আপনমনে বসে আছে এসআই রক্তিম। সারাদিনের ডিউটি শেষে ক্লান্ত হয়ে আছে সে। বসে বসে ভাবছে আজকের দিনের ঘটনা। হটাতই মনে পড়লো চিঠিটার কথা। বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সে ! দ্রুত গিয়ে নিজের ইউনিফর্মের প্যান্টের পকেটে হাতড়ে বের করলো চিঠিটা। পড়তে শুরু করলো …
।।………।।
প্রিয়তমা,
আজ আমাদের বিয়ের ১০ বছর পূর্ণ হলো। দীর্ঘ ছয় বছর হয়ে গেছে তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেছো। কিন্তু রয়ে গেছে তোমার স্বৃতিগুলো আর রয়ে গেছে আমাকে দিয়ে যাওয়া তোমার শ্রেষ্ঠ উপহার, মিলি। জানো, ও না দেখতে একদম তোমার মত ? মেয়েরা না সাধারণত বাবার মত হয় দেখতে কিন্তু ও হয়েছে একদম মায়ের মত ! যাই হোক, ভালোই হয়েছে। বাপের যে চেহারা সেটার মত হলে কি যে হতো আল্লাহই জানে !
জানো ওর স্বভাবটাও না একদমই তোমার মত। খালি আমার উপর খবরদারি করার স্বভাব। আর মনের মত কিছু না করলেই হয়েছে একেবারে অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। সেই অভিমানকে পাত্তা না দিয়ে উপায় কি বলো ?
জানো, তুমি চলে যাওয়ার পরে না আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় জানতেন যে তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। তাই বোধহয় তোমার কার্বন কপি তৈরি করে পাঠিয়েছেন আগেই। জানো, এখনো না মাঝেমধ্যেই মনে হয় তুমি আমায় ডাকছো। এখনো কেন জানি মনে হয় তুমি বেঁচে আছো। আছো আমাদের অনেক কাছেই।
মিলি সেদিন জিজ্ঞেস করছিল তোমার কথা। আমি ওকে বললাম, ” ঐ যে তারাটা দেখছো সেটাই তোমার আম্মু ! ” ও জানতে চাইল, ” বাবা ! সবার আম্মু এত কাছে থাকে আর আমার আম্মু এত দূরে কেন ? ” সাত বছর বয়সী মেয়েটার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি কেবল চোখের কোণে একটু পানি জমে উঠেছিল আমার।
এত বছরেও তোমার স্বৃতিগুলো ভুলতে পারিনি আমি। আমি কেবল তোমাকে ভালোবাসি, পৃথিবীর কোন পুরুষ কোন নারীকে এত ভালোবাসেনি। তুমি চলে যাওয়ার পর কেবল মিলির জন্য আমি বেঁচে রয়েছি আজ। তাও এদানীং কেমন জানি ভয় ভয় লাগে ! আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে মিলির কি হবে ?
না না, টাকা পয়সার কোন চিন্তা ওর হবে না। আমার সারাজীবনের রোজগার, পৈতৃক সম্পত্তি সব ওর জন্য জমা করে রেখেছি কিন্তু আমি, তুমি কেউ না থাকলে ও বাঁচবে কি করে !
জানো, আমি এখন অফিসে বসে চিঠিটা লিখছি। খুব ইচ্ছা করছে তোমায় দেখতে। যদি পারতাম ! যাই হোক, এই চিঠি কোনদিনও তোমার নিকট পৌঁছাবে না জানি কিন্তু তাও প্রতিবারের মত এবারও আমি বেলুনে বেঁধে উড়িয়ে দিবো।
মনে আছে চলে যাবার সময় তুমি শেষ কি বলেছিলে আমায় ? ” আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো ! ” আমি এখন সেটাই করছি।
বিদায়, প্রিয়তমা। যেখানেই থাকো ভালো থাকো।
ইতি
কামরুল
।।……।।
চিঠিটা শেষ করেই চোখের কোণে জলের অস্তিত্ব অনুভব করলো সে। ভাবতে লাগলো দুপুরের ঘটনার কথা …
উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তায় হাঁটছে সে। দুপুরের প্রচণ্ড কড়া রোদ। একের পর এক সিগারেট টেনেই চলেছে। যথেষ্ট চিন্তাযুক্ত অবস্থায় রয়েছে। ভাবছেই কেবল …… এই ফাউল চাকরিটা যে আর ভালো লাগছে না ! এমন সময় হটাতই প্রচণ্ড হার্ড-ব্রেকের শব্দে চমকে ফিরে তাকালো সে। একটা প্রাইভেট কারের ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে রয়েছে একজন মানুষ !
