
ঢাকা কলেজ …
নামটা শুনলেই অনেকের আত্মা কেঁপে উঠে। অনেকেই মনে মনে ভাবেন যে ঢাকা কলেজ বুঝি কোন কলেজ না, একটা সন্ত্রাসীদের আতুঁড়ঘর। তাদের ভাব দেখলে মনে হয় এখানে যারা পড়ালেখা করে তারা ছাত্র না, সাক্ষাৎ কোন যম!
ঢাকা কলেজের ভর্তি হওয়ার আগে সবসময় শুনে এসেছি, ওইখানে পড়ালেখা হয় না, পরীক্ষা হয় না। সব গুণ্ডা-মাস্তান ভর্তি হয়। ওইখানে সারাদিন মারামারি চলে, চাঁদাবাজি চলে। যারা ভর্তি হয় তারা সব খারাপ ছাত্র। ও হ্যাঁ সবচেয়ে ভয়ংকর কথা ঐখানে নাকি টাকা ছাড়া ভর্তি হওয়া যায় না। মানে নির্ধারিত টাকার বাইরেও আরো ফি দিতে হয় ছাত্রনেতাসহ হেনতেনদের …
ঢাকা কলেজে যখন ভর্তি হই তখন দেশের সবচেয়ে কম টাকায় (২৬৬২/-) ভর্তি হয়েছি। অন্যান্য বেসরকারি কলেজের তুলনায় কম করে হলেও ৩-৫ ভাগ কম। একটা টাকাও অতিরিক্ত লাগে নি।
পরীক্ষা আর ক্লাস প্রসঙ্গে আসি। আমরা ভর্তি হওয়ার পর নিয়মিত ক্লাস হয়েছে। এমনকি এইচএসসি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার জন্য যেদিন সকালে ক্লাস হত না সেদিন দুপুরে ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা ঠিক, আমরা ক্লাস করতাম না। তবে আমাদের ক্লাস করানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা কলেজ প্রশাসন থেকে করা হয়েছিল। তবে দ্বিতীয় বর্ষে উঠে সে চেষ্টায় ভাটা পড়ে যায়। পরীক্ষার প্রসঙ্গে আসলে বলতে হয় এই দুই বছরে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা আমরাই দিয়েছি। প্রথম বর্ষের ক্লাস টেস্ট, মিড টার্ম, ইয়ার ফাইনাল সবগুলো পরীক্ষা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বর্ষেও মিড টার্ম, ক্লাস টেস্ট, প্রি-টেস্ট, টেস্ট (চলছে) যথাসময়েই অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
আর এই কয়েকদিনে ক্যাম্পাসের ভিতরে কোন গণ্ডগোল দেখিনি। নিউ মার্কেট বা নিলক্ষেতে চাঁদাবাজিও দেখিনি। বাস ভাঙ্গচুরের ঘটনা একবার কি দুইবার ঘটেছে।
যাই হোক, যত কিছু শুনেছি তার অনেক কিছুই আমরা দেখিনি। হয়তো কোন এককালে এসব চলত। কিন্তু এখন অনেক কিছুই ঘটে না। দিন দিন কলেজ প্রশাসন যথেষ্ট কঠোর হচ্ছে। তবে সরকারি কলেজ বলে অনেক সীমাবদ্ধতা থেকেই যায় তার উপর উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক একইসাথে চালানো যথেষ্ট কঠিন কাজ।
একটা মজার কথা বলি। এই তো সেদিন একজন আমাকে বলছিল তোমাদের ঢাকা কলেজের ছেলেরা তো কোন আমলের মহাপুরুষদের নিয়ে গর্ব করে বেড়াও। বর্তমানে একজনও কি দেখাতে পারবা যে তার কার্যক্ষেত্রে সফল। আমি চাইলেই অনেক কিছুই বলতে পারতাম কিন্তু কেন জানি বলিনি। কিন্তু পরেরদিনই এই বছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীতদের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশিত হয় আর সেই তালিকার একজন ছিল বাংলাদেশী, যে কিনা ঢাকা কলেজের !
ঢাকা কলেজের অনেক সমস্যা আছে এটা আমিও মানি। এরপরেও ঢাকা কলেজ ঢাকা কলেজই। ১৭৪ বছর ধরে টিকে থাকা, প্রত্যেক বছর কমপক্ষে ১০% করে ছাত্র দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তৈরি করে আসা একটা প্রতিষ্ঠান আর যাই হোক কোন সন্ত্রাসীদের আস্তানা হতে পারে না।
ঢাকা কলেজ থেকে আমি তেমন কোন আহামরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাইনি। কিন্তু একটা শিক্ষা পেয়ে গেছি আর সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ …
“ এটা তোমার জীবন, কারো কোন দায় নেই। তোমার জীবন কিভাবে গড়বে সেটা তোমার ব্যাপার। ”
এই শিক্ষাটা আমাদের এই বয়সে খুবই দরকারি। আমাদের বয়সটা এমন থাকে যে হাজার চাপ দিলেও যদি উক্ত শিক্ষাটা না আসে তাহলে কোনভাবেই সফলতা সম্ভব না। এইজন্যই বোধহয় প্রত্যেক বছর বিপুল পরিমাণ ছাত্র (দেশের ২য় সর্বোচ্চ) এই কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নেয়। আর স্নাতকের পরও প্রায় একই পরিমাণ ছাত্র বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়। এই মন্ত্রই বোধহয় ঢাকা কলেজের সাফল্যের গোপন রহস্য!
