কিশোরী লজ্জ্বা মেখে রিক্সায় উঠলো মেয়েটি। তাও কোলে। ক্লাশ সিক্সে পড়া মেয়েটি এদিক-ওদিক চাইছে কেউ কি ওকে কোলে দেখে হাসছে? বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা। যে-ই ওকে দেখে সকলেই বলে ক্লাশ এইট/নাইনের মেয়ে। শুনতে ভালো লাগে। কবে যে দুটি বছর শেষ হবে।স্কুলে ওর জুনিয়রও থাকবে।এখন ও যাচ্ছে শপিং-এ ওর আন্টির সাথে। জামা কিনে দেবে। তাও ওর পছন্দের। মামনি সবসময় জামা বানিয়ে দেয়, কেনা জামা কি যে পড়তে ইচ্ছে করে। অনেক খুশী ও আজ।যদিও আন্টিও জামা বানিয়ে দেয় ওকে। এবার মনে হয় সত্যিই বড়ো হয়েছে।গন্তব্য জিন্দাবাজারের লতিফ সেন্টার। ওখানে গেলে মেয়েটির এতো আনন্দ হয়, যদিও কিছুই তেমন পাওয়া হয়ে ওঠেনা। অবশ্য মেয়েটির কেনাকাটায় মন নেই, দেখার জন্যেই অস্থিরতা কাজ করে। একটা কাপড়ের দোকানে গেলো মেয়েটি ওর আন্টির সাথে।থরে থরে সাজানো অনেক কাপড়। একটি একটি করে প্যাকেট খোলা হচ্ছে। আন্টি তো অনুমতি দিয়েছে। এতো এতো জামা, কেন একটাও ভালো লাগছে না? আন্টি বলছে, “কি হলো কোনটা পছন্দ বলবি তো?” কি অসহায় মেয়েটি, জীবনে কোনোদিন নিজের পছন্দে কেনেনি। তার মানে ও এখনও বড়ো হয়নি? কবে বড়ো হবে? কবে? চোখে জল নেই, কিন্তু ভেতর ভেতর বয়ে যাচ্ছে নদী-সাগর। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু ও তো কাঁদতে জানেনা। একটা জামা পছন্দ করতে পারছেনা ও, তারপর তো সবাই বলবে কি হলো তুই না বড়ো হয়েছিস বলিস?
অসহায় চোখ দুটো নীচে নামিয়ে খুব আস্তে করে বললো যাতে দোকানের মানুষ না বোঝে, আন্টি আর জামা নেই? দোকানের মানুষটা বললো আর যা আছে সেসব নাকি অতোটা ভালো না। আন্টি তাও বললো দেখাতে। ওখানেই চোখ আটকে গেলো নীল একটা ফ্রকের দিকে। হাতটা এগিয়ে নেবে কি নেবেনা ভাবছিলো, আন্টি ওই জামাটা হাতে নিয়ে জানতে চাইলো, “এটা ভালো লেগেছে? দাঁড়া তো দেখি লম্বায় ঠিক আছে কিনা।” অবাক হয়ে গেলো মেয়েটি আন্টি কি করে বুঝলো? বড়ো হলেই বুঝি এভাবে বুঝতে পারা যায়?
সাধারণ নীল ওই জামাটা পড়ার জন্যে কি অপেক্ষা। কেন কোনো অনুষ্ঠান নেই? মেয়েটির জীবনের একটি আনন্দের বছর ছিলো সেটি, পছন্দ করে একটা জামা কেনার জন্য। অনেক সাদা জামার মধ্যে নীল রঙের ওই জামাটা মেয়েটির জীবনের প্রথম পছন্দের বলে এতো যত্ন পেয়েছিলো, তাই শুধু নয়। সাদা রং ছাড়া আর কোনো রঙের জামা ছিলোনা, এটাও একটা কারণ বটে।মেয়েটির প্রিয় ভাইটাও খুব খুশী হয়েছিলো, ওর নীল টি-শার্ট ছিলো তো। তো ভাইটি ফুটবল খেলতো মাঠে। জিতে আসলে কি খুশী হতো মেয়েটি। ভাইয়ের প্রিয় ফুটবল দল ছিলো আবাহনী। তাদের জার্সি ছিলো নীল রঙের। খেলা বুঝতো না মেয়েটা, কিন্তু খেলার দিন দুই ভাই-বোন নীল রঙের জামা পড়তো। আর একটা পতাকাও বানিয়েছিলো নীল রঙের। সেই পতাকাটি হারিয়ে গেছে সময়ের সাথে। ইঁদুরের খাবার হিসেবে একদিন ষ্টোররুমে পাওয়া গিয়েছিলো পতাকাটি।
আজ মেয়েটি অনেক বড়ো হয়ে গেছে,সময়ের কাঁটা মেয়েটিকে ঠিক বড়ো করেছে বয়স বাড়িয়ে।এতোই বড়ো যে তার সন্তান তাকে ছাড়িয়ে গেছে।শুধু ভুল জেনেছে সেই কিশোরী বেলায় যে, বড়ো হলেই সব ইচ্ছেকে পূর্ণ করা যায়, সব চাওয়া পাওয়া হয়ে যায়।তবে এটুকু এখনও মেয়েটির মধ্যে আছে যা কোনোকিছুর বিনিময়েও হারিয়ে যেতে দেয়নি।ওর হাসি, দুষ্টুমী,আহ্লাদী আর অভিমান।ওহ আরেকটি কথা, মেয়েটি এখনও কোনো কিছু পছন্দ করতে পারেনা নিজে থেকে।অস্থির করে ফেলে বান্ধবীদের।শপিং-এ গেলে ছবি তুলে পাঠাবে দুই বান্ধবীকে।কোনটা কিনবে!!!আর কাছে থাকলে তো খবরই হলো…বলতে হবে?
