আকাশপথে...
আকাশপথে…

আমার দেশ। যতোবারই যাই, তার আগেই আকাশের দিকে বারবার চোখ পড়ে। কেন যে এমন হয়! প্লেন দেখলে হা করে চেয়ে থাকি। কোথা থেকে আসছে, কোথায়ই বা যাচ্ছে। মনের ভেতরটায় ছটফট করে আমার ধূলোবালি মেশানো ফুচকার শহরটার জন্য। এ যে কি সে দেশের বাইরে যারা থাকেন, তারা জানেন। আরে আমি যখন সিলেট থাকতাম, শমশেরনগর আসাটাই একটা উৎসব ছিলো। আর এ তো দু’দিনের পথ।

কতো কিছু যে করতে হয়েছিলো দেশে যাবার জন্যে। সরকারী চাকরী, একটি বছরও হয়নি। তারপরেও ছুটি পেয়ে গেছিলাম। অফিসের ক্রীষ্টমাস পার্টিতে গেলাম, আহা সে যে কি আনন্দ-উচ্ছ্বাস! টিকেটটা জমা দিতেই ক্যারেন বললো, ‘হাই নীলা, গুড ইভনিং।’ আমি অবাক কি করে চিনলো? আমায় সবসময় ইউনিফর্মে দেখে, তাও মোটে তিন-চারবার দেখা হয়েছিলো। ‘হান আয়াম সো ইমপ্রেসড!’ জানতে চাইলাম তুমি আমায় কিভাবে চিনলে এমন ড্রেসে? আমার কাজে সন্তুষ্ট। যাক ওসব কথা। এ কথা বলার সাথে সাথে বললাম এখনও আমি পার্মানেন্ট হইনি, সে তো অবাক! বললো পরের দিনই অফিস যেতে। অফিস গেলাম চাকরী স্থায়ী হলো। এই সুযোগে বললাম ক্যারেন আমি দেশে যাবো ছুটি…সঙ্গে সঙ্গে বললো জুলাই-আগষ্ট কোনো ছুটি না। নিতে চাইলে অন্য কোনো মাস। ছেলের স্কুলে মার্চ ব্রেক, যাক ছুটি পেয়েই গেলাম।

এবার টিকিট। নতূন চাকরী, ব্যাঙ্কের অবস্থা খুবই করুণ। কিন্তু ইচ্ছে হলো যেভাবেই হোক নিজের আয়ের টাকায় যাবো, দেশে গিয়ে খরচ করবো। অবশেষে টিকেট হলো। দেশে ফোন দিলাম বাপি-মামনি একটা ভালো খবর আছে। মার্চে আসছি। ডিসেম্বর থেকে ওদের অপেক্ষা, সাথে আমিও। উফ কবে আসবে মার্চ? কত্তো বছর! ২০১০ সালে গিয়ে ওদেরকে সময়ই দিতে পারিনি ফেসবুকের বন্ধুদের সাথে বেশী সময় কাটিয়েছিলাম। এবার শুধু ওদের সাথে। মাত্র তিন সপ্তাহের ছুটি। প্রতিদিন কাজে যাবার পথে ফোন দিতাম দেশে, হঠাৎ মামনির কন্ঠ শুনে একটু কেমন জানি লাগলো। বললাম কিছু একটা হয়েছে, আমায় বলো। কথা এড়িয়েই যাচ্ছে। বললাম বাপিকে ফোন দাও। দিলো বাপি বললো ভালো আছে। আরে সন্তানও একসময় বাবা-মায়ের ফাঁকি বোঝে, সে কথা মামনি-বাপি বোঝেনি। ইমোশন্যাল ব্ল্যাকমেল করায় কাজ হলো, জানলাম বাপির হিপ জয়েন্ট ভেঙ্গে গেছে। সি.এন.জি’র ধাক্কায়। যে মানুষটা প্রতিদিন ফোনে বলবে, ‘বল তুই কই কই যাবি?’ আমি উল্টো বলি তোমার কোথায় ইচ্ছে? বলে ঘুরতে পারবে কিনা! বললাম শুধু বলো কোথায় যেতে চাও? দুনিয়ার লিষ্ট বানানো হয়ে গেছে, এমনকি কলকাতায় যাবে কালীঘাট-দক্ষিণেশ্বর। বললাম ঠিক আছে, সেই মানুষটা বিছানায়। কতো খাবার কিনেছিলাম। ডায়াবেটিকস ফুড তো আছেই, চকোলেট পর্যন্ত কিনে বলেছি, তোমার বাবা-মাও এসব খাওয়ায়নি। জীবনে দেখেছো এসব খাবার? বাপি বলে, ‘আমার মা তো আছে, তুই তো আমার মা।’ এরপর আব্দারের যা বাহার! বললাম তোমার বাবা কি আমায় টাকা দিয়ে গেছে এতোকিছু কেনার জন্য? বলে, ‘ওই তুই চাকরি কররে(করছিস), অখন(এখন) টাকা নাই কইলে মাইর খাইবে। ডলার লইয়া আইবে আমার লাগি।’ আমরা বাবা-মেয়ের কথা কেউ শুনলে বলবে বন্ধু। সেই মানুষটাকে গিয়ে দেখবো শয্যাশায়ী?

