ছোটবেলা থেকেই খেলাধূলার প্রতি ভীষন ঝোঁক ছিলো আমার। বড় আপুরা যখন রান্নাবাটি খেলতো সেসময় খুব ছোট ছিলাম বলে আমাকে সেভাবে ওদের খেলায় নিতোনা। একটু বড় হবার পর বড় আপুদের বিয়ে হয়ে যাবার কারনে মেয়েদের খেলা আর সেভাবে খেলা হয়নি। তখন শুধুমাত্র এক চাচাতো বোন আর আমি এই দুইজনই ছিলাম মেয়ে আর অন্যদিকে আমার ছোট ভাইসহ সমবয়সী আরও তিন চাচাতো ভাই মিলে ওরা চারজন ছিলো ছেলে, ওদের সমবয়সী আশেপাশের প্রতিবেশী আরও দুইতিনটা ছেলেও আসতো আমাদের সাথে খেলতে। যেহেতু ছেলেদের সংখ্যা ছিলো বেশি তাই ছেলেদের খেলাগুলোই প্রাধান্য পেতো। আমরাও ওদের সাথে ওদের খেলাগুলোই খেলতাম। মার্বেল, ডাংগুলি, লাটিম, ক্রিকেট, দাবা, ক্যারাম, লুডু এই খেলাগুলোই বেশি খেলতাম। এমনকি বিয়ের আগে পর্যন্ত এই খেলাগুলো খেলেছি। বিয়ের পর দাবা, ক্যারাম আর লুডু ছাড়া বাকি খেলাগুলো হারিয়ে যায়। কোন খেলাই যে খুব একটা ভালো পারতাম তা না। কিন্তু যাই খেলতাম খুব মনোযোগ দিয়েই খেলতাম (এটা আমার স্বভাবগত, আমি যাই করি তা মনোযোগ দিয়েই করি, তা হোক খেলা, পড়া কিংবা অন্যকোনো কাজ)।
যাইহোক, বিয়ের পর যখন বাড়িতে যেতাম তখন সন্ধ্যার পর মা, চাচী এবং চাচাতো ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা মিলে লুডু খেলতাম। বেশিরভাগ সময় চাচিদের ঘরেই লুডু খেলা হতো। যদিও হাসি ঠাট্টার মধ্যেই খেলা হতো হার জিত যে কেউই মেনে নিতো কিন্তু মা ছিলো ব্যতিক্রম। মাও হাসি ঠাট্টার মধ্যেই খেলতো তবুও জিতলে খুব খুশি হতেন কিন্তু হারটা ঠিক সেভাবে মেনে নিতে পারতেননা। পরে খেলাটা নিয়ে মাকে বারবার বলতে দেখেই আমি তা বুঝতে পারতাম…তাই মা যখন খেলতো তখন আমি মনে মনে চাইতাম মা জিতুক। কিন্তু মা খুব কম সময়ই জিততো, বেশিরভাগ সময়ই চাচি জিততো। কিভাবে যেন এটা হয়ে যেতো। একদিন মায়ের সাথে খেলে মাকে হারিয়ে আমি জিতে গেলাম। মা বোধহয় এতে অপমানিতবোধ করলেন। পরদিন সকালে নাস্তা খাবার পর মা বললেন মা আমার সাথে লুডু খেলবেন। ঠিক আছে খেলতে শুরু করলাম। মা তো অবশ্যই সিরিয়াস, আমিও সিরিয়াস। ৮টা করে গুটি নিয়ে খেলতে বসেছি। আমার কয়েকটা গুটি আগেই উঠে গেলো, এরপর মায়ের যে গুটি ওঠে আমি সেটাই কেটে দেই। এভাবে হতে হতে আমি জিতে গেলাম আর মা হেরে গেলো। মা আবারো খেলতে চাইলো, আবারো খেলা শুরু হলো, আবার সেই আগের অবস্থা মায়ের গুটি গুলো একে একে কাটা পড়ছে। মা আবারও হেরে গেলো। মায়ের কাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে তবু মা না জিতে উঠবেনা এমনই জেদ থেকেই বোধহয় মা আবারো খেলতে চাইলো। আবার খেলা শুরু হলো। এবার মায়ের অবস্থা আগের চাইতে আরও বেশি করুণ। মায়ের মুখে হাসি নেই খুবই গম্ভীর। বুঝতে পারছিলাম মা রেগে যাচ্ছেন। মায়ের অবস্থা দেখে খারাপ লাগছিলো কিছুটা ভয়ও পাচ্ছিলাম কিন্তু আমারতো কিছু করার নেই, আমিতো এমনি এমনি জিতিয়ে দিতে পারিনা, আর মাও তা নিবেনা। খেলা চলছে, মায়ের সবগুটি কাটা পড়ছে। এভাবে চলতে চলতে একসময় মা লুডুর গুটিগুলো এলোমেলো করে বোর্ড টা ছুঁড়ে