সবশেষে পরিচিতি :-
মেয়েটির একটা নাম আছে, নীলাঞ্জনা। সবাই ওকে ডাকে নীলা বলে। আর ওর ভাইয়ের নাম রানা। ওর আন্টি হলো মিতা আন্টি। প্রিয় মানুষটি আজ আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। নীল আকাশটায় নীল শাড়ী পড়ে। আরেকটা নীল জামা দেবে আন্টি?
হ্যামিল্টন,কানাডা
২৮ মে,২০১৫ইং।
ছবিটি ক্লাশ সেভেনে পড়ার সময় তোলা জন্মদিনের ছবি এটি। জামাটি মামনির তৈরী, হাতের চুড়ী এবং চুলে লাগানো ক্লিপের সাথে ফুল…এ দুটো মাসতুতো ভাই শান্তনুর বাবা সুশীল মেশোর কিনে দেয়া।সেই মানুষটিও নেই।সেই নীল জামাটির কোনো ছবি নেই।ভালোই হয়েছে না থেকে,ছবিতে স্মৃতি দেখা যায়।অনুভবের স্থায়িত্ত্ব সেখানে কম।ছবি সব সময় কথা বলেনা…তবে ওই নীল জামার পরে সবার জানা হয়ে গিয়েছিলো আমার নীল রঙ যে প্রিয়।আর এ জামাটিও নীল আর সাদা রং-এর।
৩০টি মন্তব্য
শুন্য শুন্যালয়
আপনার স্মরণশক্তির প্রশংসা করতেই হচ্ছে, সবকিছু মনে গেঁথে রেখেছেন। স্মৃতি যেখানে কথা বলে, সেখানে ছবি প্রয়োজনীয় নয়। এমন স্মৃতিময় পোস্ট সবাইকে নস্টালজিক করে দেয়।
“শুধু ভুল জেনেছে সেই কিশোরী বেলায় যে, বড়ো হলেই সব ইচ্ছেকে পূর্ণ করা যায়, সব চাওয়া পাওয়া হয়ে যায়”। সুন্দর বলেছেন আপু, ছোট বেলার বিশ্বাসগুলো বড় বেলায় কেমন অসত্যি হয়ে যায়।
নীলাঞ্জনা যার নাম, নীল রঙ ছাড়া কি তাকে মানায়? 🙂 বড় বেলার নীলা আপুকে না দেখলেও কিশোরী নীলা আপুকে দেখলাম আজ। কিউট।
নীলাঞ্জনা নীলা
কিছুতেই না…নীল ছাড়া নীলা নেই… 🙂
ব্লগার সজীব
স্মৃতি কথা এত সুন্দর হয়!!!!
নীলাঞ্জনা নীলা
স্মৃতি মানেই তো সুন্দর সময়…
খেয়ালী মেয়ে
পিচ্চিবেলার আপনিতো দেখি অনেক কিউট ছিলেন, আর নিঃসন্দেহে বলা যায় বড়বেলার আপনি আরো বেশী কিউট -{@
নীল জামার স্মৃতিচারণ খুব সুন্দর হয়েছে…
আর এটাও সত্যি যে বড় হলেই সব ইচ্ছেকে পূর্ণ করা যায় না, সব চাওয়া পাওয়া হয়ে যায় না….
