অনেক দিন থেকেই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে পোর্টাল সহ বিভিন্ন জায়গাতে “বল্টু ” একটি পরিচত শব্দ। কমিকস , জোকস ট্রল কোথায় নাই মি. বল্টু। আমি হলফ করে বলতে পারি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক গুলিতে যারা সরব আছেন বল্টু কে নিয়ে দু একটি মজার জোকস পড়েন নি , এমন মানুষ কমই আছেন। তবে আমি আজ কোন জোকস বা মজার গল্প নিয়ে আসিনি , বল্টু কে নিয়ে বাস্তব কিছু খণ্ড চিত্রের লিখিত বর্ণনা নিয়ে এসেছি।
তবে শুরু করা যাক,
এই “বল্টু” শব্দটি আমাদের কাছে এতো আনন্দের বিষয় ছিল না। ১৯৯২-৯৪ সালের কথা বলছি সে সময় বল্টু আমাদের অহরহ কষ্ট আর বিড়ম্বনাই দিতো। ২০১৬ সালের শেষ দিকে এসে আমি আসলে কি বলছি ? অনেকের কাছে বিষয়টি এমন ও মনে হতে পারে। বল্টু তো অনেক রকমের রয়েছে, নাটের মাথায় লাগানো বল্টু, আছে বল্টু নামের কার্টন সিরিজ , আছে বল্টু কে নিয়ে হাজারো মজার মজার জোকস। এতো পরিচিত বল্টুর মাঝে আমি কোন বল্টু কে নিয়ে কথা বলছি ?
হ্যাঁ, আমি যে বল্টুর কথা বলছি সেটা হচ্চে স্পঞ্জের সান্ডালের বল্টুর কথা। আমাদের সে সময় স্পঞ্জের সান্ডালের ওপরেই ভরসা করে স্কুলে ও বিভিন্ন জায়গাতে যাওয়া লাগতো। আজকের মতো চামড়ার স্যান্ডেল সহজ লভ্য ছিল না , আসলে সহজ লভ্য ছিল না বললে ভুল হবে, কেনার মত টাকা থাকতো না । তখন এক জোড়া চামড়ার সান্ডালের দাম ছিল ১৫০-২৫০ টাকা। এই টাকাতে কিন্তু অনেক সুন্দর সুন্দর চামড়ার স্যান্ডেল পাওয়া যেত যেসব স্যান্ডেলের বর্তমান মূল্য প্রায় ৮০০-১২০০ টাকা। আমরা বছরে একটা চামড়ার স্যান্ডেল পেতাম আর পরার অনুমতি মিলতো কালে ভদ্রে কোথায় বেড়াতে যেতে, তা না হলে স্পঞ্জের সান্ডালেই দিন পার ।
তখন স্পঞ্জের সান্ডালের দাম ২০ -৩০ টাকার মধ্যেই ছিল, আমার একটি সমস্যা ছিল মাঝে মাঝে বল্টু ছিঁড়ে যেত, স্যান্ডেল পায়ে বেশি দৌঁড়াতাম যার দরুন ছিড়তো বেশি। ছিড়ে গেলে বা আঠা খুলে গেলে এখন আর আমরা সেই স্যান্ডেল পায়ে দিই না , সে সময় ওই সুযোগ ছিল না। বল্টু জোড়া দিয়ে পরতে হতো। কখনো কেরোসিনের কুপির আগুনে দুই মাথাতে আগুনের তাপে গলিয়ে চেপে ধরে রাখতাম যতক্ষণ না জোড়া লেগে যেত, দ্রুত যেন ঠান্ডা ও শক্ত হয় সে জন্য তুথু দিয়ে ঠান্ডা করতাম। ৩ টি বল্টু এভাবে পর্যায় ক্রমে জোড়াতাম শেষ দেখা যেত ফিতা ছোট হয়ে গেছে আর পায়ে ঢুকতে চাইতো না , জোর করেই পা ঢুকিয়ে করতাম, জোরাজোরিতে আবার খুলে যেত , ছোট ফিতা জোড়া লাগছে না ? উপায় ? হা উপায় হচ্চে আরেকটা ছেড়া স্যান্ডেল থেকে বল্টু কেটে নিয়ে জোড়া দেয়া , চলত ভালো কিছু দিন। কিন্তু, বিপত্তি এখানেও ছিল , ফিতা অতিরিক্ত বড়ো হয়ে যেত মাঝে মাঝে তখন হাঁটার সময় স্যান্ডেল থেকে পা মাটিতে নেমে যেত , বার বার পা ধোয়া লাগতো। আর সে সময় জনপ্রিয় ছিল বাটার স্পঞ্জের সান্ডাল যা সহজে খয় হত না । অগত্যা রিপেয়ার চলতো মাঝখানে ফেটে দু ভাগ হওয়া পর্যন্ত । কথায় আসি , এর পরে জোড়াতালিতে ব্যর্থ, এখন ? হ্যাঁ, সমাধান হলো ফিতা আবার আলাদা কিনতে পাওয়া যেত এজন্য অপেক্ষা করতে হতো হাটের বার পর্যন্ত ,গ্রাম এলাকার সব কেনাকাটা সপ্তাহে ২ দিন। আমাদের হাট ছিল বনপাড়া হাট । সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার বসতো এই হাট। হাটের দিন ছালার বস্তার ওপরে দোকানি বসতো, স্যান্ডেল ও ফিতা নিয়ে। সাইজ অনুযায়ী দাম ছিলো , ছোট ফিতা ২ টাকা বড় ফিতা ৩ টাকা। সেই ফিতা কিনে এনে বল্টুর গোড়ায় সুতলী বেঁধে টান দিয়ে ঢুকিয়ে নিতাম।
বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় ৩ মাইলের কাছাকাছি। আমাদের একমাত্র বাহন ছিল পদ-জুগোল, যার ওপরেই ভরসা করে প্রতিদিন পথ অতিক্রম করতাম ,কাদায় হাঁটা ছিল সবচেয়ে বেশী বিড়ম্বনার, কাদায় আটকে স্যান্ডেলের বল্টু খুলে যেত তখন ওই স্যান্ডেল তুলতে গেলে পায়ে কাঁদা লাগতো, বই হাতে থাকলে কাঁদায় পরে যেত। আমাদের মাঝে অনেকের স্কুল ব্যাগ ছিল না, ছিল না আমারও আসলে ওই সময় এর তেমন কোনো ব্যাবহার ছিল না। অতি বড় লোকের ছেলে মেয়েরা শুধু ব্যাগ নিত। আমরা ৮টা বই রুমালে কেঁচকি গিট্টু দিয়ে বেঁধে নিতাম এই স্যান্ডেল বিপত্তিতে একবার তো সব বই রাস্তার পানিতে ভিজে যায়, আর রাস্তা ? গরুর গাড়ী চলতো কাদা আর কাদা, হাটু পর্যন্ত কাদাতেও হাটতে হয়েছে আমাদের। তার পরে , পাকা রাস্তা মানে বিশ্বরোড দিয়ে রাস্তায় হাঁটার সময় মাঝে মাঝেই বল্টু খুলে যেত কলম বা রাস্তার পাশের শিশু গাছের ডালের মাথা দিয়ে গুতায় ঢুকতাম। রাস্তার পাশে এখন আর শিশু গাছ নাই , এখন তো সব মেহগুনি ,জাম পাইকড় সহ অনেক গাছ দেখতে পাওয়া যায়। ওই সময় শিশু গাছই ছিল, শিশু গাছ লাগানো হতো যেন গাড়ী এক্সিডেন্ট করলে গাছের সাথে বেঁধে থাকে না হলে গর্তে পড়ে যেত।
আমার পরিস্কার মনে আছে , তখন ৪থ শ্রেণীতে পড়ি , প্রথম সাময়ীক পরীক্ষা চলছে ছুটছি সবাই মিলে, স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছালে স্যান্ডেলের বল্টু ছিঁড়ে যায় , আলতো করে কোনো রকম লাগিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্কুলের গেটের কাছে পৌঁছালাম খেয়াল করে দেখি বল্টু ফিতার মাথা থেকে পড়ে গেছে, ফিতা বের হয়ে আসছে , স্কুলের গেটের ডান পার্শে একটা ছোট খেঁজুর গাছ ছিল, একটা খেঁজুর কাঁটা ছিঁড়ে ফিতার মাথায় ঢুকালাম। সে কি আর ঢুকে অর্ধেক ঢুকে তো বের হয়ে যায় কোনো রকম ঢুকায় পরীক্ষার হলে ঢুকলাম পরিক্ষা শেষে রাস্তার পাশ দিয়ে হাটছি ইটের সাথে উষ্ঠা খেয়ে পড়ে গেলাম কাঁটার মাথা পায়ে ঢুকে গেলো, সে কি ব্যাথা !!! এদিকে খালি পায়ে দুপুর বেলা পাকা রাস্তায় হাঁটা যেত না আবার রাস্তার পাশে বড় বড় ইটের খোয়া থাকতো , তাই খালি পায়েও হাত দূস্কর। ওই ভাবেই আস্তে আস্তে বাড়ী আসলাম , এর পরে জ্বর ব্যাথায় পরের ৩ টি পরীক্ষা আর দেয়া হয় নি ।
অতঃপর বল্টু আমাদের এভাবেই নিত্য ঘটনার সঙ্গী ছিল ……..
