১১.০৭
আজকের রাত আশ্চর্য রকম নিস্তব্ধ …
আসলেই নিস্তব্ধ নাকি আমার কাছে নিস্তব্ধময় বুঝতে পারছি না। সবকিছু কেমন জানি অসহ্য লাগছে। মা’র কাছে খুব যেতে হচ্ছে। কিন্তু পারছি না। চাইলেই সবকিছু পারা যায় না। পারা গেলে মনে হয় ভালো হত।
প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপছে শরীর। অনেকদিন ধরেই জ্বরটা বাসা বেঁধে রয়েছে। বুঝতে পারছি না আমার আসলে কি হয়েছে!
১২.০৭
ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম আজকে। আসলে গত এক মাস ধরেই যেতে হচ্ছে। কি এক অসুখ যে বাধিঁয়েছি আল্লাহই জানে!
ডাক্তার আংকেল আব্বুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার অনেক টেস্ট করানো হয়েছে। আজকে রিপোর্ট দেখে উনি কেন জানি খুব গম্ভীর হয়ে আমাকে একটু বাইরে যেতে বলেছিলেন। পরে জেনেছি আব্বুর কাছ থেকে যে আমার ক্যানসার হয়েছে।
আংকেল আমার সামনে বলেন নি। কারণ রোগীর সামনে রোগের কথা না নেওয়া নাকি সঠিক কাজ … !
আব্বু কথাটা খুব সহজভাবে বলার চেষ্টা করেছিল। মা মারা যাওয়ার পর আব্বুই আমার একমাত্র দুনিয়া।
সামরিক কর্মকর্তা বলে অনেক কঠিন কথাও সহজভাবে বলতে জানেন কিন্তু সন্তানের রোগের কথা একজন বাবার পক্ষে একেবারেই অনুভূতিহীনভাবে বলা অসম্ভব। ফলাফল বাবার চেহারা দেখেই আমি বুঝে গেলাম … ” আমার দিন শেষ! ”
২৯.০৮
আজ দীর্ঘ একমাসের বেশি সময় ধরে হাসপাতালে ভর্তি আমি। মাঝখানে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল, ভেবেছিলাম আমার বুঝি দিন শেষ। কিন্তু নাহ এই যাত্রা বেঁচে গেছি। ঠিকমত লিখতে পারছি না, হাত কাঁপছে ভীষণ! ক্যানসারের চিকিৎসা ভয়াবহ কষ্টের!
হাসপাতালটা অনেক সুন্দর। এখানে নার্সদের সবাই সিস্টার বলে ডাকে। সবখানেই নাকি ডাকে। আমার কেবিনে যে নার্সকে ডিউটি করতে দেখি তার বয়স একটু কম। ওনার সাথে পারতপক্ষে কথা বলি নাই। কিন্তু সেইদিন কি একটা দরকারে কথা বলতে হয়েছিল।
কিন্তু কি বলে ডাক দিব? নার্স বলতে কেমন অস্বস্তি লাগে। সিস্টার কেন যেন ভালো লাগে না বলতে। আমার কাছে সিস্টার মানে বোন। কিন্তু উনি তো আমার বোনের বয়সী না, যদিও আমার কোন বোন নেই। খালাও বলতে পারছি না। শেষমেশ দ্বিধা নিয়ে ” খালামণি ” বলে ডাক দিলাম।
অবাক হয়ে ফিরে তাকালেন উনি। আমি অবশ্য কাউকে খালামণি ডাকতে পারি নি কখনো। আমার মা-বাবা দুই ভিন্ন ধর্মের ছিলেন। তাদের বিয়ে দুই পরিবারের কেউই মেনে নেয়নি। সে হিসেবে আমার কোন আত্মিয়স্বজনও নেই।
০৯.০৯
আমার অসুস্থতা ভীষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লিখতে আরো বেশি কষ্ট হয়। খালামণি ছাড়াও এখন আরো দুইজন খালা পেয়েছি। তারা অবশ্য বেশ বয়স্কা। বড়জনকে বড় খালা, আর ছোটজনকে মেঝো খালা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নির্দিষ্টভাবে না বললে তারা যদি মনে কষ্ট পায়!
ক্যানসার বিভাগের ডাইরেক্টর ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল আংকেল অবশ্য আমার দেখা সবচেয়ে কঠিন ব্যক্তি। ওনাকে দেখলেই ভয় লাগে। ছয় ফুট উচ্চতার দীর্ঘদেহী মানুষটা যখন সামরিক বাহিনীর পোষাকে আমাকে দেখতে আসেন ভয়েই আমার শুকনো মুখ আরো শুকিয়ে যায়।
ও হ্যাঁ সেদিন আমার চেহারা দেখে চমকে উঠেছিলাম আমি। গোলগাল চেহারা কেমন যেন চাপা ভেঙ্গে পড়েছে। নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলাম না।
১৭.০৯
আজ পত্রিকায় খবর পড়লাম কোথায় কোন ছেলে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেছে, প্রেম-ভালোবাসা সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা নেই আমার। মুভি দেখেই যতটুকু আছে। আর হ্যাঁ বাবা-মার ভালোবাসাটা আমি দেখেছি। আচ্ছা প্রেমে ব্যর্থ হয় কিভাবে?
