মাহবুবুল আলম //
দেশের ইতিহাসে এই প্রথম দলীয় প্রতীকে সদ্যসমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা যেমন আছে তেমনি অন্যদিকে ভোটারদের বিপুল উপস্থিতি ও উৎসবমুখর পরিবেশে স্থানীয় সরকারের একদম প্রান্তিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ভোট গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে বলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন। একই সাথে নির্বাচনে যেমন ছিল কিছু কিছু অনিয়ম, সহিংসতা আর প্রাণহানির ঘটনা যা একটি সুন্দর নিবাচনী আয়োজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছে। কোন কোন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল অভ্যাসমতো প্রতিনিয়ত নির্বাচন নিয়ে নালিস, সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না। ব্যপক কারচুপি হচ্ছে, ব্যালট পেপার ছিনতাই করে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করেছে এন্তার অভিযোগের পর ও মানুষ এসব অভিযোগ কানেই তুলেনি বরং তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে আরো সচেতন হয়েছে।
প্রথমেই আমি সদাসমাপ্ত ইউপি নির্বাচনের দলগত ফলাফলের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাই। কমিশনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ছয় ধাপের নির্বাচনে আ’লীগ ২৬৭০ ইউপিতে জয়লাভ করেছে। এর বাইরে বিএনপি ৩৭২ ইউপিতে জয়লাভ করেছে। নিচের সারণীতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন-২০১৬ এর ফলাফল তুলে ধরা হলো। দেশের ৪৫৫৫ টি ইউপির মধ্যে ৪০৮৫ টি নির্বাচন হয়েছে সে হিসাবে ফলাফলের সারণীটি করা হয়েছে।
ধাপ | তারিখ | ইউপির সংখ্যা | নৌকা | ধানের শীষ | লাঙ্গল | বিদ্রোহী | জেপি | অন্যান্য | ভোট প্রদানের % হার |
১ | ২২/৩/১৬ | ৭১২ | ৪৯৪ | ৫০ | ১ | ১০৯ | – | – | ৭৪ % |
২ | ৩১/৩/১৬ | ৬৩৯ | ৪১৯ | ৬৩ | – | ১১৭ | – | – | ৭৮% |
৩ | ২৩/৪/১৬ | ৬১৫ | ৩৬৬ | ৬০ | – | ১৩৯ | – | – | ৭৬% |
৪ | ০৭/৫/১৬ | ৭০৩ | ৪০৫ | ৭০ | – | ১৬১ | – | – | ৭৭% |
৫ | ২৮/৫/১৬ | ৭১৭ | ৩৯২ | ৬৭ | ৯ | ১৭০ | – | ১ | ৭৬.৮% |
৬ | ০৪/৬/১৬ | ৬৯৮ | ৪০৩ | ৬২ | ১৫ | ১৮৪ | ১ | ১ | ৭৫.৬৮% |
এর বাইরে ১ম ধাপে ৫৪, ২য় ধাপে ৩৪, তৃতীয় ধাপে ২৯, চতুর্থ ধাপে ৩৫, পঞ্চম ধাপে ৩৯, এবং ৬ষ্ঠ ধাপে ২৪ ইউনিয়ন পরিষদে বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এদের মধ্যে মাত্র ২ জন ছাড়া বাকি সবাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। ছয় দফায় দেশের চার হাজার ৫৫৫টি ইউপির মধ্যে চার হাজার ৮৫ ইউপিতে ভোট ভোটের ফলে প্রায় ৯০ ভাগ ইউপিতে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে। তৃতীয় স্থানের রয়েছে বিএনপির প্রার্থীরা।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জোর করে ব্যালটপেপারে সিলমারা, কেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়ম প্রাণহানি সহিংসতার ঘটনায় উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটে আয়োজনের এ বিশাল কর্মযজ্ঞের অর্জনকে অনেকটাই ম্লান করেছে । মোট ৬য় দফায় ভোট গ্রহনের এ আয়োজনে ৩৯ জনের প্রাণহাণী ঘটেছে। যা নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় মিলিয়ে প্রায় একশ’র কাছাকাছি। বিশেষ করে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় ক্ষমতাসীনদের মনোনয়নপ্রত্যাশীর প্রতিযোগিতা এত বেশি ছিল যে, কেন্দ্র থেকে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। ফলে দলের একজন প্রার্থী মনোনয়ন পেলেও বাকিরা ঠিকই বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। বিদ্রোহীদের দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও স্থানীয় রাজনীতিতে দ্বন্দ্বের বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল নির্বাচন থেকে দূরে রাখা সম্ভব হয়নি। আর এ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের সহিংসতায় রূপ নিয়েছে।
এ পর্যায়ে একটি তথ্য তুলে ধরে বলতে চাই যে, এবারের নির্বাচনসহ দেশের স্বাধীনতার পর নয়বার ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবং প্রত্যেক নির্বাচনেই কম বা বেশি সহিংসতা হয়েছে।অতীতের নির্বাচন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত তিনবারের ইউপি নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হলেও পরের সব নির্বাচনে সহিংসতা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ঘটেছে ১৯৮৮ সালে স্বৈরাচার এরশাদ আমলে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে। একদিনে নির্বাচন হওয়ার কারণে প্রায় ১শ’ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। এছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০৩ সালের নির্বাচনেও ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ডেমোক্র্যাসিওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫১ দিনব্যাপী ওই নির্বাচনে ৮০ জন প্রাণ হারায়। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে সবচেয়ে কম সহিংসতার ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে ওই নির্বাচনে ৩৪ জনের প্রাণহানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এবারের নির্বাচনের প্রাণহানির ঘটনাও রেকর্ড করেছে। ছয় দফায় নির্বাচনের দিনের সহিংসতায় প্রাণ গেছে ৩৯ জনের। এর বাইরে ভোটের আগে-পরের সহিংসতায় ১শ’ জনের প্রাণহানির ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এখানে একটা কথা স্মরণে রাখতে চাই যে, এবারই প্রথমবারের মতো দলীয় ভিত্তিতে চেয়ারম্যান পদে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। এর আগে সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা করা হয়েছে নির্দলীয়ভাবে। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য দলীয় ভিত্তিতে ইউপি নির্বাচনকে সহিংসতার অন্যতম কারণ হিসেবে বিশ্লেষণ করছেন।
প্রথম থেকেই ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় জড়িত থাকার সবচেয়ে বেশি অভিযোগ রয়েছে সরকারী দল আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে। এ কারণে ছয় দফায় নির্বাচনে সহিংসতার যাদের মৃত্যু হয়েছে তারাও মূলত সরকারী দলের সমর্থক নেতা ও কর্মী। এর বাইরের বিএনপি ও তার বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ছিল নির্বাচনে। কুমিল্লায় বিএনপির প্রার্থীর সমর্থকদের হাতে এক বিদ্রোহী প্রার্থীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে সদস্য প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ব্রতীর পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রথম থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে সরকারী দলের স্থানীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এর প্রধান কারণ মূলত দলীয় কোন্দল। তবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পাশপাশি স্থানীয় গোষ্ঠীগত প্রভাব এ নির্বাচনে সহিংসতার জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন অনেকে।
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছয় দফার ভোট শেষে দাবি করেছেন, বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে সার্বিকভাবে সব ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। নির্বাচনে সহিংসতা এবং অনিয়ম প্রতিরোধে সমাজে সংস্কার আনার কথা বলেন তিনি। বলেন, এজন্য সামাজিক য়িত্বও আছে। কমিশন সব ধাপেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছে।
শুধু ইউপি নির্বাচনেই নয় দেশের যে কোন নির্বাচনে একজনের প্রাণহানিও কাক্সিক্ষত নয়। অথচ সেখানে ভোটের দিনের সহিংসতায় ছয় দফায় ৩৯ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এ প্রাণহানীর জন্য নির্বাচন কমিশন তথা সরকার কেউই দায় এড়াতে পারেন না। দলীয় ভিত্তিতে মনোনয়ন দেয়া হলেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের লাগাম টেনে ধরা যায়নি। বিদ্রোহী প্রার্থীরা যে এলাকায় শক্তিশালী ছিল সে এলাকায়ই সহিংসতা হয়েছে বেশি। তার পরেও একথা জোর দিয়েই বলায় যায় যে, এ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীরাই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আওয়ামী লীগের ২৬৬০ জন নমিনেটেট প্রার্থী জয়লাভের বিপরীতে বিদ্রোহী প্রার্থরা জিতেছে ৮৮০ টি ইউপিতে। তাই এই ফলাফলের প্রেক্ষিতে চলা যায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়াও সঠিক ছিলনা। দলের এক শ্রেণীর নেতার মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণেই দলের অনেক ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতা মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছে। তারা মনোনয়ন পওয়া নেতারদের টাকার টাকা ও মনোনয়ন বোর্ডের নেতাদের লোভের কাছে হেরে জেদ করে প্রার্থী হয়েছেন। এবং বেশিরভাগ বিদ্রোহী প্রার্থীই দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে জয়লাভ করে দলের নেত্রীত্বকে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, এভাবে আগামীতে মনোনয় বাণিজ্য হলে, দলীয়শৃংখলা ভঙ্গ করে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
২টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ইচ্ছে আছে সামনে কোন নির্বাচনে ভোট না দেবার।তবে প্রার্থী ভাল হলে অবশ্যই জানে মালে খেটে ভোট দিব।আশ্চর্য্যের বিষয় ভোটে এত লোক মারা যায় অথচ এই আমরাই কিন্ত একটু সহনশীল হলে সুষ্ঠু ভোটের ব্যাবস্থা হতে পারে।তা হবে না আর কারন রাজনিতী এখন টাকার নীতির কাছে বন্দী -{@
আবু খায়ের আনিছ
ভোটার হওয়ার পর বেশ কয়েকটা নির্বাচন গিয়েছে, ভোট দেওয়া হয়নি আজো।