মারলেন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বড় ছেলে সৌমিকের গায়ে গিয়ে সেটা পড়লো। সৌমিক তখন খুব ছোট ছিলো, সম্ভবত তিন বছর ছিলো বয়স, সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো। মা নিজের কাজের জন্য লজ্জা পেলেন। সৌমিককে কোলে নিয়ে ওর ভয় দূর করতে চেষ্টা করলেন। এরপর মা যতদিন বেঁচে ছিলেন মাঝে মাঝেই এই ঘটনার কথা বলে লজ্জা পেতেন এবং অনুতপ্ত হতেন। সেই ঘটনার পর মাঝে মাঝে আমিও ভাবতাম সেদিন আমি যদি অতটা সিরিয়াস না হতাম তাহলে হয়তো মা জিতে যেতো, কেন তা করিনি!!! আজ মা নেই, তবু আজও ভাবি, কেন তা করিনি, কেন একবার মাকে জিততে দেইনি!!! (-3
১১টি মন্তব্য
ইঞ্জা
আপু, মারা অভিমানীই হোন কারণ উনারা সন্তান সংসারের জন্য যা করেন তার বিনিময়ে বলতে গেলে কিছুই পাননা, আপনিও মা হয়েছেন, এক সময় আপনিও এই বিষয়টি বুঝবেন, মার জন্য দোয়া রইল যে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মাকে যেন জান্নাতবাসী করেন, আমীন।
শাহানা আক্তার
বুঝি ভাইয়া…মায়ের অনুভূতিগুলো এখন সবই বুঝি…
ইঞ্জা
শুভকামনা আপু
মোঃ মজিবর রহমান
মা। মা যাইহোক মা। আপু মা আমারও চলে গেছে জানিনা কেনও গত রাতে খুব কেদেছি মা-বাবা স্মরণ করে। মাঝে আপনার ভাবি টের পেয়ে উঠে এসে বলে কাদছ কেন? কোন জবাব দিতে পারি নাই মাকে মনে হই খুব কষ্ট দিয়ে সেবা ভাল ভাবে করতে পারিনি।
অপারের সকল মা -বাবা বেহেস্তে বাসী হোক। আমীন।
শাহানা আক্তার
মা নেই এটা আমি মনেইই করতে চাইনা…ছোট বাচ্চাদের মতো মনকে বুঝিয়ে রাখি সবসময়…
মোঃ মজিবর রহমান
পারিনা মনের অজান্তেই মনে মনে কেদে ফেলি। মেয়ে চেয়ে দেখে কাদছ কেনো ? কোন উত্তর নাই বলি নাতো।
নীলাঞ্জনা নীলা
মায়ের আত্মা শান্তলাভ করুন।
আসলে মা হবার পর গিয়ে বুঝেছি মায়েরা কি!
লেখাটি পড়ে মন ভিঁজে গেলো।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
অতীত মনে করে দিলেন।এমনি অতীতে আমরা আছি।খুব সরল ভাষায় লেখা পড়ে খুব ভাল লাগল।
শুন্য শুন্যালয়
ছোটবেলায় আব্বা আর আম্মাকে দাবা খেলতে দেখলাম দুজনের মাঝে বসে। সুন্দর শুরু এবং প্রতিদিন শেষ হতো দাবার কোট ছিড়ে। 🙂
আপনার আম্মার মতো এই জেদ আমারো ছিলো তবে রেগে যেতাম না অবশ্য, জিতে শেষ করতাম। খেলাধুলা শুধু এন্টারটেইনমেন্ট নয়, এটা মানুষের স্বকিয়তা বের করে আনে, দেখুনই না খেলা নিয়ে কতো তুলকালাম কান্ড ঘটে যায় মাঠে তাই আপনার জিততে চাওয়াও ভুল ছিলোনা। এসব ভেবে মন খারাপ করতে নেই। মা এর জন্য অনেক দোয়া রইলো, তিনি ভালো থাকুন ওপাড়ে।
আপনার স্মৃতিটা স্পর্শ করলো আপু, আপনিও ভালো থাকবেন।
মেহেরী তাজ
দাবাতে হারলে মনে হয় চর্চার অভাব,চালের ভুল কিংবা অন্যকিছু। কিন্তু লুডুতে হারলে মেজাজ চরম খারাপ লাগে…..
নীহারিকা
আমার আম্মা দাবা খেলায় পটু। আমার মেঝ চাচা আরো বেশি। দুজনে খেলতে বসলে খেলা আর শেষ হয় না। কারোরই না জিতে উঠে আসা পোষায় না। খেলার ভেতরে ঢুকে গেলে হয়তো এমনই হয়।
মা’র আত্মা যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।