উমমম! বাবাকে জিজ্ঞেস করতে হবে …
১৯.০৯
আজকে ব্রিগ্রেডিয়ার আংকেল চেকআপ করতে এসেছিলেন। করার পর দেখি তার মুখ আরো গম্ভীর হয়ে গেছে …
খুব দূর্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ” কাক্কু, আমি কি আর বাঁচব না? ”
ওনার কঠিন চেহারা এক মুহুর্তের জন্য বদলে গেল।
সাথে সাথেই অবশ্য সামলে নিলেন।
আমি ভাবছি ওনাকে কাক্কু বলে অপরাধ করলাম নাকি! আসলে আংকেল বলতে ভাল লাগে না। আমাদের বাংলা ভাষার জন্য নাকি অনেক মানুষ শহিদ হয়েছে। তাই বাংলায় বলেছি। অবশ্য উনি মনে হয় রাগ করেছেন। সেজন্যই বোধহয় কোন কথা বলেননি।
একটু পর মেঝো খালা আসলো। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ” আচ্ছা খালা! আমি কি আর বাঁচব না? ”
বেশ ধমকের সুরেই জবাব দিলেন, ” আমরা আছি না। তুমি বাঁচবে না কেন? ”
বাবা আসলো। বাবাও বললেন আমি নাকি সুস্থ হওয়ার পথে!
২০.০৯
সবাই যত যাই বলুক না কেন, আমি ঠিকই বুঝতে পারছি যে আমার দিন শেষ হয়ে আসছে। সেদিন মা-কে স্বপ্নে দেখলাম। সম্ভবত মা-র কাছেই ফেরৎ যাচ্ছি আমি! বাব-র জন্য খারাপ লাগছে। অনেক কষ্ট পাবে বাবা। একদম একলা হয়ে যাবে।
সেদিন মা-র কাছে যেতে মন চাইছিল। কিন্তু এখন ইচ্ছা করছে না। বাবাকে এভাবে একলা ফেলে একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না। আর মা-ও বলে গেছিল আমাকে একদিন বড় হতে, ভালো মানুষ হতে। পৃথিবীতে নাকি ভালো মানুষের খুব অভাব! আমি মা-কে কথা দিয়েছিলাম আমি একজন ভালো মানুষ হব।
কিন্তু আমি মারা গেলে মায়ের কথা রাখব কিভাবে? আমাকে তো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাকে বড় হতে হবে। ভালো মানুষ হতে হবে।
কি অদ্ভুত এই দুনিয়া! কিছু মানুষ নিজেই নিজেকে মেরে ফেলে। আর আমি চাচ্ছি না কিন্তু মারা যাচ্ছি ! দুনিয়াটা অদ্ভূত। আমি যে বাঁচতে চাই এটা কি কেউ বুঝতে পারছে না? কেন আমার এই রোগ? কেন?
২৮.০৯
দিন যতই যাচ্ছে অবস্থা খুব খারাপ হচ্ছে, খুব খারাপ। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। আমি মায়ের কথা রাখতে পারছি না! বাবাকে একলা রেখে চলে যাচ্ছি। ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।
আচ্ছা আমার তো রতনকে ওর গল্পের বইটা ফেরৎ দেওয়ার কথা ছিল, দিতে মনে নেই। ক্লাসের ফিরোজা ম্যাডামকে বলতে হবে যে ওইদিন ক্লাসে বিড়ালের ডাকটা আমিই দিয়েছিলাম, নাইলে উনি তো আনিকা নামের সহজ সরল মেয়েটাকে দোষী ভেবে বসে থাকবেন। আনিকার কাছেও ক্ষমা চাইতে হবে, আমার জন্য কতই না শাস্তি পেতে হয়েছে বেচারিকে!
আমি এখন কিভাবে যাই? আমার তো ঢের কাজ বাকি …
আর লিখতে পারছি না আমি …
চারদিন পর ……
ওইদিনই সাধারণ কেবিন থেকে আইসিইউতে আনা হয়েছিল আমাকে!