গাড়িটা দ্রুত পালিয়ে গেলো। চমকের প্রথম ধাক্কাটা সামতে উঠতেই সদ্য ধরানো সিগারেটটা ফেলে দৌড় দিলো রক্তিম। মাঝবয়সী একজন ভদ্রলোক … প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে তার। ” ওনাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। ” আশেপাশের জনতার দিকে তাকিয়ে বললো সে।
পুলিশের ইউনিফর্ম দেখে মানুষজন বেশ আশ্বস্ত হলো। একজন গিয়ে একটা সিএনজি নিয়ে আসলো। ” আমার সাথে ধরেন তো একটু ! ” বলতেই বেশ কয়েকজন এগিয়ে আসলো সাহায্যের জন্য।
সিএনজিতে উঠেই ড্রাইভারকে বললো, ” সোজা ঢাকা মেডিকেল যাবেন। ”
আধাঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলো। দ্রুতই লোকটাকে জরুরী বিভাগে নিয়ে গেলেন ডাক্তাররা। সিএনজিতে থাকতেই লোকটার পকেট চেক করেছে সে। মোবাইল, ম্যানিব্যাগে আইডেন্টি কার্ড সহ কিছু টাকা আর একটা চিঠি। সবকিছুই তার হেফাজতে নিয়ে রেখেছে সে। লোকটার নামঃ কামরুল ইসলাম। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকুরী করেন। ইতোমধ্যেই সেখানে ফোন দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে রক্তিম …
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই কামরুল সাহেবের পরিবারের সদস্যরা চলে আসলেন। নিজের হেফাজতে থাকা মোবাইল আর ম্যানিব্যাগটা দিয়ে দিলো তাদের হাতে, কিন্তু চিঠিটা দিতে মনে ছিল না।
হটাত ফোন আসলো একটা। চমকে বাস্তবে ফিরে এলো রক্তিম।
” হ্যালো। ”
– হ্যালো! এসআই রক্তিম ?
– জ্বি।
– আমি এসআই সজীব, ঢাকা মেডিকেল থেকে।
– ও বলেন।
– আপনি দুপুরে যে প্যাশেন্ট এনেছিলেন, নামঃ কামরুল, উনি মারা গেছেন।
মানুষের মৃত্যু সংবাদ সবাইকেই স্তব্ধ করে দেয়। রক্তিমকেও দিলো। যদিও সে ওই কামরুলকে চিনতো না।
চুপচাপ বসে রয়েছে সে। আকাশে তাকালো। তারা দেখা যাচ্ছে অনেক। তার হটাত কি যেন হলো ! দৌড়ে গিয়ে নিচের দোকান থেকে বেলুন কিনে আনলো। বাতাস ভরে ফুলিয়ে চিঠিটা বেঁধে উড়িয়ে দিলো আকাশের ঠিকানায়।
মনে মনে ভাবছে, ” যাক ! আসল ঠিকানায় তো পাঠিয়ে দিতে পারলাম অবশেষে। “
১২টি মন্তব্য
অলিভার
অদ্ভুত আমাদের জীবন। যেখানে প্রয়োজন সেখানেই অভাব থাকবে। জনে জনে সেই অভাবের ধরণও হয় ভিন্ন রকমের।
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
আসলেই 🙂
[ বিলম্বে উত্তর দেওয়ার জন্য দুঃখিত ]
মেহেরী তাজ
আহারে…….
এখন সাতবছরের পিচ্চি টার কি হবে…?
লেখাটা অনেক ভালো লেগেছে কিন্তু কষ্ট ও পাইছি….!
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
ভালো লেগেছে দেখে ধন্যবাদ 🙂
[ বিলম্বে উত্তর দেওয়ার জন্য দুঃখিত ]
আশা জাগানিয়া
ভালো লেগেছে ভাই। কিন্তু আপনার নাম দেখে তো ভয় পেলাম।
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
ভালো লেগেছে সেজন্য ধন্যবাদ। 🙂 আর ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। ভয়ঙ্কর কিছু আমি লিখি না। ব্লগ চেক করলেই বুঝতে পারবেন।
শুন্য শুন্যালয়
আইডি চেঞ্জ করলে মহা বিপদে পরি। সোনেলায় স্বাগতম প্রায় লিখেই ফেলেছিলাম 🙂 আপনি ওয়াহিদ আবদুল্লাহ ভাইয়া কি?
লেখাটা ভালো লেগেছে।
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
জ্বি আমি ওয়াহিদ আব্দুল্লাহ 🙂
লেখা ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ।
[ বিলম্বে জবাব দেওয়ার জন্য দুঃখিত ]
খেয়ালী মেয়ে
চিঠির প্রতি আমার প্রচন্ড দূর্বলতা রয়েছে…খুব ভালো লাগে আমার চিঠি পড়তে….কিন্তু এই চিঠিটা পড়ে অনেক কষ্ট পেয়েছি…কষ্ট হচ্ছে মিলির জন্য….
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
ভালো লেগেছে সেজন্য ধন্যবাদ। 🙂
[ বিলম্বে জবাব দেওয়ার জন্য দুঃখিত ]
রাইসুল জজ্
ভালো লেগেছে 🙂
ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
ধন্যবাদ।
[ বিলম্বে উত্তর দেওয়ার জন্য দুঃখিত ]