নীলাঞ্জনা নীলা
কিউট তো প্রোফাইলে ওই ছোট্ট মেয়েটা চাঁদের দিকে মুখ করে বসে আছে… 🙂
খেয়ালী মেয়ে
যাও আমরা দুজনেই কিউট 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
:D) ঠিক ঠিক
মিথুন
ছোটবেলায় বড় হবার, আর বড়বেলায় ছোট হবার আক্ষেপ থাকবেই আমাদের। সুন্দর সুখস্মৃতি।
আপুর হাসিটা খুব কিউট…………
নীলাঞ্জনা নীলা
হাসি-ই তো ঈশ্বরের সবচেয়ে দামী উপহার… 🙂
স্বপ্ন
আপনি এখনো নিজে নিজে কিছু পছন্দ করতে পারেন না ? অবাক হলাম খুব।লেখাটি পড়ে আপনাকে চিনলাম অনেকটা আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
আসলেই না…কতো যে বকুনী খাই বান্ধবীদের থেকে… ;(
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
চমৎকার স্বরণ শক্তি আপনার এত ছোট বেলার প্রথম পছন্দের বস্তুতি কেনা মনে রাখলেন কি করে।জীবন এমনি কখন যে শেষ অধ্যায়ে চলে আসে টের পাওয়া যায়না।
নীলাঞ্জনা নীলা
জ্ঞান হবার পর থেকে এমন অনেক কথা আছে শৈশবের যা এখনও মনে আছে…এটা তো ক্লাশ সিক্সের ঘটনা…আমার ক্লাশ টু-এর ঘটনাও মনে আছে অনেক…ধন্যবাদ আপনাকে।
স্বদেশী যোদ্ধা
” এতোই বড়ো যে তার সন্তান তাকে ছাড়িয়ে গেছে। ”
এটাই পৃথিবীর নিয়ম ।
পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় সৃষ্ট জিনিসকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্যেই ।
নীলাঞ্জনা নীলা
এটুকুই তো সব মায়েরা চায়,তাদের সন্তান যেনো তাদের মায়েদের ছাড়িয়ে গিয়ে বড়ো মনের মানুষ হয়।
লীলাবতী
নীলাদি এমন স্মৃতিকথা আপনাকেই মানায়।অসাধারন লেখনি শক্তি আপনার।
নীলাঞ্জনা নীলা
পথ চলতে ওসব কথাই মনে করি আর হাসি।হয়তো এ কারণেই লিখতে পারি এখনও। -{@
মেহেরী তাজ
আপু আপনার সাথে আমার অনেক মিল দেখছি। আমিও বয়সের তুলনায় অনেক লম্বা ছিলাম। সেটা নিয়ে খুব লজ্বাও পেতাম।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বুঝতে শিখেছি এটা একটা আশীর্বাদ। এটা সৃষ্টিকর্তা সবায় কে দেয় না।
আর হ্যা আপু আমার ডাক নাম কিন্তু মিতা ।
নীলাঞ্জনা নীলা
বাহ!তাহলে তো অনেক মিল 🙂
অনিকেত নন্দিনী
ছোটোবেলার খুব আপন কোনো স্মৃতির ছবি না থাকাই বরং ভালো। নিজের একান্ত আপন স্মৃতি মনের কোনো এক কোণে স্মৃতির দীপ জ্বালিয়ে রাখে।
ছবিতে কিশোরী নীলাঞ্জনার হাসিতে প্রাণোচ্ছ্বাসের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ছে। এবেলার নীলাঞ্জনাও কি এমনি করেই হাসে?
ভালো থাকবেন দিদি।
নীলাঞ্জনা নীলা
এবেলার নীলাঞ্জনার হাসি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে 🙂
জিসান শা ইকরাম
খুব সুন্দর করে নিজের অনুভুতিকে প্রকাশ করা হয়েছে
কিন্তু এখনো কিনতে গেলে এমন হবে কেন?
প্রবাসে ভালো থাকিস।
নীলাঞ্জনা নীলা
দোয়া করো নানা।
অরণ্য
আপনার লেখায় আমার মেয়েকে পেলাম কিছুটা। আবাহনীর খেলার দিনের সাথে মিলিয়ে নিলাম বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। আর নীলা ও রানার কীর্তি-কলাপের সাথে মিলিয়ে নিলাম আমার দুই ছেলেমেয়েদের।
আপনার লেখায় কিছু সুগন্ধি থাকে সবসময়ই।
ভাল থাকবেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
ইমন
আহ! গায়ের লুম দাড়িয়ে গেলো আপু। আল্লাহ আপনার ঐ আন্টিকে বেহেশত নসিব করোক।
নীলাঞ্জনা নীলা
গায়ের লুম দাঁড়িয়ে যাবার মত লেখা বুঝি! ধন্যবাদ আপনাকে।
ইমন
হুম। 😀 আমিতো খুব লক্ষ্মী ছেলে তাই এমনি এমনি অল্পতেই খুশি হয়ে যাই। :3
নীলাঞ্জনা নীলা
🙂