এই ঐতিহ্যবাহী কলেজের প্রতিষ্ঠা নিয়ে কিছু জেনে নেই …
ঢাকা কলেজ বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই ‘ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল’ নামে এটি যাত্রা শুরু করে। এর মাধ্যমে ঢাকাতেই বাংলার প্রথম সরকারি ইংরেজি স্কুল স্থাপিত হয়। ১৮৩৮-৩৯ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুলে ৮টি ক্লাস ছিলো এবং ছাত্র সংখ্যা ছিল ৩৪০। শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন ৭ জন ইংরেজ এবং ৪ জন বাঙালি। ১৮৪১ সালে স্কুলটি কলেজের মর্যাদায় উন্নীত হয় এবং এর নাম হয় ‘ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ’। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল সদরঘাটে কলেজের মূল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৮৪৪ সালে। ১৮৭৩ সালে স্থান সঙ্কুলানের অভাবে ভিক্টোরিয়া পার্কের পূর্বে একটি প্রশস্ত দালানে কলেজটি সরিয়ে নেওয়া হয়। সেখান থেকে আবার ১৯০৮ সালে বর্তমান কার্জন হলে স্থানান্তরিত করা হয়।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব ঢাকা কলেজের উপরও এসে পড়ে। শিক্ষা-দীক্ষার কাজে এবং অন্যান্য নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকান্ডে তাই ভাটা পড়ে এমনকি কলেজ ভবনগুলি সামরিক বাহিনীর দখলে চলে যাওয়ারও নানা রকম সম্ভাবনা দেখা দেয়। কৌশলগত কারণে ১৯২০ সালের জুলাই মাস থেকে ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েট অর্থাৎ এফ.এ ক্লাসকে কলেজের বি.এ, বি.এস.সি এবং এম.এ, এম.এস.সি ক্লাস থেকে পৃথক করে নতুন একটি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ গঠন করা হয়। এই নব গঠিত ইন্টারমিডিয়েট কলেজকে ২০ আগস্ট কার্জন হল থেকে সরিয়ে তদানীন্তন ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভ উদ্বোধনকে নির্ঝঞ্ঝাট করার উদ্দেশ্যে কলেজের অপর অংশটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একীভূত করে নেয়া হয়। একই সাথে প্রাক্তন ঢাকা কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বহু পুস্তক, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়কে সরবরাহ করে এবং এর যাত্রাকে সুগম করে দেয়। নতুন আদেশ বাস্তবায়নের ঠিক আগে, ১৯২১ সালের ৩১ মার্চ ঢাকা কলেজের মোট ছাত্র সংখ্যা ছিল ৭২৯। এদের মধ্যে ৫৫০ জন হিন্দু এবং ১৭৯ জন ছিল মুসলমান। ১৯২১ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকা কলেজটিকে অন্য ভবনে অর্থাৎ সে সময়কার প্রকৌশল বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজকে ছোটলাটের বাস ভবনে (বর্তমান ল’কমিশন এবং বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট) স্থানান্তর করা হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলকে কলেজের হোস্টেলে রূপান্তরিত করা হয় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলটি সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া কলেজের অন্যান্য অবকাঠামোও সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ভাগাভাগি করতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আহত সৈন্যদের পুনর্বাসনের জন্য ভবনটি ছেড়ে দিতে হয় এবং আবার ঢাকা কলেজ লক্ষ্মীবাজারে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৫ সালে কলেজটি বর্তমান জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে কলেজটি ১৮ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর ছাত্রসংখ্যা ২০ হাজারের বেশি এবং শিক্ষক-কর্মচারী সহ স্টাফ প্রায় ৫০০ জন।
১৭৪ বছর ঐতিহ্য নিয়ে টিকে থাকা এই প্রতিষ্ঠান এবার ১৭৫ বছরে পা দিচ্ছে।
শুভ হোক এই পথযাত্রা। এই ঐতিহ্য নিয়ে ঢাকা কলেজ টিকে থাকুক চিরকাল।
শুভ জন্মদিন ঢাকা কলেজ। -{@
৪টি মন্তব্য
অপার্থিব
যদিও জীবনের কোন পর্যায়ে ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম না তবে ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষার পর যখন ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিং করতে ঢাকায় এসেছিলাম তখন ঢাকা কলেজের কিছু বড়ভাইয়ের সঙ্গে একসাথে কিছুদিন ছিলাম, তাদের জীবন যাত্রা পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। এখন এক ধরনের জেনারেশন তৈরী হয়েছে যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন নামকরা কলেজকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করে যা খুবই লজ্জাজনক। এইসব কথা মাথায় রাখবেন না। কারো জীবনের সফলতা তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না। সুন্দর পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। ঢাকা কলেজের সকল ছাত্র, শিক্ষক ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি রইল জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
আপনাকেও ধন্যবাদ -{@
মরুভূমির জলদস্যু
শুভ জন্মদিন
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
🙂