অনেক কথা মনে করিয়ে দিলেন। আমি তো পায়ে স্যান্ডেল রাখতেই চাইতাম না। বাটার ওই স্পঞ্জ স্যান্ডেল নতূন পেলে কয়েকদিন পড়তাম। এমনকি ব্যাডমিন্টন খেলতাম ওই স্পঞ্জ পড়েই। বল্টু ছিঁড়ে গিয়েছিলো এভাবে কতোবার।
অতীত মনে করিয়ে দিলেন দেখছি। বল্টুর ছিঁড়ে যাওয়া আর কুপি দিয়ে দুই মাথা পুড়ে চেপে ধরে থাকা, বল্টুর ইতিহাস মনে করে কিছু সময়ের জন্য বল্টুকে স্মরণ করে হাসলামও। বাজার থেকে স্যান্ডেলের যে ফিতা কিনতাম তা মাঝে মাঝে বেমানান লাগত যখন স্যান্ডেলটা পুরোনো আর ফিতা নতুন। ব্যাপার টা খুবই বিরক্ত লাগত আবার কালারও মিলত না।
ভাই, বল্টু এখন লাগাতে হয়, বল্টু জুতাও তেমন পড়িনা আমরা তবে অতীতটা কিন্তু বল্টুময়।
৫টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
বল্টু সেই অতীতে নিয়ে গেলেন।বল্টু যখন ছিড়ে যেত আমাদের এখানে এই বল্টু মেরামতের কারিগর ছিল সে ছেনির মতো পাতলা লোহা গরম করে তা জোড়া লাগাত -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
অনেক কথা মনে করিয়ে দিলেন। আমি তো পায়ে স্যান্ডেল রাখতেই চাইতাম না। বাটার ওই স্পঞ্জ স্যান্ডেল নতূন পেলে কয়েকদিন পড়তাম। এমনকি ব্যাডমিন্টন খেলতাম ওই স্পঞ্জ পড়েই। বল্টু ছিঁড়ে গিয়েছিলো এভাবে কতোবার।
কেসি মিলান
ভাল লিখেছেন। লিখে যান …
শুভ কামনা রইল।
ইকরাম মাহমুদ
অতীত মনে করিয়ে দিলেন দেখছি। বল্টুর ছিঁড়ে যাওয়া আর কুপি দিয়ে দুই মাথা পুড়ে চেপে ধরে থাকা, বল্টুর ইতিহাস মনে করে কিছু সময়ের জন্য বল্টুকে স্মরণ করে হাসলামও। বাজার থেকে স্যান্ডেলের যে ফিতা কিনতাম তা মাঝে মাঝে বেমানান লাগত যখন স্যান্ডেলটা পুরোনো আর ফিতা নতুন। ব্যাপার টা খুবই বিরক্ত লাগত আবার কালারও মিলত না।
ভাই, বল্টু এখন লাগাতে হয়, বল্টু জুতাও তেমন পড়িনা আমরা তবে অতীতটা কিন্তু বল্টুময়।
মুহাম্মদ আরিফ হোসেইন
আমার বল্টু ছিঁড়তো কম, খুলে যেত বেশী।
নিজেই লাগাইতাম।
আহ্!
সেই দিনগুলি……