থ্রি ইডিয়টস” মনে আছে? বাবা বলছিলো, ইঞ্জিনিয়ার হতে না পারলে কে কি বলবে! ফারহান আর তার বাবার সেই মুহূর্তের কথোপকথন আমার মনে প্রচন্ড দাগ কেটেছে। আমি মোটেও উপদেশ দিচ্ছিনা, নিজের জীবনে যা যা ঘটেছে, সেসবই লিখছি আমি। একবার ফেল করলেই জীবন শেষ, একেবারেই ভুল কথা। আমাদের গন্তব্য নিজের পায়ে দাঁড়ানো। সে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সরকারী চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ইত্যাদি বহুভাবেই আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি নিজেকে। মেডিক্যালে সুযোগ হলোনা, অন্য পথ আছেই। মানুষ বলবে “হায় হায় এই মেয়েটা/ছেলেটা পারলোনা ভর্তি হতে?” যখন আপনি ডাক্তার হবেন, তখন তারা বলবে, “দুই নম্বরী পয়সা বানিয়েছে ভালোই। ডাক্তার তো না, যেনো কসাই।” হুম তাদের কাজই হলো নেগেটিভ বলা। অন্যের গ্রহণযোগ্য সমালোচনার দিকে খেয়াল রাখা উচিৎ, দুই নম্বরী মানুষের কাজই হলো খোঁচা দেয়া, বিদ্রূপ করা। এসব বিদ্রূপাত্মক কথা থেকে নিজেকে উঠিয়েছি শুধু মনের জোরে। কাউকে কেয়ার করিনি। আমি একটা কথা নিজেকে বারবার বলি, “যদি তুমি সৎ থাকো, কাউকে কেয়ার করোনা।” পরীক্ষায় পাশ-ফেল কিছু না, আমাদের গন্তব্য সততার সাথে নিজের পায়ে দাঁড়ানো। যারা ভালোবাসে, তারা কখনো নেগেটিভ কিছু বলেনা। বরং সাহস যোগায়, পথ দেখায়।
হ্যামিল্টন, কানাডা
২০ নভেম্বর, ২০১৭ ইং।
১০টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
হ্যাঁ আপু, আমিও এইচ. এস. সি পরিক্ষা খারাপ হয়াতেই আমাকে পরিক্ষা হলে যাওয়ার টাকা দেওয়া বন্ধ হল। পরিক্ষার দিন বসে ভাবছি কিভাবে যাব( ঐ মুহূর্তের অবস্থা ভাষায় লেখা আমার সম্ভব না।) । যাক এক ফ্রেন্ডের সাইকেলে গেলাম। পরের পরিক্ষা দিলাম । রেজাল্ট জথারিতি ফেল। কারন ইংরেজি বাদে সব ক্যাল্কুলেশন আমার প্রায় মিলে যায়। কারন পরিক্ষার খাতায় লেখাতেই আমি নিশ্চিত ছিলাম ফেল। তাই পূর্বে থেকেই ব্যারথতার ভাগ বহন করতে শুরু করেছিলাম।
পরের বছর পাশ করেছিলাম ।
কষ্ট আর কষ্ট কেউ ভাগ নেয় না। তবে আনন্দের বিষয় তিন ফ্রেন্ডের ৩ অধমই ফেল। তবে কষ্ট বেশি যে ৯ গ্রেস দিলেও আওতায় আসি নাই। তাও পাশের হার ছিল খুব কম তাই গ্রেস দেওয়া হয়েছিল। এখন অধম আছি সৃষ্টিকর্তার রহমতে ভালই।
নীলাঞ্জনা নীলা
মজিবর ভাই এখানে এসে যখন নার্সিং-এর জন্য ইংরেজী টেষ্ট দিতে হলো। আমি নিশ্চিত ছিলাম ফেল করবো। কারণ ইংরেজীর সাথে যোগাযোগ ছিলোনা বহুদিন। প্রথমে জাপানে, সেখানে নিহঙ্গ ভাষা। তারপর বেলজিয়ামে, সেখানে ফ্রেঞ্চ। অবশেষে এলাম কানাডাতে। আমি আমাকে অবাক করে দিয়ে B+ পেয়ে গেলাম। তারপর গিয়ে স্কুলে ভর্তি হলাম। যদি সেই এস.এস.সি’র সেই ফলাফলকে নিয়েই ভেঙ্গে পড়তাম, আমায় দিয়ে নার্সিং সার্টিফিকেট পাওয়া হতোনা। “একবার না পারিলে দেখো শতবার।”
ধন্যবাদ আপনাকে মজিবর ভাই।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনাকেও ধন্যবাদ নীলাদি।
নীলাঞ্জনা নীলা
মজিবর ভাই নতুন লেখা দিয়েছি।
ভালো থাকুন।
রেজওয়ান
পড়াশুনায় আমি অনেক ফাকি দিয়েছি। খারাপ রেজাল্ট করেছি বেশ কয়েকবার। ক্লাশ নাইন থেকে টেন এ উঠার সময় আমার বড় কাকা বাবা-মা’য়ের সামনে বেত দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিলেন বাংলা ২য় পত্র,কৃষি ও ধর্মে ফেল করার কারনে কিন্তু বাবা কিছুই বলেন নি কাকা কে। অনেক জিদ হয়েছিলো। বাসা থেকে পালিয়ে ছিলাম। অংক ও ইংরেজিতে ৮৫+ থাকার কারণে হেডস্যার টেন এ প্রমোশন দিয়েছিলেন। বাসার বাহিরে থেকেই পরীক্ষা দিয়েছিলাম এবং ৪.৮০ নিয়ে পাশ করেছিলাম। \|/
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি যদি সিরিয়াসলি পড়ালেখা করতাম, তাহলে আজ অনেক উঁচু অবস্থানে থাকতাম। কী যে ফাঁকি দিয়েছি! পড়ার বইয়ের ভেতর গল্পের বই নিয়ে পড়েছি। বাপির পায়ের আওয়াজ শুনলেই অঙ্ক করা শুরু করতাম। আমি তো বলতে গেলে পড়তামই না। একেবারে অল্পের জন্য প্রথম বিভাগ পাইনি। তাতে কী হয়েছে? বিশাল সার্টিফিকেট নিয়ে কি হবে? যদি না মনটাই বিশাল হয়!
আপনি অনেক মেধাবী। আর মেধা সকলের থাকেনা।
ভালো থাকুন।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
হুম বুঝলাম আমরাও এর বাহিরে নই শুধু গুছিয়ে লিখতে জানি না।বর্নালী এ জীবন চলার অঙ্গ পতঙ্গ সবিই ক্ষণস্থায়ী জীবনকে যতদূর সম্ভব টেনে নেয়া আর কি। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
মনির ভাই বেশ কিছু গান আমাকে সবসময় পথ দেখিয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো “নাই নাই ভয়, হবেই হবে জয়।” নিজেই নিজের সাহস তৈরী করে নিতে হয়। তবেই না জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়।
ভালো থাকুন। -{@
শাওন এরিক
মনে খুব দাগ কেটে গেলো আপু।
আপু আবার লিখুন, আপনাকে মিস করি। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
হুম আবার এসেছি। লিখবো।
কেমন আছেন?
ভালো থাকুন।