তবুও মনে হলো একদিকে ভালোই হয়েছে আমি যাচ্ছি হাসপাতালে অন্তত থাকা যাবে। তা নইলে মামনিকেই বেশী থাকতে হবে। সেই দিন এলো। তার আগে আরোও কিছু কথা। আমার বান্ধবী ওকে ফেলে যাবো, কি জানি কতোটুকু বুঝেছে কষ্ট হচ্ছিলো। দেশে গিয়েও ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। বন্ধুত্ত্ব এমন এক বন্ধন যা বাবা-মায়ের সাথে একই কাতারের সমতুল্য আমার কাছে। ওকে বলে গিয়েছিলাম সপ্তাহে দু’দিন গাছে এসে জল দিতে। আমি থাকবো না তিন সপ্তাহ। তার মানে আমার বাসায় আসবে ছয় দিন। যে কয়দিন আসবে, আমি চিঠির সাথে গিফট সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে আরেক বান্ধবীকে বলে গেছি যখনই ঊর্মী আমার বাসায় আসবে ওকে এই এই জায়গাগুলোর কথা বলতে। আমি জানিনা ওর এসবে কেমন অনুভূতি হয়েছিলো, কিন্তু আমার মনে হয়েছিলো এটুকু যদি ওকে একটু ভালো রাখায়। যেদিন আসবো ৩ মার্চ মনে হয়, তরুণ আমার বর টরেন্টো পিয়ারসন এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। পিছুটান এবং সামনের টান–এই দুটি টান নিয়ে সামনের দিকেই পা বাড়ালাম।

তোমাকে দেবোনা আমি আমার সমুদ্র নীল
আমার সবুজ অরণ্য
বরং জড়িয়ে নেবো তোমাকেই
আমার নীলে
আমার সবুজে।
অতিথি পাখী কতোদূর যাবে?
তোমার ডানায় যে ঢেউ তোলো প্রতি শীতে,
আমি সাঁতার কেটে কেটে জল সরিয়ে উজান-ভাটি বেয়ে চলি
অপেক্ষার মাঝে।
আমার শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় পরিবর্তন নেই স্থানের।
কেবল পোষাক পরিবর্তিত হয়।
আকাশ ডাকলেই ছুটে যেতে পারিনা, আমি যে বলাকা নই।
দেখে নিও পরের জন্মে আমি পরিযায়ী পাখী হবো।

যাত্রাশুরু...
যাত্রাশুরু…

ক্রমশ……

হ্যামিল্টন, কানাডা
৪ আগষ্ট, ২০১৫ ইং।

৬১২জন ৬১২জন
0 Shares

৪৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