কাছের আকাশ

শিপু ভাই ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ০৬:৩৫:২৫অপরাহ্ন গল্প, সাহিত্য ২৪ মন্তব্য

“ভালো করে তাকাও। পাশাপাশি তিনটা তারা দেখতে পাচ্ছো?” মাহবুব খুব উতসাহ নিয়ে লুবনাকে টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ দেখাচ্ছে বাসার ছাদে। মাহবুবের স্ত্রী লুবনা আর ওর বিবাহবার্ষিকী ছিল গতকাল। এই টেলিস্কোপটা গিফট করেছে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী মাহবুব আমিন। অত্যন্ত দামী এই টেলিস্কোপটা আমেরিকা থেকে আনিয়েছে। বিয়ের পর এটাই প্রথম এনিভার্সারি।ডিসেম্বরের এই শীতের রাতে লুবনাকে ছাদে এনে টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশের অপার্থিব সৌন্দর্য দেখাচ্ছে।
“হ্যা, এটা হল অরিয়ন অর্থাৎ কালপুরুষ মন্ডল। একজন পৌরাণিক যোদ্ধার কল্পিত রুপ। এই তিনটা তারা হল যোদ্ধার কোমরের বেল্ট। দেখতে পাচ্ছো!?
– হ্যা, খুব সুন্দর!
– হ্যা, এই তিনটা তারার নাম হল আর্দ্রা, বানরাজা আর কার্তিকেয়।…..
– ওয়াও!
– এবার এই হাতলটা ধরে টেলিস্কোপটা উত্তর দিকে তাক করো…হ্যা হ্যা ব্যাস…এবার চোখ রাখ এখানে।
টেলিস্কোপে আবারো চোখ রাখে লুবনা। ওর খুব শীত করছে। কিন্তু মাহবুবের আনন্দটা মাটি হবে তাই কিছু বলছে না।
– দেখো প্রশ্নবোধক চিহ্নের মত সাতটা তারা। খালি চোখেও বোঝা যায়। সবচেয়ে পরিচিত এটা। গ্রেট বিয়ার। বাংলায় যাকে বলে সপ্তর্ষিমণ্ডল। ”
স্ত্রীকে নিজের প্রিয় বিষয়ে লেকচার দিতে খুব ভাল লাগছে মাহবুবের।
“এই সাতটা তারা দিয়ে একটা ভাল্লুক আঁকা যায়। এর নামগুলোও খুব সুন্দর।”
– তাই!? কী নাম তারাগুলোর?
অনিচ্ছাসত্ত্বেও জিজ্ঞেস করে লুবনা।
-ক্রতু
পুলহ
পুলস্ত্য
অত্রি
অঙ্গিরা
বশিষ্ঠ
মরীচি
-বাহ, দারুনতো!
লুবনার রেস্পন্স দেখে মাহবুবের উতসাহ বেড়ে যায়। ও এই নামগুলোর ব্যাখ্যা দিতে শুরু করে। লুবনা কিছুই শুনতে পায় না। মাহবুবের মুখের দিকে তাকিয়ে ও এক বছর আগের কথা ভাবছে।
ছেলে নাসার বিজ্ঞানী। খুবই ব্রিলিয়ান্ট। উপার্জন ভয়াবহ রকমের ভাল। দেখতেও দারুন হ্যান্ডসাম। তাই বাবা মায়ের লক্ষি মেয়ে লুবনা বিয়েতে কোন আপত্তি করেনি। কিন্তু এই লোক শুধু বোঝে বিজ্ঞান আর মহাকাশ। সংসার, প্রেম ওর জন্য না। প্রচুর ব্যস্ত থাকে সবসময় আর হুটহাট বিদেশ যেতে হয়। প্রেমিক না হলেও লুবনার প্রতি মাহবুব খুবই আন্তরিক। বিদেশ থেকে আসার সময় প্রতিবারই সুন্দর সুন্দর জিনিস নিয়ে আসবে। লুবনার সাথে কথা কম বলে কিন্তু যেটুকু বলে খুব সুন্দর করে বলে। কিন্তু এই লোক প্রেম বোঝে না। চাঁদের নাড়ি নক্ষত্র তার মুখস্ত কিন্তু জোসনা বুঝে না। পূর্নিমা মানেই ওর কাছে ফুল মুন। উল্কা বৃষ্টি নিয়ে যতটা আগ্রহী সেই তুলনার বর্ষার বৃষ্টি নিয়ে ততই বিরক্ত। কারণ মেঘলা আকাশে টেলিস্কোপ অকার্যকর। লুবনাকে এই দামী টেলিস্কোপ না দিয়ে যদি একটা ফুল দিত অথবা সাথে নিয়ে বাইরে কোথাও খেতে যেত দুজনে হয়তো ক্যান্ডেল লাইট ডিনার!!! কিন্তু এসব মাহবুবের কল্পনাতেও নাই। এই তারা না দেখিয়ে মাহবুব যদি ওর দুই হাত ধরে বসে থাকতো তাহলে বেশি খুশি হত ও। কত রাত বিছানায় শুয়ে চাতক পাখির মত অপেক্ষা করেছে স্বামীর আদরের জন্য কিন্তু সে বেচারা সারারার নিজের গবেষণায় মত্ত। এই এক বছরে ওরা খুব কম সময়ই একান্তে কাটিয়েছে। বিছানায়ও মাহবুব বেশ রোবটিক। লুবনা না হলে হয়তো সংসারই টিকতো না। কিন্তু এই মেধাবী লোকটাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছে লুবনা। কারণ মাহবুব একজন ভাল মানুষও। লুবনার বার্থডে ভুলেগেছিল এবার। তাই এনিভার্সারি মনে রেখেছে কোন উপায়ে।
“অঙ্গীরা হল…..” মাহবুব বলেই চলছে। লুবনার উপস্থিতিও যেন ভুলে গেছে। লুবনা হঠাত মাহবুবকে জড়িয়ে ধরে। কিছুটা হকচকিয়ে যায় মাহবুব।
“সরি লুবনা। তুমি শীতে কাপছো! আমি বুঝতে পারিনি। চলো নিচে যাই।”
আরো শক্ত করে ধরে লুবনা।
“না।”
-“তাহলে!?”
-“আমার মনে একটা আকাশ আছে তুমি জানো?”
– হাহাহাহ তাই!?
– হ্যা, সেই আকাশে একটাই মাত্র নক্ষত্র! দিনরাতই আমার আকাশে সেই লক্ষত্র জ্বলজ্বল করে। আমি তারে ধরতে পারি না। ”
বলতে থাকে লুবনা।
“সেই আকাশ দেখার মত কোন টেলিস্কোপ কি আছে তোমার কাছে?”
লুবনার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে মাহবুবের বুকে।
“আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমার কাজে কর্মে বিঘ্ন ঘটুক আমি চাই না। কিন্তু একটু সময় আমাকে দিতে পারো তুমি!?”
মাহবুব দুই হাত দিয়ে লুবনার দুই গাল চেপে মুখটা তুলে ধরে। আলতো করে চুমু খায় কপালে।
“সরি লুবনা। আমি সেই আকাশটা দেখার চেষ্টা করবো এখন থেকে।”
বিজ্ঞানী মাহবুব আমিন স্ত্রীর মাথা চেপে ধরে নিজের বুকে।

পৃথিবী নামক এই গ্রহের একটা পাকা দালানের ছাদে দুই নরনারী প্রেমের সাক্ষি হয়ে রইল কেবল কালপুরুষ আর বড় ভাল্লুকটা।

৬৫৫জন ৬৫৪জন
0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