একটু আগে আমি সব কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে গেছি। খালামণি রুমে এসে হটাৎ আমার দিকে তাকিয়ে দৌড়ে ডিউটিরত চিকিৎসককে ডেকে আনলো। ওনাকে একদিন মামা ডেকেছিলাম আমি। সেই থেকে উনি আমার মামা-ই হয়ে গেছেন। আমার পছন্দের কিছু বই-ও উপহার দিয়েছিলেন। তিন গোয়েন্দার বেশ কিছু পুরনো বই পেয়েছিলাম ওনার কাছে থেকে। খুব গম্ভীরভাবে উনি আমাকে মৃত ঘোষণা করলেন।
আজ শুক্রবার। জুম্মার আজান দিচ্ছে। আমি জুম্মার নামায আগে নিয়মিত পড়তাম বাবার সাথে মসজিদে গিয়ে। অসুস্থ থাকায় অনেকদিন পড়া হয় নি। আজ অবশ্য জুম্মা শেষেই আমার জানাজা হবে।
আমার পাতানো খালামণি, খালাদের কাদঁতে দেখেছি। আশ্চর্য ! কত মানুষ তো মারা যায়। আমার জন্য এত কান্নাকাটির কি আছে! বাবা মুখ পাথর করে রেখেছেন। আড়ালে গিয়ে যে কাদঁবেন বুঝাই যায়। ব্রিগ্রেডিয়ার কাক্কুও দেখি একবার চোখ মুছে নিলেন।
উনি কাদঁতে পারেন আমার ধারণাতেই ছিল না। আচ্ছা শুনেছিলাম যে ডাক্তার-নার্সরা নাকি পাথর হৃদয়ের অধিকারী হয়। মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তবে কেন আমার বেলায় কাদঁছে সবাই? মাত্র আড়াই মাস হয়েছে তারা ১২ বছর ৫ মাস ১৬ দিন বয়সী আমাকে চিনে। তাহলে কেন কাদঁছে তারা ?
তাদের কাদঁতে দেখে ভালো লাগছে না। অপরাধী মনে হচ্ছে। ভালো মানুষ না আমি। ভালো মানুষ কখনো অন্যকে কাদাঁয় না, কক্ষণো না। আমারই কান্না পাচ্ছে কেন আমি তাদের মত এতজন ভালো মানুষকে কাদাঁচ্ছি! কেন!
১২টি মন্তব্য
নীতেশ বড়ুয়া
🙁 🙁
ভাই এই রকম করে লিখলে তো মন খারাপ হয়ে যায় 🙁
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
🙁
নীতেশ বড়ুয়া
পোস্টের প্রতিটি মুহুর্ত অনুভব করলাম কোন না কোনভাবেই।
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
চেষ্টা করেছি যাতে প্রত্যেকটা বাক্য পাঠকদের হৃদয়ে আঘাত করে
অরুনি মায়া
অত্যন্ত মন খারাপ করা পোস্ট | চোখে পানি চলে এল 🙁
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
তাহলে লেখাটা স্বার্থক হয়েছে 🙂
আবু খায়ের আনিছ
প্রথম পর্বে পরেছিলাম, বাবাকে হারিয়েছি ১৬ বছর আগে, আর এখানে পড়ছি ক্যানসারের কথা জানতে পারলাম আব্বুর কাছ থেকে? বিষয়টা খটকা তৈরি করছে।
অর্নাস পাশ করে বিসিএস দিয়ে সরকারি কর্মচারি হিসাবে যোগ দেওয়ার পর একটা মানুষ বলে সে প্রেম ভালেবাসা সম্পর্কে জানেনা, যতটুকু অভিজ্ঞতা তাও সিনেমা মুভি দেখে। প্রেমে আবার বার্থ্য হয় কিভাবে??
বিষয়টা একটু বাস্তব বির্বজিত হয়ে যাচ্ছে না?
যদি গল্পটা পূর্ববতী লেখার অংশ হয় তাহলে দুটো বিষয় একটু লক্ষ্য করে দেখবেন। আর যদি নতুন লেখা হয় তাহলে দ্বিতীয় বিষয়টা একটু লক্ষ্য করবেন। অগ্রহনযোগ্য বক্তব্য হয়ে যাচ্ছে এটা।
আশা করি মন্তব্য পজেটিভ ভাবেই নিবেন।
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
এটা অন্য একটা লেখা
আপনি যেটার কথা বলছেন সেটা ” নীল ডায়েরি ”
আর এটা কাল্পনিক দিনলিপি …
গল্প আলাদা
আবু খায়ের আনিছ
লিখতে থাকুন অবিরাম।
শুভেচ্ছা নিবেন। -{@
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
🙂 -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন মানুষের দিনলিপি! প্রতিটা মুহূর্তে সে অনুভব করছে সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে! ভাবতেই কেমন যন্ত্রণা হয়।
মৃত্যু এক অনিবার্য সত্য তবুও আমরা মেনে নিতে পারি না। 🙁
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
মৃত্যু অনিবার্য কিন্তু একদমই কাম্য নয় আমাদের কাছে 🙁